‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি নিজের সম্বন্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাবদিহি করতে গিয়ে নিজেকে বর্তমানকালের অর্থাৎ সমসাময়িক যুগ ও বিষয়ের ভাষ্যকার কবি বলে অভিহিত করেছেন। যারা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন, সমসাময়িক কালের সমস্যা তাঁদেরই পীড়িত করে। সমস্যা-পীড়িত মনের ভাবনা তাঁরা তাঁদের কথায় লেখায় তুলে ধরেন। অবশ্য এই সমসাময়িক সমস্যা-সম্পর্কিত রচনা সাংবাদিকতা জাতীয় রচনার পর্যায়েই পড়ে এবং কাব্য কবিতার মধ্যে এই লক্ষণ দেখে অনেকে কবি-সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং কবি ছান্দসিক সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনেক কবিতাকে সাংবাদিকতার লক্ষণযুক্ত এবং সমসাময়িক প্রসঙ্গের কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবি নজরুল ইসলামও নিজেকে বর্তমানের কবি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি নজরুলের অনেক কবিতাতেই প্রধান স্থান গ্রহণ করেছে। তিনি দেশের অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে চাইছেন। কাব্য স্পন্দনে ধরতে চেয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আশঙ্কায় গড়া হৃদস্পন্দন।
‘নবী’ অর্থে সত্যদ্রষ্টা, পয়গম্বর, ঈশ্বরের বাণীবাহক। ‘ভবিষ্যতের নবী’ অর্থে ভবিষ্যতের বার্তাবাহক এবং সত্যদ্রষ্টা। অনেক কবির কল্পনা ও রচনায় ভবিষ্যৎকালের সত্য দর্শনের ছায়াপাত ঘটে। কল্পনার আলোকে কবিগণ ভবিষ্যতের চিত্র দর্শন করেন। আগামী যুগদ্রষ্টা বা শাশ্বতকালের বাণীর বার্তাবহ, এই জাতীয় কবিদেরই ‘ভবিষ্যতের নবী’ বা মহৎ কবিৰূপে কবি উল্লেখ করেছেন। কবি নজরুল ইসলাম নিজেকে এই জাতীয় ভবিষ্যৎ যুগদ্রষ্টা, মহৎ কবি বলে মনে করেন না। তিনি মনে করেন শাশ্বত কালের বাণী শোনানোর মত মহৎ কল্পনাও তার নেই।
তিনি তাঁর সীমিত শক্তি নিয়ে তাঁর সমসাময়িক কালের সাধারণ মানুষের অব্যক্ত ক্ষোভ ও দুঃখ এবং এইসব অসহায় মানুষের ওপর ন্যায় ও শাসনের নামে যে অনাচার, অত্যাচার ও শোষণ চলছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারলেই খুশী হবেন। তাই মানুষের দুঃখে বিচলিত কবি নজরুল তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে মুখর হতে চাইছেন। দেশের ক্ষুৎপীড়িত দরিদ্র মানুষের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মচেতনা, সমাজচেতনা ও রাজনৈতিক মতবাদ নিয়েও কবি তাঁর বক্তব্যকে উপস্থিত করেছেন। দেশের ভণ্ড মানুষের মুখোশ খুলে দেবার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে কবির মানব-দরদী, সংবেদনশীল মনের পরিচয়ই পাই এবং কবি তাঁর কাব্যজীবনে এই দায়িত্ব পালন করেই তৃপ্ত। তিনি তৃপ্ত বর্তমানের ‘কবি’ হয়েই।
‘প্রভাতের ভৈরবী’ কথাটি অর্থবহ। ভৈরবী প্রভাতের রাগিণী, এর সুরে ধ্বনিত হয় প্রভাতের বন্দনা। কিন্তু প্রভাত বন্দনা বা প্রভাতের ভৈরবী রূপক অর্থেই কবি গ্রহণ করেছেন। পরাধীন ভারত যেন ভারত ভাগ্যাকাশে অমারাত্রি। দেশের বুকে সংঘটিত শাসক ও শোষক দলের অত্যাচার, অনাচার এই অমারাত্রিকে আরো সংকটময় করে তুলেছে। অমারাত্রির এই সংকটের অবসানে প্রভাতের নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণমুক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্নে বিভোর চারণকবি নজরুল যেন প্রভাতের, নবগৌরবে গরীয়ান ভারতের আগমনী সংগীত, প্রভাতী সংগীত গেয়ে চলেছেন। ‘প্রভাতের ভৈরবী’ কথাটি এই ইঙ্গিতময় অর্থেই গৃহীত। এই উক্তির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক নজরুলের উত্তপ্ত হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। তবে একটি কথা এখানে অবশ্যই স্বীকার্য। এক্ষেত্রে কবি নজরুলও তো স্বপ্নদ্রষ্টা। দুর্যোগের অমারাত্রির শেষে উজ্জ্বল প্রভাতের কল্পনা তাঁর দৃষ্টিকে সমসাময়িকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করে তুলেছে, কবিকে করেছে আশাবাদী, প্রত্যাশাবাদী। কাজেই তিনি এখানে শুধু বর্তমানের কবিই নন ভবিষ্যতের কবি।
Leave a comment