প্রশ্নঃ বড়ু চণ্ডীদাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়ির গোয়ালঘর থেকে বড়ু চণ্ডীদাসের একখানি কাব্য খুঁজে পান এবং ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বড় চণ্ডীদাসের নবাবিষ্কৃত কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রকাশিত হয়। এই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড় চণ্ডীদাস। তার এ কাব্যটি মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের কিছু অংশ খণ্ডিত বলে কবির আবির্ভাবের স্থান-কাল সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। গবেষকরা বিভিন্ন উপায়ে কবির জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার ছাতনা অথবা বীরভূম জেলার নানুর বলে অনুমান করেছেন। বসন্তরঞ্জন রায় কবির জন্ম ১৪০৩, ১৪১৭ বা ১৩৮৬ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর মতানুসারে কবির জীবনকাল ১৩৭০ থেকে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচনাকাল নিয়েও বিতর্ক আছে। ড. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে কাব্যটি চৌদ্দ শতকের প্রথমার্ধে লিখিত। ড. রাধা গোবিন্দ বসাকের মতে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

বড়ু চণ্ডীদাস প্রাকচৈতন্য যুগের কবি। তিনি পুরাণাদি, গীতগোবিন্দ এবং লৌকিক ভাব ভাবনার সংমিশ্রণে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্য সীমাবদ্ধ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ভিতরে কবি বড় চণ্ডীদাস ভণিতা বহুবার ব্যবহার করেছেন ৷ বড়ু চণ্ডীদাস শক্তিদেবী বাশুলীর সেবক ছিলেন। ভাগবত প্রভৃতি পুরাণের কৃষ্ণলীলাবিষয়ক কাহিনীকে সামান্য অনুসরণ করে, জয়দেবের গীতগোবিন্দের বিশেষ প্রভাব শিরোধার্য করে এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণবিষয়ক অমার্জিত গ্রাম্য গালগল্পের উপর ভিত্তি করে বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনা করেন। নাটকীয় ধরনের এ কাব্যের সাহিত্য গুণ অতি চমৎকার। একমাত্র কৃষ্ণ চরিত্র বাদ দিলে কবি অন্যান্য চরিত্রাঙ্কনে অশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ভাষা ভঙ্গিমা, চরিত্র রূপায়ণ, বিচক্ষণতা, কাহিনীর বাঁধুনী ও নাটকীয় চমৎকারিত্বের বিচারে বড় চণ্ডীদাস কবি হিসেবে অনন্য। বড় চণ্ডীদাসই বাংলাদেশে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রথম কাহিনীকাব্যের কবি। অনেকেই বড়ু চণ্ডীদাসের গ্রাম্য স্থুল রুচির নিন্দা করেন। বড় চণ্ডীদাস আদিরসের কাব্য নির্মাণ করতে গিয়ে আদিরসঘটিত বর্ণনা দিতে পিছপা হন নি। এখানেই তিনি সফল। তাছাড়া সংস্কৃত ও অন্যান্য পুরাতন প্রাদেশিক সাহিত্যে আদিরসঘটিত কাহিনী বর্ণনার সমকালে শ্রীলতার বাঁধন না মানাই স্বাভাবিক সর্বোপরি চড় চণ্ডীদাস মধ্যযুগের হয়েও জীবনমুখী ও মানবিক কবি।