নায়কের নাম বনবিহারী, ওরফে বনওয়ারী। কাহিনিতে সে পঞ্চাশাের্ধ হলেও প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। সংরাগ আর সংযমের টানাপােড়েন এক ঔৎসুক্যজনক চরিত্র। পিতৃপুরুষের পরম্পরাই শ্রেয় এবং তার থেকে বিচ্যুতি পাপ—এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েছিল বনওয়ারী। আপ্তবাক্যে কুলকর্মে এবং গােষ্ঠীদেবতার প্রতি তার ভক্তি ও নিষ্ঠার আন্তরিক। গােষ্ঠী ও গাঁয়ের মঙ্গল তার ধ্যান-জ্ঞান-কর্ম, তার পুরুষার্থ। ওই পুরুযার্থের সাধনায় সে যথাসাধ্য একাগ্রচিত্ত। কিন্তু একমুখীনতা তাকে স্থায়ী ভাবমূর্তি করে তােলেনি। ব্যক্তিগত সাধ ও স্বার্থ যখন তাকে বিপরীত দিকে টেনেছে তখন সে আত্মশাসনের আন্তরিক হতে চেষ্টা করেছে। সে-চেষ্টায় সবসময় সফল না হলে ও মাতব্বর হিসেবে সে যেমন আদর্শ, তেমনি তাকে মনে হয় এক সজীব স্বভাবী মানুষ সংকটকালে, এমনকি সর্বনাশের মুখােমুখি দাঁড়িয়েও সে অবিচল নিষ্ঠায় ও দৃঢ়তায় পরম্পরাকেই আশ্রয় করেছে। তার জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য ও বিশ্বাসের বিপরীত এক অভিনব বিশ্ববিধানের কাছে সে পরাজিত হয়েছে। পরাজয় ও সে ট্র্যাজেডির নায়কের মতাে মহিমান্বিত। দুটি ট্র্যাজেডি ঘটেছে তার জীবনে। এক, সে আদর্শ মাতব্বর হয়েও এবং শত চেষ্টা করেও গােষ্ঠীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। দুই ঘরে বাইরে সে করালীর কাছে পরাজিত হয়েছে। প্রথমটির মতাে দ্বিতীয় পরাজয়ও এক অর্থে বিশ্ববিধানের কাছেই। তবে ভিন্ন সেই বিধান।
যৌবনের দুঃসাহস সৃজনশীলতা ও উদ্দাম প্রেমের প্রতিমুখে ধর্মভীরু সন্ত্রস্ত প্রৌঢ়ের প্রতিরােধ যে ভেঙে পড়ল, পরাজিত হল সন্ধিগ্ধ প্রেম, তা বিশ্ববিধান ছাড়া কী ? পরম্পরা ও পরিবর্তনের মধ্যে সে নির্বিচারে পরম্পরাকে আশ্রয় করে পরাজিত হল। তার রক্ষণশীল মন কালের ছন্দে কান পাততে চায়নি, গােষ্ঠী জীবনের কালােপযােগী পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি। অথচ এই প্রবীণই তার যৌবনকালে পরিবর্তনের প্রতি একান্তভাবে বিমুখ ছিল না। কাহারেরা আগে মরা কুকুর-বেড়াল-গরু ফেলত নর্দমা পরিষ্কার করত। মাতব্বর বনওয়ারীর হুকুমেই একদা তারা পরম্পরা ভেঙেছিল। কিন্তু পরবর্তী জীবনে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হবার নমনীয়তা তার ছিল না। সে সকল পরিবর্তনের বিরােধিতা করেছে, যা প্রথাগত নয় ও নতুন তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগঠিত করেছে ভয়ে, আশঙ্কায় ও উদ্বেগে। আর্থ-সামাজিক চাপে কাহারদের জীবনে যখন পরিবর্তন কাম্য ছিল, তখনও পিতৃপুরুষের পরম্পরাকে আঁকড়ে ধরে থাকার সে ঘরে বাইরে পরাজিত হল। আশ্চর্য, তার কমল বিশ্ববিধান অনুযায়ী ও এই পরিণাম ভবিতব্য ছিল। দুই পরস্পর-বিরুদ্ধ বিশ্ববিধানের একই পরিণাম।
কর্তার বাহন সাপটিকে করালী পুড়িয়ে মারলেও বনওয়ারী নিঃসন্দেহ ছিল যে পাপ সমগ্রভাবে সমাজের। তার নিজের দায় যে সকলের থেকে বেশি ও বিশেষ, এ বিষয়ে ও তার মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না। কারণ, মাতব্বর হয়েও সে করালীকে দণ্ড দেয়নি, উল্টে তাকে ক্ষমা করেছিল। সৰ্পদহনের পর থেকে এই পাপবােধে সে পীড়িত হয়েছে এবং এই বােধ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠে তার সকল চিন্তা ও কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর এক পাপের বােধ, কালােশশীর সঙ্গে অবৈধ সংসর্গ থেকে তার উদভব। উভয় পাপেরই দণ্ড যেন কর্তা দিয়েছেন। একের পর এক দণ্ড সে পেয়েছে। সাপ কালােশশীর প্রাণ নিয়েছে। চড়কের পাটায় উঠেও বনওয়ারীর প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ হয়নি। মাত্র তিন দিনের জ্বরে হঠাৎ গােপালীবালা মরেছে। করালীর প্রহারে ও পদাঘাতে তার চরম লাঞ্ছনা ও অপমান হয়েছে। সুবাসী তাকে রােগশয্যায় ফেলে রেখে তার সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে গেছে সেই করালীরই কাছে যাকে সে ছেলের মতাে আপন করে নিতে চেয়েছিল।
সরল কিন্তু এক সার্থক যৌগিক চরিত্র বনওয়ারী। ধর্মভীরু, শ্রমশীল ও সহিষ্ণু ; সকল প্রকার প্রথাগত কর্তৃত্বের একান্ত অনুগত। কাহিনির শুরু থেকে সে পরিণত মন ও ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল।
আরও এক ব্যক্তিগত মাত্রা আছে তার চরিত্রে। সে হল করালীর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রশ্রয় ও প্রত্যাখ্যানে, স্নেহে ও সংঘর্ষে সকরুণ। করালীর বুদ্ধি, শক্তি ও সাহস তাকে মুগ্ধ করেছে। সংঘর্ষের গ্লানি ভুলে সে প্রকাশ্যে তার তারিফ না করে পারে নি। গুরুতর অপরাধে ওতাকে গুরুদণ্ড দেওয়া তাে দূরের কথা, নামমাত্র দণ্ড দিতে পারেনি, বরং ক্ষমা করেছে অপত্য স্নেহ। কারণ— বনওয়ারীর মনের মধ্যে একটি সাধ হয়। করালীকে নিয়ে সাধ। সে জেনেছে, বেশ বুঝেছে। এই ছোঁড়া থেকে হয় সর্বনাশ হবে কাহার পাড়ার, নয় চরম মঙ্গল হবে। সর্বনাশের পথে যদি ঝোঁকে তবে কাহার পাড়ার, অন্য সবাই থাকবে পেছনে লাগতে লাগবে তার সঙ্গে। সে পথে করালী গেলে বনওয়ারী তাকে ক্ষমা করবে না। তাই তার ইচ্ছা তাকে কোলগত করে নেয়, তার ‘পুত্র’ সন্তান নাই। ডান হাত থেকে বঞ্চিত করেছেন ভগবান। বনওয়ারীর ইচ্ছা, বিধাতা যা তাকে দেন। নেই নিজের কর্মফলের জন্যে—সে তা এই পিথিমীতে অর্জন করে। তাই তার মনে খুঁত খুঁত করলেও এবং চাপা সমালােচনা হলেও সে নয়নের ঘর ভেঙে পাখির সঙ্গে করালীর বিয়ে দিয়েছে। অবশ্য আর ও একটা কারণ আছে। সে কারণটা তার মনই জানে, আর কেউ জানে না। কালােশশীকে সে যে ভালােবাসে। সে ভালােবাসা তার মনের মধ্যে কুল কাঠের আগুনের মতাে ধিকি ধিকি জ্বলছেই জ্বলছেই। তাদের ও তাে সেই ভালােবাসাই এই স্নেহ ও সহানুভূতি থেকে ব্রাত্য করালীকে সে আশ্রয় দিয়েছে এবং সহ্য করেছে তার একাধিক অনাচার, ঔদ্ধত্য ও স্বৈরাচার।
আরও এক গৃঢ় কারণ ছিল। করালী ও পাখির বিয়েছে আপত্তি করার নৈতিক জোর তার ছিল না। সেই জোর সে হাবিয়ে ফেলেছিল তা আগেই, যেদিন কর্তার থানে সন্ধ্যায় ধুমুল দিতে গিয়ে কালােশশীর আকুল আমন্ত্রণে সে আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। প্রেম তাকে সেই পাপেই প্রবৃত্ত করেছিল যা সে প্রতিহত করতে চেয়েছিল প্রাণপণে। কিন্তু নীতিভ্রষ্ট প্রেমিক ভিন্ন যুক্তিতে কালােশশীর অপঘাত মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করে কীভাবে আত্মপ্রবঞ্চনা করেছিল তা অনুধাবন করা দরকার। কেননা, প্রধানত সেই কারণেই তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে ওঠে- “বাবার বাহন-বাবার বাহনই তাকে দহের বুকে ডুবিয়েছে সে চোখে দেখেছে। করালীর পালেই মরল কালোবউ।” যে যতই বলুক, বনওয়ারী জানে, কালে। বউয়ের সঙ্গে তার ‘অঙ্গে’র খেলার অপরাধ বাবাঠাকুরের কাছে বড় পাপ নয়। অজ্ঞান কাহারদেয় এ অপরাধ ধরেন না বাবা। বাবাঠাকুরের কাহারদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক—তিনি বােঝেন যে কাহারদের আঙের খেলা ছাড়া আর কোনাে মন ভুলানো খেলা নাই। বাবাঠাকুরের কাছে প্রধান অপরাধ করেছে করালী। সেই বাহনটিকে পুড়িয়ে মরেছে। তাঁর শিমূলবৃক্ষে বারবার উঠে তার ঘুমের ব্যাঘাত করেছে। করালী-ই আবার কাহার পাড়াকে যুদ্ধে যেতে বলেছে। অসুখের মধ্যে এইসব ভাবনা ভাবতে গিয়ে বনওয়ারী একটি নতুন সত্য পেয়েছে। বাহনের শিসের মানে বুঝেছে। শিস দিয়ে দিয়ে সাবধান করে দিচ্ছিলেন হাঁসুলী বাঁকের কাহার কুলকে- সাবধান।
ট্র্যাজেডিতত্ত্বের ভাষায় যদি বলি তবে, বনওয়ারীর পরিণাম তার কৃতকর্মের ও বিচা-বিভ্রমের হল। কী ভয়ংকর করুণ সেই পরিণাম। আত্মবিস্তৃত প্রেমিক কালােশশীর মৃত্যুতে সংবিং ফিরে পায়নি, সংযত হয়নি শোকেও, সুবাসীর মধ্যে কালােশশীর হায়া দেখতে গেয়ে সুখ হয়েছে। পরিণামে মান ও প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। সে পরাজিত হয়েছে যার কাছে। যার প্রেমে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে, সে তার অজাত পুত্রের সমবয়সী, একদা তাকে কোলে টেনে নিয়েই পুত্রহীন হৃদয়ের শূন্যতাকে সে পূরণ করতে চেয়েছিল। আশ্চর্য, তারই প্রহার ও পদাঘাত সর্বজনমান্য বৃষস্কন্ধ মাতব্বরকে পৌছে দিয়েছে মৃত্যুর দরজায়। এই পরিণামের স্মরণীয় মূল্যায়ন করেছেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ “অপরাধের এমন অমােঘ, ন্যায়দণ্ডমূলক শাস্তি, নিয়তির এরূপ সূক্ষ্ম বিচার—রহস্য এক গ্রীক ট্র্যাজেডি ছাড়া অন্য কোনাে সাহিত্যে এত মর্মান্তিক ভাবে প্রকটিত হয় নাই ও পাঠকের, মনে দৈববিধানের প্রতি এরূপ ভীতমিশ্র, অথচ ন্যায়ানুমােদিত স্বীকৃতি জাগায় নাই।”
Leave a comment