গিয়াসুদ্দিন বলবন (১২৬৬-৮৭ খ্রিঃ):

আদি পর্বের সুলতানদের মধ্যে গিয়াসুদ্দিন বলবন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত। গিয়াসুদ্দিন বলবনের বাল্যনাম ছিল বাহাউদ্দিন। কৈশোরে মোঙ্গলগণ কর্তৃক ধৃত বাহাউদ্দিন ‘দাস’ হিসেবে বশরার খাজা জামালউদ্দিনের কাছে বিক্রীত হন। জামালউদ্দিনের কাছ থেকে তাঁকে ক্রয় করেন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস। বলবনের দক্ষতা ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে ইলতুৎমিস তাঁকে বিখ্যাত ‘তুর্কান-ই-চাহেলগান’-এর সদস্য মনোনীত করেন এবং নিজকন্যার সাথে বলবনের বিবাহ দেন। রাজিয়ার আমলে বলবন ‘আমির-ই-শিকার’ পদে উন্নীত হন। প্রাথমিক পর্বে বলবন রাজিয়ার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ইয়াকুৎ নামক হাবশি ক্রীতদাসের সাথে রাজিয়ার ঘনিষ্ঠতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলবন রাজিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং বাহরাম শাহ’কে সুলতান পদে বসানোর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নেন। এর পুরস্কার স্বরূপ তিনি রেওয়ার ও হান্‌সির ‘জায়গির’ লাভ করেন। পরবর্তী সুলতান মাসুদ শাহের আমলে বলবন প্রধান কঞ্জুকীর পদে উন্নীত হন। এই সময় মোঙ্গল-নেতা মঙ্গুর আক্রমণের বিরুদ্ধে বলবন তাঁর অদম্য সাহসিকতা ও সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন। রাজপুত উপজাতির বিরুদ্ধেও তিনি সফল অভিযানের নেতৃত্ব দেন। ফলে ‘চল্লিশ তুর্কি’র মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বলবনের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা অন্যান্যদের অতিক্রম করে যায়। মাসুদ শাহের অপসারণ এবং নাসিরুদ্দিন মামুদকে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রেও বলবন মুখ্য ভূমিকা নেন।

নাসিরুদ্দিনের কুড়ি বছরের শাসনপর্বে এক বছরের (১২৫৩ খ্রিঃ) বিরতি ছাড়া বলবনই ছিলেন প্রকৃত শাসক। অধ্যাপক নিজামীর ভাষায় বলা চলে, “এই পর্বে নাসিরুদ্দিন রাজত্ব করতেন, কিন্তু শাসন পরিচালনা করতেন বলবন।” এই সময়ে বলবন তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপান তৈরি করেন। খোক্কর উপজাতি এবং মেওয়াটি দস্যুদের দমন করে, বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুঘান তুথ্রিল খাঁকে বশীভূত করে, পারস্যের মোঙ্গল শাসনকর্তা হলাকুর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে আক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস করে বলবন দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা বিধান করেন। অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সমস্যার সমাধানে তাঁর এই সাফল্য স্বভাবতই তুর্কি-অভিজাতদের ওপর বলবনের প্রভাব দৃঢ়তর করে এবং সুলতান নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর সিংহাসনলাভ ঘটনার অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই আসে।

বলবনের সমস্যাবলি ও তার সমাধান :

বলবনের সিংহাসনারোহণের মুহূর্তে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য বহুমুখী সমস্যায় আকীর্ণ ছিল। প্রথমত, বলবন ‘তুর্কান-ই-চাহেলগান’এর সদস্য হিসেবে ‘চল্লিশচক্রের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। যে সোপান বেয়ে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন, তা অন্য কেউ যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই ‘চল্লিশচক্রের’ ক্ষমতা হ্রাস করা আবশ্যিক হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ‘নায়েব-ই-মামলিকৎ’ হিসেবে বলবন নৃশংস অত্যাচার দ্বারা বহু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করেছেন। কিন্তু দেশীয় শক্তিগুলির বিদ্রোহপ্রবণতা ধ্বংস করতে পারেননি। দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে মেওয়াটি দস্যুদের ক্রিয়াকলাপ, দোয়ার, অযোধ্যার বাণিজ্যপথ এবং রোহিলাখণ্ডের (কাটেহার) অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার ভাঙন সুলতানি সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সামনে সংকট সৃষ্টি করেছিল। বলবন উপলব্ধি করেন যে, সুলতান হিসেবে তাঁর মর্যাদা নিরূপিত হবে শান্তি তথা ন্যায় প্রবর্তনে তাঁর সাফল্যের নিরিখে। এবং সেই কাজের জন্য আবশ্যিক ছিল একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী। তৃতীয়ত, ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তীকালে দুর্বল শাসকদের আমলে উদ্ভূত রাজনৈতিক অস্থিরতা জনসাধারণের মনে সুলতানির প্রতি গভীর অনাস্থার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী অনাস্থা জন্ম দিয়েছিল অবজ্ঞাবোধের। উদ্ভূত পরিস্থিতির বর্ণনা প্রসঙ্গে জিয়াউদ্দিন বারাণী লিখেছেনঃ “Fear of the Governing power, which is the basis of all good government, and the source of the glory and splendour of the state, had departed from the hearts of all men and the country had fall into a wretched condition.” চতুর্থত, মোঙ্গলদের পুনঃপুন আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের মর্যাদা ও স্থায়িত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। অতীতে জনগণের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হলেও মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের কিংবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপথের নিরাপত্তার কোনো স্থায়ী ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সীমান্ত সমস্যা পূর্ববৎ প্রকট ছিল।

অভিজ্ঞ শাসক বলবন ধীরে অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এক-একটি সমস্যার মূলোৎপাটনে আত্মনিয়োগ করেন। বারাণী লিখেছেন যে, বলবন তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরটি দিল্লি ও নিকটবর্তী অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান শত্রু ছিল মেওয়াটি দস্যুগণ। এদের ভয়ে বণিকের দল বাণিজ্য করতে পারত না। সাধারণ মানুষ রাত্রিকালে নির্ভয়ে নিদ্রা যেতে পারত না। দাস-রমণীরা জলসংগ্রহের জন্য প্রধান ফটকের বাইরে গেলে এদের হাতে হেনস্থা হত নানাভাবে। এমনকি এদের ভয়ে মধ্যাহ্নকালীন প্রার্থনার সময় রাজধানীর পশ্চিম ফটক বন্ধ করে রাখতে হত। বলবন এই অবস্থার অবসানকল্পে দিল্লির চতুষ্পার্শ্বস্থ বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে দেন। অতর্কিত আক্রমণ দ্বারা হত্যা করেন বহু মেওয়াটিকে। গোপালগীরে একটি দুর্গ নির্মাণ করে এবং একাধিক পুলিশচৌকি নির্মাণ করে সেগুলির দায়িত্বে আফগান সৈন্যদের নিয়োজিত করেন। এই সকল চৌকির ব্যয়বহনের জন্য নিষ্কর জমি বন্দোবস্ত দেন। সুলতানি বাহিনীর নিরন্তর নজরদারির ফলে দিল্লি দীর্ঘদিনের এক অভিশাপমুক্ত হয়। বারাণী লিখেছেন : “The Sultan with his sword secured many people of God from being molested and plundered by the Meos.”

মেওয়াটিরদের দমন করার পর বলবন গঙ্গা-যমুনা-দোয়ার অঞ্চল এবং অযোধ্যার নিরাপত্তাবিধানে যত্নবান হন। দোয়াবের বিভিন্ন অংশে দক্ষ-ইতাদার নিযুক্ত করে তিনি আইনশৃঙ্খলাভঙ্গকারী যে-কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চরম শাস্তিবিধানের নির্দেশ দেন। বারাণী লিখেছেন যে, “দক্ষ ইতাদাররা নারী-পুরুষ-শিশুনির্বিশেষে বিদ্রোহী প্রজাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে দোয়াবে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। অযোধ্যায় বাণিজ্যপথ তস্করমুক্ত করার জন্য বলবন স্বয়ং কাম্পিল ও পাতিয়ালিতে গিয়ে শিবির স্থাপন করেন। দুষ্কৃতীদের প্রধান ঘাঁটি কাম্পিল, পাতিয়ালি এবং ভোজপুরে তিনটি দুর্গনির্মাণ করে আফগান সেনাদের দায়িত্বে অর্পণ করেন।” এইভাবে দোয়াব অঞ্চল ও অযোধ্যার বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

দোয়াব অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত থাকার সময় বলবন বদাউন, আমরোহা অঞ্চলে কাটেহার হিন্দুবিদ্রোহীদের কার্যকলাপের বিষয় অবহিত হন। কাটেহার (বর্তমানে রোহিলাখণ্ড)-এর বিদ্রোহীরা স্থানীয় ইতাদারদের পর্যন্ত ভয় করত না। এদের ক্ষমতায় ভীতসন্ত্রস্ত ওয়ালিরা (জেলা প্রশাসক) বিনাপ্রতিবাদে সবকিছু মেনে নিত। দোয়াবে নিরাপত্তাবিধানের পর বলবন দিল্লি হয়ে কাটেহার উপস্থিত হন। বারাণী লিখেছেন, “বলবন পৈশাচিক বর্বরতা দ্বারা বিদ্রোহীদের দমন করেন। বিদ্রোহীদের রক্তে কাটেহারের ভূমি রঞ্জিত হয়। স্তূপীকৃত শবের পূতিগন্ধ গঙ্গার তীর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।” কিন্তু অধ্যাপক নিজামী মনে করেন, বারাণীর বিবরণে অতিরঞ্জন আছে। কারণ যেহেতু উক্ত অঞ্চলের কৃষকদের নিরাপত্তাবিধানের জন্য অভিযানে গিয়েছিলেন, সেহেতু এত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়া সম্ভব ছিল না। যাই হোক, বলবনের দৃঢ়তার ফলে কাটেহার অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বলবন যুদ অঞ্চলে (Salt Range) অভিযান চালিয়ে পার্বত্য উপজাতিদের দমন করেন। এই সকল অভিযান দ্বারা বলবন যেমন সুলতানের কর্তৃত্ব ও আইনের শাসন প্রবর্তন করেন, তেমনি তিনি বহুসংখ্যক অশ্ব দখল করতে পারেন।

ঐতিহ্য অনুযায়ী বলবনের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী শাসক হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। সিংহাসন দখল করার পরে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমন করেন। অতঃপর নতুন রাজ্য জয় করে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করাই ছিল পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু বলবন ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বাস্তববাদী শাসক। তাই নতুন নতুন রাজ্য দখল করার পরিবর্তে তিনি তৎকালীন সুলতানি সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণকেই প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। অধ্যাপক নিজামী লিখেছেন : “Though every inch an imperialist, he prefered to adopt a policy of consolidation.” তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল বাস্তব পরিস্থিতির অনুসারী।

বিচক্ষণ শাসক বলবন অনুধাবন করেছিলেন যে, হিন্দু রাজপুত-সহ ভারতীয় শাসকদের স্বাধীনতাকামিতা এবং দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের উত্তর পশ্চিম সীমান্তপথ বারবার আক্রমণের ঘটনা সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি ও স্থায়িত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। তাঁর দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি আদিল খাঁ ও অমর খাঁ বলবনকে গুজরাট ও মালব জয় করে আইবকের সুলতানি সাম্রাজ্যকে পূর্বরূপ দেবার পরামর্শ দিলে বলবন উত্তরে বলেছিলেন: “এই বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার দিনে, যখন মোঙ্গলরা ইসলামের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, লাহোরকে বিধ্বস্ত করেছে এবং সেখান থেকে ভারতের বিরুদ্ধে বছরে অন্তত একবার আক্রমণ শানাচ্ছে, তখন দিল্লি ত্যাগ করে দূরদেশে অভিযানে বের হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিদেশি রাজ্য আক্রমণ ও দখল করার থেকে নিজরাজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান করে শান্তি-সংহতি পুনঃস্থাপন করা অধিক ভালো।” মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি যদি সুযোগ পাই, অবশ্যই অবশিষ্ট হিন্দুস্তানকে পদানত করে আমার সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারিত করব।”

বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ :

দিল্লির সুলতানদের মধ্যে একমাত্র বলবন রাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর আদর্শ ও নীতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। জিয়াউদ্দিন বারাণী ‘ফতোয়া-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থে বলবনের রাজতন্ত্রের আদর্শ-সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ইসামী কিছু না-বলার ফলে বিষয়টির যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। কারণ বারাণী নিজেও বংশমর্যাদা বা জাতপাতের ভেদাভেদ সম্পর্কে বেশ গোঁড়া ছিলেন। বলবনের রাজতন্ত্রের আদর্শেও বংশমর্যাদার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তাই এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, বারাণী তাঁর নিজের মনোভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলবনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। যাই হোক, নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবহেতু বারাণীর বক্তব্যকেই সঠিক বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও সুলতানের শক্তিবৃদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে বলবন সদাসচেতন ছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র এইভাবেই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এবং সামগ্রিকভাবে সুলতানির অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব রক্ষা করা সম্ভব। বলবন নিজে ছিলেন ক্রীতদাস। দক্ষতার জোরে তিনি তুর্কান-ই-চাহেলগানী’র সদস্য হয়েছেন এবং ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তীকালে ইচ্ছামতো সুলতানি প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন। তুর্কি-আমির ও মালিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা যে সুলতান তথা সুলতানি সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়, এ সত্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাই বলবন সুলতান এবং রাজতন্ত্রকে মর্যাদা ও কর্তৃত্বের এমন একটা স্তরে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন, যাকে স্পর্শ করা তুর্কি-আমির বিশেষত, চাহেলগানীর সদস্যদের পক্ষে কেবল অসম্ভব নয়, অবাস্তব বলে মনে হবে। এই লক্ষ্যের সহায়ক হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল তাঁর রাজতন্ত্রের আদর্শ। নিজামী তাই লিখেছেন : “Apart from everything else it necessiated the re establishment of the power and dignity of the Delhi Sultan and for India-a new, if transient, theory of kingship.”

বলবন পারস্যের সাসানীয় বংশের রাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুকরণে তাঁর নরপতিত্বের আদর্শ প্রচার করেন। তিনি বলেন, মানুষের পৃথিবীতে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। বলবন নিজেকে ‘খোদার নায়েব’ (নিয়াবৎ-ই-খুদাই) এবং ‘ঈশ্বরের ছায়া’ (জিলুল্লাহ) বলে ঘোষণা করেন। তাঁর মতে, রাজার হৃদয় হল ঈশ্বরের স্বর্গীয় ধ্যানধারণার ভাণ্ডার এবং এখান থেকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা জনগণের মধ্যে বিকিরিত হয়। রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলবন একদা তাঁর পুত্র বুগরা খাঁকে বলেছিলেন: “The heart of the king is the special repository of God’s favour and in this he has no equal among mankind.” এর দ্বারা তিনি রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক উৎস এবং অভিজাতবর্গ কিংবা প্রজাসাধারণের থেকে রাজার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বের তত্ত্ব প্রচার করেন। ইতিমধ্যে মুসলিম অধিকৃত অধিকাংশ অঞ্চল মোঙ্গলদের অধীনে চলে গিয়েছিল। খলিফারও পতন ঘটেছিল। কিন্তু বলবন তাঁর রাজতন্ত্রের প্রতি খলিফার স্বীকৃতির কথা প্রায়শই প্রচার করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রধান শাসক হিসেবে খলিফার অনুমোদন আবশ্যিক। তাঁর মুদ্রায় খলিফার নাম উল্লেখ করে এবং খুৎবায় তাঁর নাম পাঠ করে তিনি ইসলামীয় রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য রক্ষা করেন।

রাজার স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার অসাধারণত্বকে তিনি রাজতন্ত্রের পক্ষে আবশ্যিক বলে মনে করতেন। নিজেকে তিনি পারস্যের বিখ্যাত আফ্রিসিয়াব বংশের শরিক বলে ঘোষণা করেন এবং অভিজাতবংশীয় নয় এমন কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসাকে রাজার মর্যাদার হানিকর বলে বিশ্বাস করতেন। সাধারণ মানুষের সাথে বাক্যালাপকে তিনি ঘৃণা করতেন। এমনকি রাজকীয় পদে বংশকৌলীন্যহীন কোনো ব্যক্তির নিয়োগ তাঁর কাছে ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। নীচবংশোদ্ভূত মানুষ সম্পর্কে বলবনের উক্তি পাওয়া যায় বারাণীর গ্রন্থে। বলবন বলেছিলেন: “যখনই আমি নীচবংশোদ্ভূত মানুষ দেখি, তখন রাগে আমার প্রতিটি শিরা-উপশিরা জ্বলতে শুরু করে। তাকে হত্যা করার জন্য আমি তরবারির দিকে হাত বাড়াই।” বারাণী আরও লিখেছেন, “একদিন রাজসভা চলাকালে বলবন যখন জানতে পারেন কমল মাহিয়ার নামক জনৈক ধর্মান্তরিত মুসলমানকে আমরোহার মুতাশরিফ পদে নিয়োগ করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।” ‘মকতুবত-ই-আসরিফ’গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বলবন সরকারি পদে নিয়োগের পূর্বে সমস্ত পদপ্রার্থীর বংশকৌলীন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করার ব্যবস্থা করেন। এজন্য বহু কুলাচার্য নিয়োজিত ছিলেন।

বলবন তাঁর রাজতান্ত্রিক আদর্শের পরিপূরক হিসেবে দরবারি আদব-কায়দা ঢেলে সাজান। দরবারে তিনি পারসিক রীতিনীতি অনুসরণের কঠোর নির্দেশ দেন। সুসজ্জিত পোশাক এবং উন্মুক্ত তরবারি হস্তে বিশেষ রাজকীয় বাহিনী দ্বারা পরিবৃত না-হয়ে তিনি কখনো দরবারে জনসমক্ষে বের হতেন না। দরবারে লঘু চপলতা বা হাস্যপরিহাস ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তিনি মদ্যপানও নিষিদ্ধ করে দেন। পারসিক রীতি অনুযায়ী সুলতানের সামনে আসার সময় ‘সিজদা’ অর্থাৎ নতজানু হয়ে প্রণাম এবং ‘পাইবস’ অর্থাৎ সিংহাসনের পদচুম্বন করার নিয়ম প্রবর্তন করেন। ষোড়শ শতকের জনৈক লেখক ফাজুনি অস্তারবাদী লিখেছেন যে, “সুলতানের মুখমণ্ডল সর্বদা এক অদৃষ্টপূর্ব গাম্ভীর্য দ্বারা আবৃত থাকত, যাতে তাঁর দাম্ভিকতামিশ্রিত ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠত। দরবারে তিনি অতি নিম্নস্বরে একমাত্র উজিরের মাধ্যমে অভিযোগ শুনতেন এবং প্রতিবিধানের নির্দেশ দিতেন।” লেনপুল লিখেছেন, “দীর্ঘ শাসনকালে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও কোনো সাধারণ মানুষের সাথে কথোপকথোন করেননি। প্রিয়পুত্র মহম্মদের মৃত্যুসংবাদ শুনেও তিনি দরবারে অচঞ্চল থাকেন, যদিও আপন কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বহু অর্থ ব্যয় করে দরবার সাজানো হত। দরবারের জাঁকজমক ও চাকচিক্যে ঝল্‌সে যেত সাধারণ মানুষের দৃষ্টি।” বারাণী লিখেছেন : “The shining of the sum, the glittering of the sword’s and the brightness of the face (of Balban) all taken together made remarkable show.” এইভাবে শক্তি, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের সম্মিলিত প্রকাশ দেশের অবাধ্য শক্তিগুলিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করত এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সম্ভ্রম ও সন্ত্রাসের সঞ্চার করত,—যা ছিল বলবনের রাজাদর্শের মূল লক্ষ্য।

বলবনের রাজাদর্শের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তুর্কি-আমির ও মালিকদের এবং সিংহাসনে আসীন রাজার মধ্যে অবস্থানগত এবং অনতিক্রম্য তারতম্যের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বলবন তাঁর একদা সহকর্মী চল্লিশচক্রের ক্ষমতাবান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমিরদের মাঝে মাঝেই স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, ষড়যন্ত্র বা গুপ্তহত্যা দ্বারা অভিজাতদের ক্ষমতা অর্জন বা বৃদ্ধি করা যায়; কিন্তু রাজপদ শুধুমাত্র বিষ বা তরবারি দ্বারা অর্জনের বস্তু নয়। এজন্য প্রয়োজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অনুমতি ও সাহায্য। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী এই পদে উন্নীত হয়েছেন; সাধারণের ইচ্ছায় নয়। তাই তাঁর কাজের কৈফিয়ত তিনি ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারও কাছে দিতে বাধ্য নয়। ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে রাজার কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। অধ্যাপক নিজামীর ভাষায় : “Balban realised that his position as a sultan would be judged by the peace or the justice he gave to the country.” জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য তিনি বিচারব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব করার বিরোধী ছিলেন। এমনকি অপরাধী অভিজাতদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানেও তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। নিজের গৃহভৃত্যকে পিটিয়ে হত্যা করার অপরাধে বলবন বদাউনের শাসক মালিক বারবককে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন। অযোধ্যার গভর্নর হায়বৎ খাঁকে মদ্যপ অবস্থায় এক ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধে পাঁচ শত বেত্রাঘাতের ও নিহত ব্যক্তির বিধবা পত্নীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ দেন। কথিত আছে, হায়বৎ খাঁ অপমানে জর্জরিত হয়ে আমৃত্যু আর লোকচক্ষুর সামনে বের হননি। চাহেলগানীর অন্যতম সদস্য তথা অযোধ্যার গভর্নর আমির খাঁ বাংলাদেশের বিদ্রোহদমনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে বলবন তাঁকে অযোধ্যা নগরীর প্রধান ফটকের কাছে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন। তুর্কি অভিজাতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান করে বলবন দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করেন—

  • (১) সুলতানের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে জনমনে আস্থা স্থাপন করেন এবং 

  • (২) তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে এমন সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেন, যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে সুলতানের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখাতে না পারেন।

বলবন বিশ্বাস করতেন যে, পারসিক রীতিনীতিকে বাদ দিয়ে রাজতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রীয়জীবনে অন্ধের মতো পারসিক আদবকায়দা অনুসরণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁর দুই পুত্রসন্তান জন্মেছিলেন। তাদের নামকরণের সময় মুসলিম সাধারণ রীতি অনুযায়ী ‘মামুদ’ ও ‘মহম্মদ’ রাখেন; কিন্তু সুলতানি সিংহাসনে বসার পরবর্তীকালে আগত পৌত্রদের সময় তিনি পারসিক ধারা অনুযায়ী কাইখসরু, কাইকোবাদ, কাইকাউস ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন।

সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন প্রচারিত রাজতন্ত্রের আদর্শ আপাতদৃষ্টিতে রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি, সাম্রাজ্যের সংহতি ও নিরাপত্তাবিধান, শরিয়তের নির্দেশানুযায়ী প্রজাপালন ও ন্যায়বিচার প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি বহন করে এনেছিল। কিন্তু অধ্যাপক কে. এ. নিজামী, আর. পি. ত্রিপাঠী প্রমুখ মনে করেন, এই রাজাদর্শ প্রচারের পেছনে বলবনের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও তা থেকে উত্তরণের একান্ত ইচ্ছা কাজ করেছিল। বলবনের রাজতান্ত্রিক কোনো ঐতিহ্য ছিল না। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সিংহাসন দখল করেছিলেন এবং এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন চাহেলগানীর অন্যান্য সদস্যরা। এখন বলবন তাঁর রাজকর্তৃত্বের ওপর ঐশ্বরিক অনুমোদনের ছাপ লাগিয়ে অন্যান্য আমিরদের থেকে নিজেকে পৃথক করতে এবং রাজকর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মিনহাজ-উস্-সিরাজ বা জিয়াউদ্দিন বারাণী বলবনের ‘দাসত্বমুক্তি’ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করেননি। সম্ভবত বলবনের দাসত্বমুক্তি আদৌ হয়নি। তাই রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক তত্ত্ব প্রচার করে তিনি নিজের দুর্বলতা আড়াল করতে সচেষ্ট হন।

নিজামীও লিখেছেন: “Perhaps he was never manumitted and this basic disqualification to rule over the people, he tried to cover under a shrewdly designed mask of ‘divine commitment of regal authority” বলবন রাজাদর্শ হিসেবে শরিয়তি আইনের রক্ষক বা ন্যায়পরায়ণতা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা-ও ছিল ছলনামাত্র। বারাণী লিখেছেন যে, সাধারণক্ষেত্রে বলবন ন্যায়বিচারের চেষ্টা করলেও, যখন তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থবিজড়িত ঘটনার সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি ন্যায়বোধ বা শরিয়তের বিধানের তোয়াক্কা করতেন না। একজন মধ্যযুগীয় স্বেচ্ছাচারী শাসকের মতোই তিনি আচরণ করতেন। এর পরিণামে তাঁর ভাবমূর্তি ও মর্যাদা নষ্ট হয়েছিল।

বলবনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা :

সাধারণ প্রশাসন এবং সামরিক প্রশাসন সম্পর্কে বলবন দৃঢ় ও নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বলবন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দ্বারা সুলতানের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিবিধ ব্যবস্থা নেন। তাঁর সিংহাসনারোহণের মুহূর্তে সুলতানির শাসনকাঠামো ছিল সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং অকার্যকরী। তুর্কি-আমির ও মালিকদের আচরণ ছিল নিয়ন্ত্রণাধীন। রাজকর্তৃত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের মনে কোনো আস্থা ছিল না। মধ্যযুগীয় প্রশাসনের মূলশক্তি যে রাজতন্ত্রের শৌর্যবীর্য এবং কাঠিন্য, তা তখন অন্তর্হিত। বলবন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে শাসনকাঠামোকে ত্রুটিমুক্ত করে কার্যকরী করার উদ্যোগ নেন।

মধ্যযুগীয় ধারা অনুযায়ী বলবনের শাসন-সংগঠনের প্রকৃতিও ছিল আধা-সামরিক, আধা-সামাজিক। তিনি প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ওপর সুলতানের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিপূর্বে ‘নায়েব-ই-মামলিকৎ’এর উজির পদাধিকারীগণ কীভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে প্রশাসনের দক্ষতা নষ্ট করতেন, সে অভিজ্ঞতা বলবনের ছিল। ‘নায়েব’ পদটি আগেই উঠে গিয়েছিল। বলবন উজিরের পদটি বহাল রাখলেও তাঁর হাত থেকে সামরিক ও অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা সুলতানের হাতে সরিয়ে এনে, উজিরকেও ক্ষমতাহীন করে দেন। অধ্যাপক নিজামী লিখেছেনঃ “With the separation of financial and military authority, the chances of usurpation of power by any government functionary were totally eliminated.”

একই পথের যাত্রী হিসেবে বলবন তুর্কি অভিজাতদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তিনি জানতেন যে, তুর্কি অভিজাতশ্রেণির সমর্থন ছাড়া তাঁর ক্ষমতা বজায় থাকবে না। আবার এটাও জানতেন যে, অভিজাতদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এই কারণে তিনি তুর্কান-ই-চাহেলগানী’র অস্তিত্ব প্রায় লোপ করে দেন। দৃষ্টান্তমূলকভাবে কয়েকজন দক্ষ অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী তুর্কি-মালিককে চরম শাস্তি প্রদান করে সুলতানের চূড়ান্ত কর্তৃত্বের তত্ত্ব জাহির করেন। শের খাঁ, আমিন খাঁ, হায়বৎ খাঁ প্রমুখের হত্যা কিংবা মর্যাদাহানি করে বলবন অভিজাতদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতাকে দমন করেন।

বিচক্ষণ বলবন জানতেন যে, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব এবং উন্নতি নির্ভর করে সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুদক্ষ সেনাবাহিনীর ওপর। ইলতুৎমিস যে সেনাসংগঠন গড়েছিলেন—ইতিমধ্যে তা ভেঙে পড়েছিল। তাই বলবন নতুনভাবে সামরিক প্রশাসন গড়ে তোলেন। কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করা হয়। নগদ অর্থের পরিবর্তে এদের নিষ্কর জমি ইজারা দেওয়া হয়। বলবন নীতিগতভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বর্ধিত পারিশ্রমিক সেনাবাহিনীর আনুগত্য ও সেবালাভের অন্যতম শর্ত। নিজপুত্র বুগরা খাঁকে একদা তিনি বলেছিলেন: “সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত ব্যয়কে কখনো অপ্রয়োজনীয় মনে করো না।” বাহিনীর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি নিয়মিত অনুশীলনের ওপর জোর দিতেন। বলবন অতি সুদক্ষ এবং বিশ্বস্ত এক হাজার সৈন্যের একটি দল সরাসরি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। যুদ্ধযাত্রার সময় সেনাবাহিনী যাতে বেসামরিক সম্পত্তি বা ফসল নষ্ট না করে, সেদিকে বলবনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং কঠোর নির্দেশ ছিল। কোনো সামরিক অভিযান কর্মসূচি গ্রহণের আগে বলবন তার উপযোগিতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীর বিচারবিশ্লেষণ করতেন। তাই ব্যর্থ সামরিক অভিযান দ্বারা অর্থ নষ্ট করার দায় তাঁর ওপর বর্তায়নি।

সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন করতে গিয়ে বলবন ইতা’ ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটান। ইলতুৎমিসের আমলে দোয়াব অঞ্চলে প্রায় দু-হাজার সেনাকে ‘ইক্‌তা’ হিসেবে জমি দেওয়া হয়েছিল। ‘ইতা’ ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল—(১) দক্ষ সৈনিকদের সেবার পুরস্কার হিসেবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ইতা হিসেবে প্রদান করে তার সম্মান ও কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি করা এবং (২) দিল্লির দূরবর্তী অঞ্চলে ইক্তাদারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখা। এ ছাড়া ইক্তার উদ্বৃত্ত রাজস্ব রাজকোষে জমা দেওয়া এবং সুলতানের প্রয়োজনে সামরিক সাহায্য দেওয়াও ইতাদারদের অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ‘ইতা ব্যবস্থা’ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ইতাদারদের মধ্যে স্বাধীনতাস্পৃহা এবং দিল্লির কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শক্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য যে ইতা-প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল, তাই এখন বিচ্ছিন্নতার কারণে পরিণত হয়েছিল। বলবন অনুসন্ধান করে দেখেন যে, ইতিমধ্যে বহু ইতাদার মারা গিয়েছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা তখন অতিবৃদ্ধ। তাই বলবন মনে করেন, “যেহেতু সামরিক সেবার বিনিময়ে ইকৃতা প্রদান করা হয়েছিল, তাই যেখানে সামরিক সেবা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে ইতা অনুদান বাতিল বলে গণ্য হওয়া উচিত।”

ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানের পর বলবন এক নির্দেশ জারি করে সমস্ত ইকৃতা প্রত্যাহার করে নেন। বিনিময়ে বৃদ্ধ ইকতাদারদের ২০/৩০ টাকা ভাতাদানের ব্যবস্থা করেন এবং সক্ষম ব্যক্তিদের নগদ বেতনের শর্তে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে নেন। সুলতানের এই সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট ইতাদারদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বারাণী লিখেছেন: “তাদের অনুরোধে দিল্লির প্রখ্যাত কোতোয়াল মালিক ফদ্দিন সুলতানের কাছে ওকালতি করেন এবং ফব্রুদ্দিনের যুক্তিতে প্রভাবিত হয়ে বলবন ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন।” অবশ্য হাবিবউল্লাহ লিখেছেন : “এই সময় বলবন কেবলমাত্র বৃদ্ধ ও অশক্ত ব্যক্তিদের ওপর থেকে নির্দেশ প্রত্যাহার করেন; অন্যান্যদের জন্য তা বলবৎ ছিল।”

তুর্কি-আমির ও মালিকদের, বিশেষত ‘তুর্কান-ই-চাহেলগানী’র সদস্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সম্পর্কে বলবন সচেতন ছিলেন। তিনি তুর্কি-অভিজাতদের অবাধ কর্তৃত্বকে সুস্থ প্রশাসন ও রাজতন্ত্রের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তাই এই শাসকগোষ্ঠীকে কর্তৃত্বহীন করার জন্য তিনি নানা ব্যবস্থা নেন। বলবন ইচ্ছাকৃতভাবে তরুণ তুর্কি-যুবকদের দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে নিয়োগ করেন। সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমতাবান আমির মালিকদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কয়েকজনকে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। যেমন মুলতানের শাসক শের খাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা, বদাউনের শাসক মালিক বারবককে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা, বাংলার বিদ্রোহদমনে ব্যর্থতার জন্য আমিন খাঁকে প্রকাশ্যে হত্যা করা ইত্যাদি।

বলবন মনে করতেন, সামরিক বাহিনী যেমন সুলতানের শক্ত বাহু, তেমনি দক্ষ গুপ্তচরবাহিনী সুলতানের প্রখর দৃষ্টিশক্তি বিশেষ। এই দু-এর মিলিত শক্তি স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। তাই বলবন এক দক্ষ গুপ্তচরবাহিনী গঠন করেন। ‘বারিদ’ নামে পরিচিতি এই গুপ্তচরবাহিনীতে শুধুমাত্র সৎ, দায়িত্ববান এবং মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হত। এদের মাধ্যমে রাজ্যের ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সর্বদা সুলতানের গোচরে থাকত। সুলতানের আত্মীয় পরিজন, উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ, আমির মালিকগণ, এমনকি সুলতানের প্রিয় পুত্ররাও ‘বারিদ’ এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে কিছু করতে পারত না। লেপুল লিখেছেন : “বলবনের রাজ্যে এমন কিছুই ছিল না যার খবর বারিদরা রাখত না।” তবে নিয়োগকর্তার সাথে গুপ্তচরদের প্রকাশ্য যোগাযোগকে বলবন প্রশাসনের পক্ষে শুভ মনে করতেন না। একদা তিনি এক পুত্রকে বলেছিলেন, “Informers and spies should not be allowed to come near the court, for thier closeness to the ruler terrifies obedient and trustworthy friends and their confidence in the king-“

পুত্র মহম্মদ এবং বুগরা খাঁ’র সাথে বলবনের মতবিনিময়ের ভিত্তিতে জিয়াউদ্দিন বারাণী তাঁর শাসনতান্ত্রিক আদর্শ ও লক্ষ্যের একটি চিত্র অঙ্কন করেছেন। বারাণীর বিবরণ অনুসারে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলবনের অভিমত হল – (১) সরকারের উচিত রক্ষণাত্মক আইন জারি করা এবং সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের স্বার্থ সুনিশ্চিত করা। (২) সরকারি নির্দেশ যথার্থ মর্যাদার সাথে বলবৎ করা উচিত এবং ঘনঘন সরকারি নীতির পরিবর্তন ঘটা বাঞ্ছনীয় নয়। (৩) সরকারের আচরণ অতি কঠোর বা অতি নমনীয় হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। প্রজার ওপর করের বোঝা এমন বেশি হওয়া উচিত নয় যাতে তার গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব ঘটে; কিংবা এমন হালকা হওয়া উচিত নয় যাতে তার মধ্যে বিদ্রোহপ্রবণতা জাগ্রত হয়। (৪) সেনাবাহিনীর বেতন ও ভাতা নিয়মিত প্রদান করে তাদের সন্তুষ্ট রাখা উচিত। (৫) কৃষি উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে সহায়তা করে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি আনা আবশ্যিক। (৬) সুপরিকল্পিতভাবে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা উচিত। মোট আয়ের অর্ধাংশ ব্যয় করে অবশিষ্টাংশ আপৎকালীন সময়ের জন্য রাখা উচিত। বারাণীর মতে, এই শাসনাদর্শের বাস্তব প্রয়োগ দ্বারা বলবন জনগণকে দীর্ঘকাঙ্ক্ষিত ‘শান্তি ও ন্যায়ের’ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

বলবনের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :

আদি পর্বের সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন নিঃসন্দেহে ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সামান্য ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করে তিনি ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা এবং কর্মদক্ষতার দ্বারা দিল্লির সুলতান পদে উন্নীত হয়েছিলেন এবং সাফল্যের সাথে প্রায় চার দশক কাল সুলতানি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকরূপে অতিবাহিত করেছিলেন। সুলতান পদে বসার আগে (১২৪০-৬৬ খ্রিঃ) বলবন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত থেকে এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহদমনে কিংবা মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে ক্রমশ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। বয়ঃকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র দক্ষতা ও বিচক্ষণতা দ্বারা ‘চল্লিশচক্র’ বা চাহেলগানীর নেতৃত্বে উন্নীত হন। সুলতান হিসেবে তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের রক্ষক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে খোকর প্রভৃতি উপজাতির বিদ্রোহ দমন করে এবং বহিরাগত মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে ও ভবিষ্যৎ আক্রমণ-সম্ভাবনা রোধ করার জন্য সীমান্ত সুরক্ষিত করে তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করেন। তাই ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলবনকে ‘মধ্যযুগীয় ভারত-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব’ অভিহিত করে লিখেছেন : “…a great warrior, ruler and statesmen who saved the infant Muslim State from extinction at a critical time.”ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ আরও মনে করেন যে, বলবন অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত ভারতের মুসলমান শক্তিকে যে নিরাপত্তা ও সংহতি দিয়েছিলেন, তা না হলে আলাউদ্দিন খলজির পক্ষে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা বা নতুন নতুন রাজ্য জয় করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা সম্ভব হত না। ড. হবিবউল্লাহ লিখেছেন যে, বলবনের একটিমাত্র কৃতিত্বই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রাখার পক্ষে যথেষ্ট; তা হল রাজতন্ত্রকে তার প্রকৃত মর্যাদার সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। বিচ্ছিন্নতাবাদী ও শত্রুভাবাপন্ন শক্তিগুলিকে সুলতানির বশীভূত করার সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে বলবন আইবক ও ইলতুৎমিসের অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণতা এনে দেন। ড. হবিবউল্লাহ লিখেছেন : “By consolidating the conquered areas and destroying the forces of anarchy he fulfilled a historical need namely, preparing the Sultnate for further territorial expansion as a next stage of its development.”

অধ্যাপক অবন্তীলাল শ্রীবাস্তব লিখেছেন : “বলবন ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন দৃঢ়চেতা প্রশাসক এবং সফল রাজনীতিবিদ ; তুর্কি অভিজাতদের স্বাধীনতাস্পৃহা দমন করে এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা দ্বারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা বিধান করে তিনি হিন্দুস্তানের শিশু সাম্রাজ্যকে সংহতি দান করেছিলেন।” ড. পি. শরণ মনে করেন, বলবন সমকালীন কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিসমূহকে দমন করে এবং মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে তাঁর পূর্বসূরিদের ত্রুটি থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন।

ঐতিহাসিকেরা বলবনের কৃতিত্বের প্রতি যেমন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তেমনি তাঁর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও উল্লেখ করেছেন। কে. এ. নিজামী, শ্রীবাস্তব, পি. শরণ এমনকি ড. হবিবুল্লাহ্ বলবনের কর্মধারা বিশ্লেষণ করে তাঁর কর্মসূচির মধ্যে দূরদর্শিতার ও বাস্তবতার অভাব লক্ষ্য করেছেন। ড. নিজামী এবং ড. হবিবউল্লাহ মনে করেন, বলবন বংশকৌলীন্যের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে এবং উচ্চ সরকারি-পদে অ-তুর্কিদের নিয়োগ না করে বিরাট ভুল করেছিলেন। বলবন একদা তাঁর পুত্র বুগরা খাঁকে বলেছিলেন : “কখনো দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো না, কারণ দিল্লির সুলতান নিমেষের মধ্যে লখনৌতির বিদ্রোহ দমনে সক্ষম।” কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি। বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুমিলকে দমন করতে দিল্লির লেগেছিল প্রায় ছয় বছর। এই কাজের জন্য অযোধ্যাতে এসে অস্থায়ীভাবে প্রায় দু-লক্ষ সৈন্য তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। তা ছাড়া কোনো শক্তিশালী রাজপুতগোষ্ঠীর সাথে বলবন যুদ্ধ করেননি। কোনো নতুন রাজ্য তিনি সুলতানির সাথে যুক্ত করেননি। এমনকি মোঙ্গলদের বিরুদ্ধেও তাঁর সেনাপতিরা প্রকৃত সাফল্য পায়নি। এর ভিত্তিতে বলা যায়, বলবনের সামরিক শক্তি যথেষ্ট সবল বা উপযুক্ত ছিল না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইসামী লিখেছেন যে, মোঙ্গলদের সাফল্যের কারণ ছিল তাদের সৈন্যের সংখ্যাধিক্য। ড. নিজামী প্রশ্ন তুলেছেন, “বলবন কেন অধিক সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে বিজয়ী হবার চেষ্টা করলেন না?” এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন। তাঁর মতে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে কেবলমাত্র তুর্কি-অভিজাতদের নিয়োগ করার ফলে দেশীয় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে সৈন্য সংগ্রহ করার সুযোগ কমে গিয়েছিল। তাই এই বিপত্তি। ড. নিজামী লিখেছেন যে, বলবন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। ড. হবিবউল্লাহও বলবনের এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন : “He considered himself more the custodian of Turkish sovereignty than a king of the Musalmans.” তুর্কিদের সার্বিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে বলবন ইলতুৎমিসের আদর্শকে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি যে, ইতিমধ্যে বহু ভারতীয় ইসলামধর্ম গ্রহণ করে এবং ফারসি ভাষায় শিক্ষা নিয়ে নিজেদের প্রশাসনের উপযুক্ত করে তুলেছেন। কিন্তু বলবনের তীব্র অ-তুর্কিবিদ্বেষ এবং ঘৃণা এই নতুন মুসলমান সম্প্রদায়কে তুর্কিবিরোধী করে তোলে, যার পরিণতি ঘটে খলজি বিপ্লবের মাধ্যমে। এইভাবে তুর্কি অভিজাতদের প্রতি তাঁর অকারণ কঠোর আচরণ এই শাসকগোষ্ঠীর মনোবল এবং ঐক্যে ভাঙন ধরিয়ে দিল্লি সুলতানির তুর্কি-আধিপত্যের মুল্যেই কুঠারাঘাত করেছিল। শের খাঁ কিংবা আমিন খাঁর মতো দক্ষ সেনানায়কদের বিষপ্রয়োগ করে কিংবা প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করে বলবন আদৌ ন্যায়বোধের পরিচয় দেননি, মানবিকতার তো নয়ই। নানাভাবে দক্ষ তুর্কি-আমির ও মালিকদের শক্তি খর্ব করার জন্যই বৃদ্ধ এবং দুর্বল জালালউদ্দিন খলজির মতো ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে সফল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন। ড. নিজামী যথার্থই লিখেছেন : “Balbans responsibility for the full of the Turkish power in India cannot be denied-his attitude towards the Turkish nobility crippled it and reduced its life-span.”.

ড. নিজামী এবং ড. হবিবউল্লাহ মনে করেন, সুলতান বলবনের রাষ্ট্রপ্রজ্ঞার অভাব ছিল। অন্ধ জাতিচেতনা তাঁর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখার ফলে তিনি দেশে-বিদেশে সংগঠিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি দেখতে পাননি। ভারতে বহুসংখ্যক হিন্দুর ইসলামধর্ম গ্রহণ এবং অসবর্ণ বিবাহের ফলে যে অখণ্ড (integrated) ইন্দো-মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল, তাকে তিনি অচ্ছুত করে রেখে দেন। অন্যদিকে মধ্য-এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণ ঘটার ফলে সেখান থেকে ভারতে তুর্কিদের আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় প্রশাসনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা বলবনের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাই তাঁর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এদেশে তুর্কি-আধিপত্যের অবসান ঘটে।

অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, বলবন শাসনক্ষেত্রে কোনো মৌলিকত্বের পরিচয় দেননি। নিজামী লিখেছেনঃ “পুলিশি দায়িত্ব পালন করে বলবন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করলেও এমন কোনো গঠনমূলক আইন তিনি রচনা করেননি, যা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখতে পারে।” অধ্যাপক শ্রীবাস্তব লিখেছেন : “Balban was not a constructive genius.” এই অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। বলবনের শাসননীতিতে কোনো উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ মেলে না। সামরিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে তিনি কোনো নতুন প্রতিষ্ঠান কিংবা নতুন আইন প্রণয়ন করে মৌলিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেননি। বলবন ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক ছিলেন; কিন্তু তাঁর মধ্যে ধর্মসহিষ্ণুতার অভাব ছিল। আমির খসরু, আমির হাসানের মতো কবি-সাহিত্যিক তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন ঠিকই, তবে সাহিত্যের অঙ্গনকে সমৃদ্ধতর করার জন্য তিনি উদ্যম বা অর্থব্যয় করেননি।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, বলবনের মধ্যে দক্ষতা ও সীমাবদ্ধতার সমন্বয় ঘটেছিল। তবে যে যুগে এবং যে পরিস্থিতিতে তিনি একটি শিশু-রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তখন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিল প্রধান কাজ। এবং তিনি অবশ্যই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করেছেন। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং সীমান্তের নিরাপত্তা বিধান করে তিনি যুগের দাবি মিটিয়েছেন। এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দিল্লি-সুলতানির রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে তাকে সংহত ও নিরাপদ করার প্রতি মনোযোগী হয়ে প্রখর বাস্তববোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাই বলা চলে, তাঁর ভ্রান্তনীতির ফলে তুর্কিজাতির স্বার্থ হয়তো ক্ষুণ্ন হয়েছিল; কিন্তু দিল্লি-সুলতানির ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল। তাই দিল্লি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হিসেবে আলাউদ্দিন যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তার ভিত্তি বলবন তৈরি করেছিলেন—এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।