রবীন্দ্রসাহিত্যে বনোয়ারিলাল বিশেষত্বহীন হয়েও বিশেষত্বপূর্ণ। বিশেষত্বহীন বলবার কারণ গল্পে কিরণলেখার প্রণয়মুগ্ধ স্বামী হিসাবে তাকে দেখতে পাই, বিস্তৃত মানবপরিচয়ে তাকে অল্পই দেখতে পাওয়া গেছে। তার শরীর ও মনের গড়ন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে লেখক অনেক বিবৃতি দিয়েছেন, কিন্তু গল্পে এক তার প্রেমিক সত্তা ছাড়া অন্য সত্তার উজ্জ্বল পরিচয় ফুটে ওঠেনি। তার মনের কোমলতার দিকটি যত ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে ফুটে উঠেছে তার শরীর-মনের অন্যান্য দিকের পরিচয় তত ফুটে ওঠেনি। রবীন্দ্রসাহিত্যে জমিদারপুত্রের অভাব নেই, তাদের মনের জগৎ ছাড়া কর্মজগতেরও পরিচয় আমরা পেয়েছি। বলতে চাচ্ছি যে, বনোয়ারির তেমন কোনো activities-এর খবর পাইনা গল্পে। নষ্টনীড়ের ভূপতিও সে নয়, ভূপতির পত্রিকা সম্পাদনা সভাসমিতি ইত্যাদির সঙ্গে যে নিবিড় সংস্রব ছিল, তার তেমন কাজ নেই। ঘরে বাইরের নিখিলেশের মতোও নয় সে, প্রজাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গল্পে বিস্তারিত হয়ে প্রকাশ পায়নি। তার মধুকৈবর্তের জন্য মাথাব্যথা প্রজাহিতৈষণা বা সমাজসেবার অন্তর্গত বলে বিবেচিত হতে পারে না। তবে বিধবার ঘর পুড়ে যাওয়ার ঘটনার তার ছুটে যাওয়া সেই পরিচয়ের অন্তর্গত বলে ধরে নেওয়া যেতে পারত, পাঠক বুঝতে পারেন গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে লেখক কাহিনিকে নিছক মোড় দেওয়ার এবং পরিণতিতে পৌঁছে-নিয়ে-যাওয়ার প্রয়োজনে তাকে দিয়ে এই অসাধ্যসাধন করিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

আসলে গল্পটির যত ডালপালা পল্লবপত্র থাক, মূলত গল্পটি বনোয়ারিকে নিয়ে এবং বনোয়ারির প্রেম, সেই প্রেমের পেলবতা, সেই প্রেম নিয়ে তার নিজস্ব কল্পজগতের সৃষ্টি, সেই কল্পজগৎ থেকে তার ক্রম-অবরোহণ এবং পরিশেষে বোধোদয় ও আত্মিক নৈরাশ্য, পরিশেষে নিজেকে নিয়ে পলায়ন এসবের সাহায্যেই বনোয়ারি-চরিত্রকে গেঁথে তোলা হয়েছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পে যে ‘ব্যক্তিত্বের বিদ্রোহ’ দেখেছেন তা খানিকটা সত্য হতে পারে, কিন্তু মূল বিষয় নয়। পিতৃতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র যা-ই বলা যাক, তার বিরুদ্ধে বনোয়ারির বিদ্রোহকে সঠিকভাবে বিদ্রোহ বলে স্বীকার করা বোধহয় ঠিক হবে ন। কেননা, বনোয়ারি জমিদারের কোনো অন্যায় কাজের বা প্রজাবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি, এনিয়ে কোনো সংগঠন গড়ে তোলে নি, সংঘাত তো ঘটেই নি। সুতরাং একে ঠিক ‘ব্যক্তিত্বের বিদ্রোহ’ বলা যায় না। বনোয়ারি পিতৃতন্ত্র বা জমিদারতন্ত্রের যেটুকু বিরুদ্ধাচারণ করেছে তার মূলে এক নারী, সে তার স্ত্রী কিরণলেখা। এই কিরণলেখা তার আবিষ্কার, আত্ম-আবিষ্কারও বলা যায়। এই কিরণলেখাকে সে কখনো চোখে দেখে নি, ঘর করা তো দূরের কথা। কিরণলেখাকে পেয়েছে কালিদাসে, অমরুশতকে—বিভিন্ন সংস্কৃত কাব্যে। সে-নারী রোমান্টিক কাব্যজগতের দেবদূতী, মর্তের ধূলিবালিকা নয়। তার মনোযোগ ও মুগ্ধতা আকর্ষণের জন্য প্রধান চেষ্টায় কার্যক্ষেত্রে মধুকৈবর্তের পক্ষ নিয়ে তাকে পিতৃবিরোধে লিপ্ত হতে হয়েছে। তার ফল ভালো হয়নি। তার অস্তিত্বের, তার পরিণতির পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর হয়েছে। পরিশেষে যখন তার রোমান্টিকসত্তার চূড়ান্ত অবমাননা ঘটেছে, তার প্রেম নাজেহাল হয়েছে, তখন সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ‘হৃদয়বিহারিণী’ কল্পনালতাকে তন্বী বলে তখন আর মনে হয়নি, তার ‘মোটা’ত্ব স্থূল চোখে ধরা পড়েছে, এবং কিরণলেখা যে হালদারগোষ্ঠীর বড়ো বউয়ের ভূমিকায় হালদারগোষ্ঠীর সত্তায়লীন হয়ে গেছে তাও বুঝতে পেরেছে। তারপর তার আর কিছু করার থাকে না। ফলে নিজেকে নিয়ে নতুন কোনো ব-দ্বীপের সন্ধানে পলায়নপর হতে হয়। অবিশ্যি, নারীর সৌন্দর্যসত্তায় যে পুরুষ অন্ধভাবে বিশ্বাসবান, তার স্থূল বাস্তব‌ সত্তা সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞান, তার পরিণতি যে ট্র্যাজেডি নাটকের নায়কের মতো হবে। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বনোয়ারির ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন?