‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যের পরিচয় দাও।
উত্তর: কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক তাৎপর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনিই আধুনিক রোমান্টিক গীতিকবিতার উদ্বোধক। বিহারীলালের কাব্যসাধনায় প্রথম সৃষ্টি বঙ্গসুন্দরী। এ কাব্যের ভাষায়, উপমায়, প্রকাশরীতিতে কবির পূর্ণ অধিকার রয়েছে। শুধু অধিকার নয়, এর উপর কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ছাপ তুলে ধরা হয়েছে।
‘বঙ্গসুন্দরী’ দশ সর্গের কাব্য। কাব্যের প্রথম সর্গের নাম উপহার। এ সর্গে কবিচিত্ত অতৃপ্ত। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে কবি যেন নিজেকে মিলাতে পারছেন না। কাব্যটির দ্বিতীয় সর্গ ‘নারীবন্দনা’। এ সর্গে বিচিত্র ধরনের নারীর স্নেহ, প্রীতি ও রূপ ঐশ্বর্যে জগতে স্নেহের অমিয়ধারা প্রবাহিত হওয়ার কথা প্রকাশ পেয়েছে। এ সর্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনিও উচ্চকিত হয়েছে। তৃতীয় সর্গ ‘সুরবালা’। এ সর্গে নারীকে তুলনা করা হয়েছে জগতের সুর, ছন্দ ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে। চতুর্থ সর্গ ‘চিরপরাধিনী’। এখানে ঘরের কোণে বন্দি বঙ্গ নারীর চিরপরাধীন মর্মবেদনা সহজ, ছন্দ ও বেদনায় উচ্চকিত। পঞ্চম সর্গ ‘কল্পনাসুন্দরী’। পার্শ্ববর্তী বস্তিতে আগুন লাগায় সেখানের হাহাকার রবে অট্টালিকাবাসী করুণাময়ী বালিকার অন্তরে যে বেদনা সঞ্চারিত হয়েছে তা এখানে বর্ণিত হয়েছে। ষষ্ঠ সর্গ ‘বিষাদিনী’। এ সর্গে পতি সুখ বঞ্চিত নারীর বেদনা তুলে ধরা হয়েছে। সপ্তম সর্গ ‘প্রিয় সখী’ এখানে নারীর সখ্যরস দেখানো হয়েছে। অষ্টম সর্গ ‘বিরহিনী’। এ সর্গে চিত্রিত হয়েছে স্বামী বিরহে বঙ্গ নারীর কাতরতা। নবম সর্গ ‘প্রিয়তমা’। এ সর্গে প্রিয়তমা পত্নীর কোলে শিশুর আদরমাখা নিরাপদ আশ্রয় ধরণীর বুকে সর্গ নামিয়ে এনেছে। দশম সর্গ ‘অভাগিনী’ । বাংলায় চিরায়ত প্রকৃতির মতো সুন্দর নারী কিভাবে অনাদর অবহেলায় অন্তরাত্মা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে তা এ সর্গে দেখানো হয়েছে। বিহারীলালের রোমান্টিক কবিভাবনায় চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গসুন্দরী কাব্যে। এ কাব্যে কবি বাস্তবকে কল্পনায় ইন্দ্রধনুরাগে রঞ্জিত করে দেখেছেন। কাব্যের শিরোনামে কবির মানস পরিভ্রমণের চিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
“কছু ভাবি ত্যজে এই দেশ
যাই কোনো এহেন প্রদেশ:
যথায় নগর গ্রাম
নহে মানুষের ধাম;
পড়ে আছে ভগ্ন অবশেষ।”
মুক্ত কল্পনাক্রীড়ার চিহ্ন এ কাব্যের প্রতিটি পঙক্তিতে রয়েছে। তিনি যে কেবল বর্তমান থেকে বিদায় নিয়ে কল্পলোকে যেতে চান তা নয়। বহির্বিশ্বে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বৈচিত্র্যের অনুভূতি লাভ করার জন্যও কবিচিত্ত সমান উচ্ছ্বসিত। এ কাব্যে নারীর বিভিন্ন রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। এ কাব্যে নারীকে বিষাদিনী, প্রিয়তমা, প্রিয়সখী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথম গীতিকবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ের গীতোচ্ছ্বাস পরিপূর্ণতা পায় এ কাব্যে। বাংলা কাব্যে তার নিজের কথা আমরা শুনি বিহারীলালের কাব্যে-
“সর্বদাই হু হু করে মন
বিশ্ব যেন মরুর মতন
চারিদিকে ঝালাপালা
উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা
অগ্নি কুণ্ঠে পতঙ্গ পতন।”
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment