বজ্রপাত
বজ্রপাত । Image Source: Wikipedia


বজ্রপাত কি?

ঝড় বৃষ্টির সময় একটি সাধারণ ঘটনা হল বজ্রপাত বা বিদ্যুৎ চমকানো। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি আর গুড়গুড়ে শব্দের বজ্রপাত বেশ ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

তবে বৃষ্টি না হলেও অনেক সময় আকাশে প্রচণ্ড মেঘ জমে এমন বজ্রপাত শুরু হতে পারে।

মূলত বজ্রপাত হল মেঘের বৈদ্যুতিক চার্জিত অঞ্চল থেকে হঠাৎ  চার্জ নিঃসরণ। এই চার্জ নিঃসরণ মূলত মেঘ ও ভূমির মধ্যকার বা পাশাপাশি দুই মেঘের মধ্যকার চার্জের তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ সময়েই বজ্রপাত মূলত মেঘে মেঘে ঘটে থাকে। খুব কম বজ্রপাতই মেঘ ও ভূমির মধ্যে ঘটে থাকে। যে কোন বজ্রপাতের সময় প্রথমে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি তৈরি হয় এবং এর পর বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ আমরা শুনতে পাই। তবে এখানে আমাদের মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে, যেমন মেঘে এই বৈদ্যুতিক চার্জ কিভাবে আসে কিংবা এই চার্জের নিঃসরণে কিভাবেই বা এত আলো ও শব্দের উৎপত্তি হয়। আজকে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

বজ্রপাত কেন হয়?

আমরা জানি বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘ উৎপন্ন হয়। বায়ুমণ্ডলের উপাদান গ্যাসসমূহের মধ্যে রয়েছে জলীয়বাষ্প। এছাড়াও ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠতে থাকে। এসকল জলীয় বাষ্প অধিক উচ্চতায় তাপমাত্রা কম থাকার কারণে ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে এবং মেঘে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে মেঘে প্রচুর বৈদ্যুতিক চার্জ বা আধান উৎপন্ন হয় এবং মেঘে জমা হতে থাকে। জমা হতে থাকা এই চার্জ বা আধান এর আকস্মিক প্রবাহের ফলে বজ্রপাত হয়ে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটি ভালভাবে বোঝার জন্য আমাদের জানতে হবে কিভাবে বজ্রপাত ঘটে থাকে।

বজ্রপাত
বজ্রপাত | Image Sourece: Unsplash

বজ্রপাত কিভাবে ঘটে?

আমাদের অধিকাংশেরই বজ্রপাত নিয়ে রয়েছে ভুল ধারণা। ছোটবেলা থেকে আমরা অনেকেই জেনে এসেছি যে মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বজ্রপাত হয়। এই ধারনাটি সম্পূর্ণই ভুল। মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বজ্রপাত ঘটে না। বজ্রপাত ঘটে পাশাপাশি দুই মেঘ বা ভূমির সাথে মেঘের চার্জের তারতম্যের কারণে।

বজ্র-মেঘের মধ্যে শীতল বায়ু ও উষ্ণ বায়ুর বিপরীত মুখী একটি প্রবাহ তৈরি হয়। এই দুই ধরনের বায়ু উর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়। উষ্ণ বায়ু উর্ধ্বমুখী হয়ে থাকে এবং এতে থাকে পানি কণা। আবার শীতল বায়ু নিম্নমুখী হয় এবং এতে থাকে বরফ ক্রিস্টাল। এরূপ প্রবাহের ফলে পানির কণা ও বরফ ক্রিস্টালের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। ফলে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ উৎপন্ন হয়।

বজ্রপাত
বজ্রপাতের প্রক্রিয়া । Image Source: Britannica

এমন স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার ঘটনা আমরা কিন্তু হরহামেশাই দেখে থাকি। যেমন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে তা যদি ছোট ছোট কাগজের টুকরার নিকট ধরা হয় তাহলে তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করবে। কারণ চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনিতে স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হবে এবং নিস্তরিত কাগজের নিকট নিয়ে আসলে পরস্পর বিপরীত আবেশ তৈরি হয়ে পরস্পরকে আকর্ষণ করবে। প্রাচীনকালে মানুষ যখন অ্যাম্বারকে পশমের সাথে ঘষা দিতেন, তখন তারা দেখতে পেতেন এটি চুলের মতো হালকা-ওজন-যুক্ত জিনিসকে আকর্ষণ করে। একইভাবে স্থির বিদ্যুতের জন্য আমরা যখন অন্ধকারে আমাদের কাপড় পরিবর্তন করি, আমরা এক ধরণের মৃদু বৈদ্যুতিক স্পার্ক অনুভব করতে পারি। 

১৭৫২ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন যে কাপড় এবং বজ্রপাত থেকে স্ফুলিঙ্গের ঘটনাটি একইরকম, স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ নিস্তরিত হওয়া। তবে মানুষ তার এই মতবাদ বিশ্বাস করে নি, যার সত্যতা উপলব্ধি করতে মানুষের আরও ১০০ বছর সময় লেগেছিল।

ঠিক এভাবেই মেঘেও স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। বায়ুর এমন বিপরীতমুখী প্রবাহ প্রচুর ধনাত্মক আধান ও ঋণাত্মক আধান উৎপন্ন করে থাকে।

সৃষ্ট ধনাত্মক আধান মেঘের উপরের দিকে অবস্থান করে এবং ঋণাত্মক আধান মেঘের নিচের দিকে অবস্থান করে। এভাবে প্রচুর আধান জমা হতে থাকে যা কি না মেঘে উচ্চ বিভব তৈরি করে। আর আমরা জানি, চার্জ বা আধান সবসময় উচ্চ বিভবের স্থান থেকে নিম্ন বিভবের স্থানে প্রবাহিত হয়।

পৃথিবীর আধান শূন্য। ফলে মেঘে পুঞ্জীভূত চার্জ নিস্তরিত হওয়ার জন্য ভূমির দিকে ধাবমান হয়। চার্জগুলো যখন প্রচণ্ড গতিতে ভূমির দিকে আসতে থাকে তখন বৃষ্টির পানি ও বায়ুর কণার সাথে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে। এতে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় যা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি তৈরি করে। আর এই উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিকেই আমরা বজ্রপাত বলে থাকি।

তবে বজ্রপাত শুধু মেঘ থেকে ভূমিতেই ঘটে না, এটি পাশাপাশি দুটি মেঘপুঞ্জের সাথেও হয়ে থাকে।

বজ্রপাতের সময় এত শব্দ ও আলো উৎপন্ন হয় কিভাবে?

একটু আগেই আমরা দেখলাম কিভাবে তড়িৎ আধান বায়ু বা পানির কণা সাথে কিভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শক্তির নিত্যতা সূত্র থেকে আমরা জানি যে শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, এটি শুধু এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। চার্জগুলো যখন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূমির দিকে অগ্রসর হয় তখন সৃষ্ট সংঘর্ষে গতিশক্তি তাপ ও আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

ব্যাপারটি বোঝার জন্য একটি উদাহরণ চিন্তা করতে পারেন। ধরুন আপনি যদি একটি হাতুড়ি দিয়ে একটি লোহার পাতকে জোড়ে জোরে কিছুক্ষণ আঘাত করতে থাকেন এবং তারপর ঐ পাতটিকে স্পর্শ করেন তাহলে দেখতে পাবেন পাতটি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আপনার প্রয়োগ করা গতিশক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ঠিক এভাবেই চার্জ এর প্রবাহ তাপশক্তি উৎপন্ন করে এবং প্রচণ্ড তাপের জন্য সৃষ্টি হয় অতি উজ্জ্বল আলো।
এখন প্রশ্ন হল, বজ্রপাতের সময় কত তাপ উৎপন্ন হয় যে এত উজ্জ্বল আলো দেখা যায়? উত্তর শুনলে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না।

একটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ২৭,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। এই তাপমাত্রা এতটাই বেশি যা কিনা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫,৬০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে অনেক অনেক বেশি। হ্যাঁ, এত উচ্চ তাপমাত্রার কারণেই বজ্রপাতের সময় এত উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন হয়ে থাকে।

এবার আসা যাক শব্দের কথায়। পূর্বেই আমরা দেখেছি কিভাবে আধান নিস্তরিত হওয়ার সময় কিভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর এই প্রবল সংঘর্ষের কারণেই সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড শব্দ। তবে একটি ব্যাপার আমরা সবাই লক্ষ করে থাকব। সেটি হল বজ্রপাতের সময় আলোর ঝলকানি দেখার কিছু পরে আমরা তার শব্দ শুনতে পাই। এমনটা কেন ঘটে? চলুন দেখে নেওয়া যাক।

বজ্রপাতের সময় কেন আগে আলো দেখা যায় এবং পরে শব্দ শোনা যায়?

এর মূল কারণ হল আলো এবং শব্দের বেগের পার্থক্য। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

আমরা জানি আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে 300000 কিলোমিটার (প্রতি সেকেন্ডে 3 × 10 ^ 8 মিটার)। অন্যদিকে 0 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে 332 মিটার। গতির এই পার্থক্যের কারণে বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুৎ চমকানোর একটু পরে শোনা যায়।

বজ্রপাতের সময় সতর্কতা

প্রতি বছর আমাদের দেশে বজ্রপাতের কারণে অনেক লোক মারা যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-২০১৯ দশ বছরে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৮১। তবে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে। সে বছর বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৫৯ জন।

অতএব, বজ্রপাতকে মোটেও হালকা ভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সতর্কতাগুলো বিশেষ ভাবে অনুকরণীয়-

১। বজ্রপাতের সময় সবচেয়ে নিরাপদ হল কোন দালান বা পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেওয়া। ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় কোনভাবেই ঘর থেকে বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

২। বজ্রপাতের সময় কখনোই বাইরে বা খোলা জায়গায় থাকা উচিত নয়। খোলা ও উঁচু জায়গায় বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এমন অবস্থা দেখা দিলে খোলা বা উঁচু স্থান থেকে সরে আসুন এবং নিরাপদ কোন স্থানে আশ্রয় নিন।

৩। বজ্রপাতের সময় আমরা অনেকেই গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া কে বেশি নিরাপদ ভেবে থাকি এবং আমরা এ পতিস্থিতিকে নিরাপদ ভেবে থাকি যা কিনা মোটেও সঠিক নয়। নিরাপদ থাকতে হলে সবসময় বিদ্যুৎ লাইন ও উঁচু গাছপালা থেকে দূরে থাকা উচিত। এসব জায়গায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে বড় কোন খোলা জায়গায় গাছ থাকলে সেখানে বজ্রপাতের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে । তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেওয়া একদমই উচিত নয়।

বজ্রপাতের সময় সতর্কতা

৪। গাড়ির ভেতরে থাকা অবস্থায় বজ্র ঝড় শুরু হলে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। কারণ গাড়ির চাকায় ব্যাবহৃত টায়ার বিদ্যুৎ অপিরিবাহি অর্থাৎ বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। এটি গাড়িকে ভূমি থেকে আলাদা করে রাখে। এতে করে বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্য দিয়ে ভূমিতে আধান প্রবাহের কোন পথ তৈরি হয় না। তবে নিকটে যদি কোন কংক্রিটের ছাউনি থাকে তাহলে গাড়িতে না থেকে সেখানে আশ্রয় নেওয়াই ভাল। ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় গাড়িতে না থাকাই ভাল। তবে মোটেও টিন বা লোহার কোন ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়। আর খেয়াল রাখবেন গাড়ি থেকে নেমে ঐ স্থানে যেতে যেন আপনাকে পাঁচ কদমের বেশি ফেলতে না হয়।
আপনাকে যদি গাড়িতেই থাকতে হয় তাহলে বেশ কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত। পায়ে জুতা খুলে রাখলে দ্রুত জুতা পড়ে নিতে হবে। বেশি ভাল হয় পা সিটের উপর তুলে বসলে। খেয়াল রাখবেন কোন ভাবেই যেন শরিল গাড়ীর বডি বা ধাতব কোন কিছু স্পর্শ না করে থাকে। মনের ভুলেও গাড়ির কাচে হাত দেবেন না।

৫। ঘরে থাকলে কখনোই জানালার আছে থাকবেন না। ভাল করে জানালা বন্ধ রাখুন এবং জানালা থেকে যথেষ্ট দূরে থাকুন।

৬। বজ্রপাতের সময় ঘরে থাকলে আরও কিছু জরুরী বিষয়ে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। কোথাও কোন ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় সিঁড়ির রেলিং, বাড়ির ধাতব কল, ধাতব পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। টিভি কেবল, ল্যান্ড লাইন টেলিফোন ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করা থেকে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

৭। বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে আমাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এসব যন্ত্রপাতিকে বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগ-বিহীন করে রাখাই ভাল। ঝড় ও বজ্রপাতের শঙ্কা দেখা দিলে এসব যন্ত্রপাতির প্লাগ খুলে দিন। ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার সহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া অবস্থায় থাকলে বজ্রপাতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে এবং এ থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ করা থাকলেও হাত দিয়ে ধরবেন না।

৮। বজ্রপাতের সময় আমরা অনেকেই ভয় পেয়ে কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরি। এটি কিন্তু বেশ ভাল একটি অভ্যাস। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ আপনার শ্রবণ শক্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কাজেই ব্যাপারটি অনেকের কাছে উদ্ভট ঠেকলেও আপনাকে সুরক্ষা দেবে।

৯। বজ্রপাতের সময় পানি থেকে সর্বদা দূরে থাকুন। পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী হওয়ায় বজ্রপাতের সময় পানিতে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোন পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে উঠে আসুন।

১০। যে স্থানে আপনিই উঁচু এমন কোন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেবেন না। বজ্রপাতের সময় কোন খোলা জায়গা যেমন ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে বসে পড়ুন। বাড়িতে কোন উঁচু স্থান যেমন বাড়ির ছা্দে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যান।

১১। যদি নিরুপায় হয়ে কোন খোলা জায়গায় থাকতে হয় তাহলে নিচু হয়ে বসে পড়ুন। তবে মনের ভুলেও শুয়ে পড়বেন না। যদি কয়েকজন থাকেন তাহলে পরস্পর দূরে থাকুন এবং প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান। কখনোই সবাই একসাথে জড়ো হয়ে থাকবেন না।

১২। অনেকসময় বজ্রপাতের পূর্বে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়।বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাড়া হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও ত্বক শিরশির করা বা বিদ্যুৎ অনুভূত করার মত ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেকসময় আশপাশে থাকা কোন ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। এমন পরিস্থিতি বা কোন প্রকার লক্ষণ পেলে সাবধান হয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, এমন লক্ষণ প্রকাশ পেলে বুঝে নিয়ে হবে আপনার সন্নিকটেই বজ্রপাত হবে। দ্রুত সতর্ক হোন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ স্থানে চলে যান।

১৩। গ্রামে অনেকেরই কাঁচা ঘর থাকে। এরকম ঘরে থাকার সময় সরাসরি মাটির উপর না থেকে বিছানার উপর উঠে বসে থাকুন। কোন কারণে যদি মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাহলে রাবারের জুতা পড়ুন। চামড়ার জুতা পড়ে বা খালি পায়ে থাকলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।

১৪। বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে আপনার বাড়িকে সুরক্ষিত করুন। এজন্য বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার সময় আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে আর্থিং সংযোগ দিতে হবে। ভুলপদ্ধতি অবলম্বন বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।

১৫। বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যাক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারা যান। তবে কেউ কেউ আহত হয়েও থাকেন। কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। তবে সবচেয়ে ভাল হয় দ্রুত চিকিৎসক ডেকে চিকিৎসা করালে। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন আছে কি না তৎক্ষণাৎ পরিক্ষা করতে হবে এবং না থাকলে আনার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

বিশ্বের কোথায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়?

বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে। পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা নাসার আবহাওয়া স্যাটেলাইটের লাইটেনিং ইমেজিং সেন্সর থেকে ১৬ বছর ধরে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি বছর হ্রদটির প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকার উপর গড়ে ২৩৩টি বজ্রপাত হয়। 

Maracaibo Lake
Maracaibo Lake | Image source: iStock

নাসার তথ্য অনুসারে, প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ টি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় এবং বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন একসাথে ২ হাজারেরও বেশি বজ্রপাত হয়। সম্প্রতি উচ্চ রেজোলিউশনের উপগ্রহ চিত্র থেকে প্রাপ্ত নতুন ডেটার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এটি আবিষ্কৃত হয়েছে যে দক্ষিণ আমেরিকা হল অধিক বজ্রপাত প্রবণ স্থান, পূর্বে যেটি বিশ্বাস করা হত মধ্য আফ্রিকার মিতুম্বা। তবে মহাদেশ বিবেচনা করলে বজ্রপাতের হিসাবে আফ্রিকা মহাদেশ এখনও শীর্ষে। আফ্রিকার পরে যথাক্রমে আছে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া।

NASA’ র Tropical Rainfall Measurement Mission (TRMM) সংস্থার মতে অধিক বজ্রপাত-প্রবণ অঞ্চলগুলোকে নিচের ক্রম অনুযায়ী সাজানো যায়-

১। মারাকাইবো লেক, ভেনিজুয়েলা
২। কাহুজি-বিগা জাতীয় উদ্যান, কঙ্গো
৩। শাবুন্দা, কঙ্গো 
৪। সিসেরেস, কলম্বিয়া
৫। ওয়ালিকালে, কঙ্গো 
৬। ডগার, পাকিস্তান 
৭। এল তারারা, কলম্বিয়া
৮। এনগুটি, ক্যামেরুন
৯। বুটেম্বো, কঙ্গো
১০। বোয়ান্ডে, কঙ্গো 

যদিও আফ্রিকা এই র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থানটি হারিয়েছে, তবুও মহাদেশ হিসেবে অধিক বজ্রপাত প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকার দেশই বেশি। তবে বজ্রপাতের দেশ বলা হয় ভুটান কে।

বজ্রপাতের সময় কত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়?

বজ্রপাতের ফলে এক বিশাল পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। মেঘ থেকে ভূমিতে হওয়া একটি সাধারণ বজ্রপাতে প্রায় ১ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়। 

একটি সাধারণ বজ্রপাতের ফ্ল্যাশ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট এবং প্রায় ৩০,০০০ এম্পিয়ার এর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। সাধারণ বাসাবাড়িতে যেখানে ২২০ ভোল্ট এর বিদ্যুৎ ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। 

কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান 

How Powerful Is Lightning?