অথবা, বস্তুগত ভাববাদ বা পরব্রহ্মবাদ কী?
ভূমিকাঃ ভাববাদ এমন একটি দার্শনিক মতবাদ যা ভাব বা ধারণা বা আত্মাকে একমাত্র প্রকৃত সত্তা বলে মনে করে। জ্ঞান বা চৈতন্য বা আত্মাই চরম সত্য। ভাববাদের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, দুই প্রকার ভাববাদ দার্শনিকদের আলােচনায় বিবেচিত হয়; যথা- ১. আত্মগত ভাববাদ এবং ২. বস্তুগত ভাববাদ। নিম্নে বস্তুগত ভাববাদ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-
বস্তুগত ভাববাদঃ এ মতবাদ অনুসারে, মন ও বস্তু উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ বাহ্যবস্তু মনের ধারণা নয় বরং জ্ঞানের বিষয়রূপে বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এই ভাববাদে জ্ঞানের অপরিহার্য বিষয়রূপে জাগতিক বস্তুকে স্বীকার করা হয় বলে একে বস্তুগত ভাববাদ বলে। জীবাত্মা ও জড়বস্তু উভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ। এরা মূলত এক, যে কারণে জীবের পক্ষে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কান্টের দার্শনিক চিন্তা নতুনরূপ লাভ করে কিকটে ও হেগেলের দার্শনিক চিন্তায়। ফিকটের মতে, পরম আত্মাই পরম সত্তা। ব্যক্তি আত্মা দর্শনের মাধ্যমেই দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে উঠে এ সর্বজনীন আত্মার চেতনা অনুভব করতে পারে। এই মতকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেন হেগেল। তার মতে, বিশ্বজগৎ পরাত্মার এক চিন্তন প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ জাগতিক বস্তুসমূহ পরমাত্মারই প্রকাশ মাত্র।
বস্তুগত ভাববাদ এক ধরনের অধিবিদ্যক বা তত্ত্ববিদ্যক ভাববাদ। অন্যান্য অধিবিদ্যক ভাববাদের মতাে পরম সত্তার একটি লক্ষণ ধরে নিয়ে বস্তুগত ভাববাদ তার আলােচনায় অগ্রসর হয়। বস্তুগত ভাববাদের প্রধান প্রবক্তা হেগেল পরমসত্তার লক্ষণ এভাবে দেন- যা অসীম এবং সম্পূর্ণ স্বনির্ভর তা-ই পরমসত্তা। পরমাত্মা জগতের বিভিন্ন বস্তুর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। পরমাত্মার বিকাশসাধন প্রক্রিয়া আমরা শিল্প, দর্শন, ইতিহাস ও ধর্মের ক্রমবিকাশের মধ্যে পাই। এই বিশ্বজগতের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে দিয়েই পরমাত্মা মূর্ত হয়ে ওঠে। সসীম মন বা সসীম বিশ্ব ওই অসীম মনের ওপর নির্ভরশীল। এই সসীম বিশ্বকে ওই অসীম মন থেকে আলাদা করা যায় না। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তু, জড় ও মন হলাে পরস্পর সম্বন্ধবিশিষ্ট সত্তা এবং এগুলাে ওই পরমাত্মার চেতনা বা পরম মনের প্রকাশ মাত্র। হেগেল মনে করেন যে, স্রষ্টার বিকাশ সৃষ্টির মধ্য দিয়েই হয়ে থাকে এবং বিশ্বজগৎ অলীক বা মিথ্যা নয়।
হেগেলের পরমার্থবাদী ভাববাদ বা অবিমিশ্র আধ্যাত্মিক মতবাদকে অনেকেই সন্তোষজনক মনে করেন। এই বিশ্বজগৎ পরম আত্মারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এবং পরমাত্মা এই বিশ্বজগতের সৃষ্টির মাধ্যমে ধন্য হয়। পরমাত্মা জীব ও জগৎকে সৃষ্টি করে এবং সে হিসেবে জড় ও চেতনার মধ্যে কোন বিরােধই থাকতে পারে না। জীব ও জগৎ অলীক হতে পারে না, কেননা জীব ও জগতের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা মূর্ত হয়ে ওঠে। তাই জড় ও মন হলাে দুটি বাস্তব সত্তা এবং এগুলাে পরমাত্মার চেতনা বা মনের বহিঃপ্রকাশের দুটি স্তর ছাড়া কিছুই নয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, হেগেল-পরবর্তী বিভিন্ন দার্শনিক আধ্যাত্মিক দর্শনকে সমর্থন করেছেন। তাদের মধ্যে কেয়ার্ড, গ্রিন, ম্যাক ট্যাগার্ট, বােসাঙ্কে রয়েস প্রমুখ দার্শনিকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাদের মতে, পরমাত্মার অংশ হলাে ব্যক্তি আত্মা। এবং ব্যক্তি আত্মা ও পরমাত্মার আঙ্গিক সম্পর্ক শুধু কল্পনাপ্রসূতই নয় বরং এই ব্যক্তি আত্মা পরম আত্মার মাধ্যমেই নৈতিক ও ধর্মীয় আনন্দ উপভােগ করে থাকে। সমগ্র ও অংশের মধ্যে যেরূপ সম্পর্ক আছে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেরূপ সম্পর্ক নেই।
Leave a comment