উত্তর : আলোচ্য অংশটি বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডের ২ নং পদ থেকে চয়ন করা হয়েছে। এখানে বিরহী রাধার হৃদয়যন্ত্রণার কথা চমৎকার বাণীভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন কবি।

বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনায় অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা কামাসক্তা ও সম্ভোগলিন্স। কৃষ্ণ লম্পট, কপট, নির্মম, নির্লজ্জ ও দায়িত্বহীন-তার কথা ও আচরণ স্কুল ও অশ্লীল। তবে, চণ্ডীদাস যে যুগের মানুষ ছিলেন, সে যুগের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে কাব্যটি তত অশ্লীল ও অমার্জিত নয়। বড়ু চণ্ডীদাস সে যুগের বাংলা ভাষার অমার্জিত রূপ, রুচি ও ইঙ্গিতকে তাঁর রচনায় নিজ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর’রাধাবিরহ’ খণ্ডটি স্বকীয়তায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড প্রভৃতি গাইতে গাইতে তিনি বাকদেবীর কৃপায় আশ্চর্য মন্ত্র যে শিখে ফেলেন। সেই মন্ত্রের মোহিনীতে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডটি আশ্চর্যরূপে উপাদেয় হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণের বাঁশী রাধাকে আনমনা করে তোলে। কৃষ্ণের বাঁশী রাধার হৃদয়ে অস্থিরতার ঝড় তোলে। আগুনে বন পোড়ে, জগতের লোক সেটা জানে। কিন্তু রাধার মন পোড়ে কুমোরের পণীর মত। সে গোপন হৃদয় যন্ত্রণার কথা কেউ জানতে পারে না। সে আগুন কুমোরের পণীর মতই গোপন ও পীড়াদায়ক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষায় রয়েছে অপরিণতির উষ্ণ কাঠিন্য, কাহিনিতে আছে জীবনাচারের স্থূল গতানুগতিকতা, কিন্তু তারই গভীরে অনির্বচনীয় প্রেমবেদনার ফল্গুধারাটির অনুভবনীয় ব্যঞ্জনা লাভ করেছে কবিচেতনার সহৃদয়তার স্পর্শে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরিকল্পনার মূলে আছে অনভিজাত লোক-প্রণয়মূলক রাধাকাহিনিকে অভিজাত পৌরাণিক মননমণ্ডিত রূপাধারে উপস্থিত করার প্রাথমিক চেষ্টা। জগৎ সংসারের নরনারীর প্রেমময় হৃদয়ের কামনাবাসনার প্রতিফলনে বিশিষ্ট করে বড়ুচণ্ডীদাস তাঁর বিস্ময়কর কবিপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে কবির ভাষা হয়ে উঠেছে অশ্লীলতাবর্জিত ও মানবহৃদয়গ্রাহী। উপরিউক্ত পঙক্তিতে যন্ত্রণাদগ্ধ রাধার হৃদয়-অভিব্যক্তি অসাধারণ বাণীমূর্তি লাভ করেছে।