বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবকালে বাংলার চিরায়ত সমাজ নবযুগের নতুন চিন্তার প্রভাবে প্রবলভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। পুরাতন সমাজ তখন ভাঙনের মুখে। এ হেন সময়ে সমাজকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপনের গুরুদায়িত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর বর্তেছিল। তাই তিনি পুরুষের সংযম, বিবাহিতা নারীর সতীত্ব ও বিধবার ব্রষ্মচর্য পালনকে সমাজ-সংরক্ষণের পক্ষে সেদিন আবশ্যক মনে করেছিলেন। যদিও বিধবার অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষণ, বিবাহিতা নারীর অন্যের প্রতি দুর্বলতাকে শিল্পসুলভ মন নিয়েই দেখেছিলেন। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও তিনি সেইকালে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাননি। বিশেষত তিনি নারীর সতীত্বকে অনেক স্থলেই গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষবৃক্ষের সূর্যমুখী, কৃষ্মকান্তের উইলে ভ্রমর, মৃণালিনীর মনোরমা, রজনীর লবঙ্গলতায় তিনি সতীত্বের জয়গান গাইলেও নারীর ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে লবঙ্গলতার অন্তরস্থিত কামনাকেও অস্বীকার করেননি। তিনি বিধবা প্রেম বা বিধবাবিবাহকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি একথা ততটা সত্য নয় যতটা সত্য তাঁদের প্রেমের অভিনয় বা তাদের প্রেম নিবেদনে দ্বিধাজনিত ভীরুতা বা পরিবেশ সামঞ্জস্যে ব্যর্থতা। আর এরই ফলে কুন্দ ও রোহিনীর মৃত্যু।

তৎসত্ত্বেও বঙ্কিমের বিশেষ কয়েকটি নারীচরিত্র অঙ্কনে উত্তর রেনেসাঁস যুগের ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তীক্ষ্ণবুদ্ধি, প্রবল আত্মসম্মানবোধ, আন্তরধর্মে বঙ্কিমের নায়িকারা সেখানে বিশিষ্ট নারী হয়ে উঠেছে। বিষবৃক্ষের সূর্যমুখী তার স্বামী নগেন্দ্রনাথের কুন্দর প্রতি প্রবল আকর্ষণের কথা জানতে পেরে স্বয়ং স্বামীর বিবাহ দিয়েছে কিন্তু তীব্র আত্মসম্মানবোধের জন্য সে গৃহত্যাগ করছে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর ভ্রমর পতিপ্রাণা হয়েও স্বামী গোবিন্দলালের স্খলনকে ক্ষমা করতে পারেনি। দুর্গেশনন্দিনীতে স্পষ্টবাদিনী তেজস্বিনী আয়েষা বন্দি ভগৎসিংহ সম্পর্কে ওসমানকে বলেছে– “এ বন্দি আমার প্রাণেশ্বর।” কপালকুণ্ডলার মতিবিবিও নবকুমার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে– “এ জন্মে তোমার আশা ছাড়িব না।” সমাজনির্দিষ্ট বিধিনিষেধের ফলে বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা যে কতখানি অপমানজনক হতে পারে তারই খেদোক্তি শোনা যায় কপালকুণ্ডলার মুখে– “যদি জানিতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।” নারী যে উপযুক্ত সুযোগ শিক্ষা পেলে পুরুষের সমকক্ষ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে অতিক্রম করে অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে ‘দেবীচৌধুরাণী’ উপন্যাসে সাধারণ গ্রাম্যবধূ প্রফুল্লর দেবীচৌধুরাণীতে উত্তরণের কাহিনি-ই তার প্রমাণ। আনন্দমঠের শাস্তি ঋগ্বেদের যুগের নারীর মতো শিক্ষা, সাহস ও বুদ্ধিতে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল। সবমিলিয়ে বঙ্কিম উপন্যাসের নায়িকারা একদিকে ত্যাগ, তিতিক্ষা, ক্ষমা, পাতিব্রত্যে বাঙালি নারী, অন্যদিকে বুদ্ধিমত্তা, নির্ভীকতা, স্বাতন্ত্র্যবোধে বিশ্বসাহিত্যের নারীর সগোত্র। কখনো তারা অসীম যন্ত্রণা সহ্য করেছে, আবার কখনো পুরুষের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র একসময় শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে বলেছিলেন- “এদেশে স্ত্রীরাই মানুষ।” প্রকৃতপক্ষে তাঁর উপন্যাসের নায়িকারা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক, যেমন— বিমলা, আয়েষা, সূর্যমুখী, ভ্রমর, মনোরমা, ইন্দিরা, লবঙ্গলতিকা প্রভৃতি নায়িকারা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বাংলাসাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। কপালকুণ্ডলা, রজনী, শান্তি, জেবউন্নিসা প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্র যে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তাতে প্রথম শ্রেণির শিল্পীর স্বাক্ষরই বর্তমান। তবুও বলতে হবে ‘চন্দ্রশেখর’-এর ‘শৈবালিনী’ চরিত্রটি স্বতন্ত্রধর্মী। উক্ত নারী চরিত্রগুলির তুলনায় শৈবালিনী যেমন বাস্তবধর্মী, তেমনি বেগবান ও প্রাণবস্ত। শৈবালিনীতে অবৈধ প্রণয়ের চিত্র জীবন্তভাবে অঙ্কিত হয়েছে। শৈবালিনীকে সুন্দরী অভিশম্পাত দিয়েছে চন্দ্রশেখরের মতো নির্মল চরিত্র জ্ঞানপিপাসুকে অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করতে না পারার জন্য। কিন্তু তার এই ক্ষুব্ধ মনোভাব অর্থহীন। চন্দ্রশেখর ও প্রতাপের তুলনায় কে ভালো বা কে মন্দ, কে অধিকতর কাম্য পুরুষ তার বিচার নিরর্থক। প্রেমাকুতি হৃদয়বৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, বিবাহের বন্ধন যেমন তার জন্ম দিতে পারে না, প্রেমম্পদের ভালোমন্দ গুণের দ্বারাও তা নিয়ন্ত্রিত হয় না। রহস্যময় প্রাণের গতিপথের নির্দেশ কে দেবে? মানুষের হৃদয় কার প্রতি আসক্ত হবে তা সেই মানুষের চিত্ত প্রবণতার ওপরেই নির্ভর করে, বাইরে থেকে আরোপিত কোনো ন্যায়নীতির বোধই এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়। প্রতাপকে ভালোবাসা তার প্রণয়লোকের সুন্দরতম স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার বাসনায় সে সমাজসংসারের কোনো বন্ধনই মানেনি। তার হৃদয়ের গতি যেরূপ মুক্ত, কর্মধারাকেও সেইরূপ মুক্ত গতি করতে চেয়েছিল সে।

মোটের ওপর শৈবালিনীর চিত্তদেশে নৈতিকতার কোনো দৃঢ়মূল ভিত্তি নেই, তার কাছে সমাজ একটা বাইরের শক্তি মাত্র। সে নৌকায় সুন্দরীকে বলেছে– “ইহার পর পাড়ার ছোটো মেয়েগুলোকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিবে কিনা যে ওই উহাকে ইংরেজে লইয়া গিয়াছিল। ঈশ্বর না করুন, কিন্তু যদি কখনো আমার পুত্রসন্তান হয় তবে তাহার অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করিলে কে আমার বাড়িতে খাইতে আসিবে? যদি কখনো কন্যা হয় তবে তাহার সঙ্গে কোনো সুব্রাহ্মণ পুত্রের বিবাহ দিবে?” এই সাহসিকা রমণীর সমাজভীতির সীমা এটুকু। তার অন্তরের গোপন প্রদেশে সমাজবোধ অনুক্ষণ গুঞ্জরণ করে বলেনি– “তুমি যাহা করিতেছ তাহা পাপ, যাহা ভাবিতেছ তাহা অধর্ম।” মনে কোনোরূপ দ্বিধা থাকলে শৈবালিনী নিজের আচরণ ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এতখানি নির্দ্বন্দ্ব হতে পারত না। তাই বলতে হয়, বঙ্কিমের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী নারী চরিত্রের মধ্যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়ে উঠলেও শৈবালিনীর মতো সমাজকে এমন অবজ্ঞা করে আপন সাধ পূরণে সদম্ভ স্বাধীকার স্থাপনে প্রমত্ত  হতে কাউকে দেখা যায় না, তাই শৈবালিনী আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্যা।