‘বসুন্ধরা’ কবিতায় এই ইচ্ছা কেন এবং কিভাবে প্রকাশিত হয়েছে নিজ ভাষায় বর্ণনা করো।

রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনার সঙ্গে আশৈশব মিশে গেছে মানবপ্রীতির সুর। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম তাই বস্তুত প্রকৃতি ও মানবের দ্বৈতলীলা। ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় যে বিশ্বাত্মবোধ ধ্বনিত হয়েছে, স্বাভাবিক কারণেই সেখানে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আত্মচৈতন্যের মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিচিত্র জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনধারার সঙ্গেও মিলিত হবার দুর্দমনীয় ইচ্ছা কবি প্রকাশ করেছেন।

দুর্গম মরুপ্রদেশে যেখানে বসুন্ধরা উত্তপ্ত বালুকাশয্যায় জ্বরতপ্তের মতো পড়ে আছেন, হিমাচ্ছাদিত শৈলপ্রদেশে যেখানে পৃথিবী ধ্যানগম্ভীর, মেরু অঞ্চলে যেখানে পৃথিবী তুষারাবৃতা, নিরাভরণ—সেই সব অঞ্চলে যে বিচিত্র জীবনধারা প্রবাহিত হচ্ছে, কবি সেইসব মানবগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চান। সমুদ্রতটপ্রান্তে যেখানে একটি ক্ষুদ্র শান্ত পল্লীজীবন প্রবাহিত হচ্ছে, সেই জীবন প্রবাহের সঙ্গেও কবি মিলিত হতে চেয়েছেন। উদ্ভুদুগ্ধপানকারী মরুবাসী দুর্দান্ত আরব সন্তানদের মধ্যে, তিব্বতের বৌদ্ধধর্মালম্বীদের শাস্ত নির্লিপ্ত জীবনপ্রবাহে, দ্রাক্ষাপায়ী গোলাপকাননবাসী পারসিকদের জীবনে, নির্ভীক অশ্বারূঢ় তাতারদের জীবনধারায় কবি নিজেকে মিশ্রিত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। এমন কি আদিম অরণ্যবাসী ধর্মাচারহীন স্বাস্থ্যময় জনগোষ্ঠীর হিংস্র উল্লাসের আনন্দটিও কবি আকণ্ঠ পান করতে চান।

পল্লীজীবনের শান্ত স্নিগ্ধ জীবনস্রোতের মধ্যেও কবি নিজেকে মিশ্রিত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। এইভাবে বসুন্ধরার বিভিন্ন প্রান্তে যত বিচিত্র জীবন ও সংস্কৃতি, চীন জাপানসহ বিভিন্ন দেশে যত বিচিত্র জাতি, এ যাবৎকাল বিকশিত হয়ে উঠেছে সেই সবকালের সর্বমানবের সঙ্গেই কবি নিজ প্রাণচৈতন্যে মিলিত করার সুতীব্র আবেগকম্পিত ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছা দেশ-কাল অতিক্রম করে সর্বদেশের সর্বকালের মানবজীবন স্রোতের সঙ্গে আত্মচৈতন্যকে মিশ্রিত করা।

‘আমার পৃথিবী তুমি বহু বরষের’—কবির এই অনুভূতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘সোনার তরী’ পর্বে পদ্মালালিত পল্লীবাংলায় দীর্ঘকাল প্রকৃতি ও মানব সংসর্গে দিনযাপনের ফলে কবির প্রকৃতিপ্রীতি এক অপূর্ব নিবিড়তা প্রাপ্ত হয়। শিলাইদহে সন্ধ্যা-প্রভাত-মধ্যাহ্ন, গ্রীষ্ম-বর্ষা, সজন-নির্জন পরিবেশে কাটাতে কাটাতে শুধু সৌন্দর্য-সম্ভোগ নয় বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গেই যেন এক একাত্মতা অনুভব করেছেন কবি। নির্জনে পদ্মাতীরে বসে তাঁর মনে হয়েছে, এই ধরিত্রীর সঙ্গে তাঁর যেন জন্মজন্মান্তরের আত্মীয়তা। বহুকাল থেকেই তাঁর এই অনুভূতিটি মনের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। ছিন্নপত্রে তিনি লিখেছিলেন—“এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নূতন; আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে।”

এই বিশেষ অনুভূতিই যেন কবির পূর্বস্মৃতিকে জাগ্রত করে। কবি উপলব্ধি করেন ধরিত্রীমাতা যখন সমুদ্র থেকে প্রথম জাত হলেন, তখনই সেই ধরিত্রীর প্রাণকোষের স্পন্দনে কবির চৈতন্য মিশ্রিত ছিল। আদি পৃথিবীর শৈবাল-তৃণ-বৃক্ষে কবির প্রাণচৈতন্য প্রথম সূর্যকিরণে স্নাত ও আন্দোলিত হত। তাই কবির সঙ্গে ধরিত্রীর সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের। ঠিক এই অনুভূতিটিই ‘বসুন্ধরা’ কবিতাতেও প্রকাশিত। উদ্ধৃত পঙক্তিতে বসুন্ধরার সঙ্গে কবি আত্মার এই সুদীর্ঘকালের সম্পর্কের কথাটিই কাব্যছন্দে প্রকাশিত।