“তিনিই (বঙ্কিমচন্দ্র) প্রথম দৃষ্টাস্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস পায় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে।”—কমলাকান্তের দপ্তর-এর পাঠ্য প্রবন্ধগুলির অবলম্বনে এই উক্তিটির যৌক্তিকতা বিচার করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য সাধনায় বাঙলা সাহিত্যের যে সর্বাঙ্গীণ সমৃদ্ধি ঘটেছিল, বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বিশেষ দান সম্পর্কে বলেছেন, বঙ্কিমের আবির্ভাবের আগে বাঙলা বিশুদ্ধ হাস্যরসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, হাস্যরসের নামে রুচিহীন, অশ্লীল ও গ্রাম্য ভাঁড়ামিতে জনসাধারণের মনোরঞ্জন করা হত। স্বাভাবিকভাবেই হাস্যরসের প্রতি সেই যুগের ইংরেজি-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের প্রবল বিতৃষ্ণা ছিল। তাঁদের ধারণা ছিল, হাস্যরস শুধু ভাঁড়ামিরূপে নিম্ন অমার্জিত রুচির পাঠকদের মনোরঞ্জনেই নিয়োজিত হয়, এটি কোনো উচ্চাঙ্গের চিন্তামূলক বিষয়ের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাংলা সাহিত্যে বিশুদ্ধ হাস্যরস প্রবর্তন করে দেখিয়ে দেন, হাস্যরস শুধু প্রহসনের সীমার মধ্যে বদ্ধ নয়, উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সমস্ত বিষয়কেই আলোকিত করে তুলতে পারে; তার সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতা হ্রাস পায় না শুধু তার সৌন্দর্য ও রমণীয়তা বৃদ্ধি পায়, তার সর্বাংশের প্রাণ ও গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্ত হয়ে ওঠে।

বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যান্য সমস্ত রচনার মধ্যে ‘কমলাকান্তের দপ্তরেই সর্বাধিক পরিমাণে বিশুদ্ধ হাস্যরসের পরিচয় মেলে। কমলাকান্তের দপ্তরের প্রবন্ধগুলিতে হাস্যরসের প্রয়োগ যে কত সার্থক হয়েছে, সেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখবার আগে বিভিন্ন ধরনের হাস্যরস নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বাংলা ভাষায় হাসি-তামাসা, ভাঁড়ামি, রঙ্গরস, প্রহসন, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ইত্যাদি শব্দে হাস্যরসের বিভিন্ন প্রকৃতি দ্যোতিত। প্রহসন, ভাঁড়ামি, হাসি তামাসা, রঙ্গরস, ইংরেজিতে উল্লেখিত Farce, Jest, Buffoonery প্রভৃতির হাস্যরসের প্রকৃতি অল্পবিস্তর পরিমাণে এক। তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, তাদের মধ্যে যে হাসির উত্তেজনা আছে তা সম্পূর্ণরূপেই বাইরের ব্যাপার, কারো আচরণ বা কথার কোনো অসংগতি, উদ্ভটতা, বিসদৃশতা ইত্যাদিকে কৌতুকাবহ করে তুলে পাঠক বা দর্শকদের মধ্যে হাসির উত্তেজনা জাগিয়ে তোলা হয়, তার মধ্যে কোনো গভীর জীবনদৃষ্টির উদ্ভাস লক্ষ্য করা যায় না। ব্যঙ্গবিদ্রুপ বা Satire হাসির মধ্যে আক্রমণ থাকে, এই জাতীয় হাস্যরসের মধ্যে লেখকের আঘাত বা আক্রমণ করার অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠে। Irony Satire-এর মতো খোলাখুলি বিদ্রূপ নয়, চাপা বিদ্রূপ, তার মধ্যে একটি বাক-ভঙ্গী বা শ্লেষ লক্ষ্য করা যায়। Wit-এর প্রধান রস মার্জিত বুদ্ধির বাক্‌চাতুর্য, বুদ্ধির তরবারির খেলা, এই হাসি আক্রমণাত্মক।

বিশুদ্ধ হাস্যরস, ইংরেজিতে যাকে humour বলা হয়, এই সমস্ত হাস্যরস থেকে স্বতন্ত্র শ্রেণির। লেখক যখন জগৎ ও জীবনের প্রতি একটি ব্যাপক, গভীর ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে সমাজ জীবনের নানা অসঙ্গতি, ভুলভ্রান্তি, মোহ, বিচ্যুতি, ভ্রষ্টতা ইত্যাদিকে কৌতুকাবহরূপে চিত্রিত করে আমাদের সামনে সত্যের রূপ প্রদর্শন করেন, তখনই আমরা বিশুদ্ধ হাস্যরসের আস্বাদ পাই। এই ধরনের হাস্যরসাত্মক রচনার সমালোচনা থাকে, কিন্তু তা কখনই ক্ষমাহীন হিংস্র আক্রমণের রূপ নেয় না। বিশুদ্ধ হাস্যরসে হাসি ও অশ্রু পাশাপাশি বিরাজ করতে পারে। ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই হাস্যরসের প্রকৃতি সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন : “দীর্ঘ অভ্যাসের ফলে জীবনের যে সমস্ত বৈষম্য ও অসঙ্গতির সম্বন্ধে আমাদের মন অসাড়, অচেতন হইয়া পড়িয়াছে, আমাদের চিরাচরিত জীবনযাত্রার মধ্যে যে সমস্ত বিচার-বিভ্রম ও ভ্রান্ত মতবাদ অখণ্ডনীয় সত্যের মত দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, humorist-এর হাসির খোঁচা এক ঝলক অতর্কিত আলোকের মত সেই সমস্ত ভ্রান্তি ও অসঙ্গতিকে এক মুহূর্তে সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল করিয়া তোলে, আমাদের জীবনের বিচারধারাকে শোভন অশোভন নির্ধারণের মানদণ্ডকে আমূল পরিবর্তিত করিয়া দেয়। তাহার হাসির মধ্যে এই স্বচ্ছ, ভ্রান্তি নিরসনকারী আলোক-প্রাচুর্য আছে বলিয়াই ইহা আমাদিগকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করে। Humorist তাঁহার হাসির সাহায্যে আমাদিগকে বুঝাইয়া দেন যে, যেখানে আমরা গম্ভীর সেখানে আমরা হাস্যাস্পদ, যাহা আমাদের নিকট উপহাস্য তাহা প্রকৃতপক্ষে সহানুভূতির অধিকারী।” বিশুদ্ধ হাস্যরসের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ প্রহসন ইত্যাদি থাকতে পারে, কিন্তু তাদের সেই হাস্যরসাত্মক রচনার মূল সুরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আবদ্ধ থাকতে হবে।

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সমস্ত চিন্তা-প্রত্যয়, বিশ্লেষণ, মনন, জীবনবীক্ষা প্রভৃতি উপস্থাপিত হয়েছে। আফিমের নেশাখোর, অর্ধোম্মাদ, সমাজ সংসার ও প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস সংস্কার প্রভৃতির বন্ধনমুক্ত কমলাকান্তের কল্পনা, চিন্তা ও অনুভূতির মাধ্যমে। সেইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র এই বিচিত্র চরিত্রটির মাধ্যমে হাস্যরস ও হাস্যরসাত্মক কল্পনায় জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, সমালোচনা ও অনুভবকে পাঠকদের কাছে চিত্তাকর্ষকরূপে তুলে ধরতে কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। কমলাকান্তের দপ্তরের ‘পতঙ্গ’ রচনাটির সূচনায় কমলাকান্তের এই বিবরণ পাই : নসীরাম বাবুর বৈঠকখানায় রাত্রিকালে সেজ জ্বলছে, কমলাকান্ত পাশে মোসায়েবি ধরনে বসে আছে; বাবু দলাদলির গল্প বলছেন, সে আফিম চড়িয়ে ঝিমোচ্ছে, দলাদলির প্রসঙ্গে চটে গিয়ে মাত্রা বেশী করে ফেলেছে। আর এই আফিমের মাত্রাবৃদ্ধি সম্পর্কে কমলাকান্তের এই আড়ম্বরপূর্ণ নৈয়ায়িক যুক্তির জালবিস্তার, তার অসঙ্গতি নিঃসন্দেহে কৌতুকাবহ : “বিধিলিপি। এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অনাদি ক্রিয়া-পরম্পরার একটি ফল এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমলাকান্ত চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করিয়া অদ্য রাত্রে নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় বসিয়া মাত্রা বেশী করিয়া ফেলিবেন। সুতরাং আমার সাধ্য কি যে, তাহার অন্যথা করি।”

এই হাস্যরসাত্মক প্রস্তাবনা আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষক বোধ হয়, বঙ্কিমচন্দ্ৰ এইভাবেই অতি সহজে আমাদের কমলাকান্তের আফিমের মাত্রা বৃদ্ধি ফলস্বরূপ পতঙ্গের বিচিত্র রূপক কল্পনার জগতে টেনে নিয়ে আসেন। একটি পতঙ্গ সেজের চারপাশে চোঁ-ও-বৌ-ও শব্দ করে ঘুরছিল, আফিমের প্রসাদে কমলাকান্ত দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে আলোর উদ্দেশে তার এই ভাষণ শুনতে পায় অতীতে আলো পেতলের পিলসুজের ওপর মাটির প্রদীপে শোভা পেত, তারা স্বচ্ছন্দে পুড়ে মরত; এখন সেজের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, প্রবেশের পথ পায় না, পুড়ে মরতে পারে না। তারা পতঙ্গ জাতি, পুড়ে মরার অধিকার তাদের জন্মগত, পূর্বাপর আলোয় পুড়ে মরে আসছে। আলো কী তা সে জানে না, শুধু জানে সে তার বাসনার বস্তু, জগতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা ও মরণের আশ্রয়। আলো কী সে কখনও জানতে পারবে না, জানতে চায়ও না, যেদিন জানবে সেইদিন তার সুখ চলে যাবে; কাম্যবস্তুর স্বরূপ জানলে কার সুখ থাকে। পতঙ্গ উড়ে চলে যাবার পর আমরা প্রস্তাবনার মতো কমলাকান্তের বাস্তব পরিবেশে ফিরে আসি, কিন্তু এই পরিবেশ তার আফিমের নেশাঘটিত কল্পনায় রূপান্তরিত হয়ে যায় : “নসীরামবাবু ডাকিল, কমলাকান্ত’। আমার চমক হইল—চাহিয়া দেখিলাম—বুঝি বড় ঢুলিয়া পড়িয়াছিলাম। কিন্তু চাহিয়া দেখিয়া নসীরামকে চিনিতে পারিলাম না—দেখিলাম, মনে হইল, একটা বৃহৎ পতঙ্গ বালিশ ঠেসান দিয়ে তামাকু টানিতেছে। সে কথা কহিতে লাগিল—আমার বোধ হইতে লাগিল যে, সে টো বোঁ করিয়া কি বলিতেছে।”

নসীরামের এই রূপান্তর হাস্যকর, কিন্তু সেই হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে কমলাকান্ত মানব জাতির পতঙ্গসুলভ প্রকৃতি সম্পর্কে এই দার্শনিক চিন্তার উপস্থাপনাকে রমণীয়, মনোজ্ঞ ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মানুষ মাত্রেই পতঙ্গ, প্রত্যেকেরই এক একটি বাসনার বহ্নি আছে, তারা তাতে পুড়ে মরতে চায়, মনে করে, তাতে পুড়ে মরার অধিকার তাদের আছে। জ্ঞান-বহ্নি, ইন্দ্রিয়-বহ্নি, সংসার বহ্নিময়, আবার সেজের মতো তার আবরণও আছে, তার জন্য আমরা আমাদের কাম্যবস্তুর বহ্নিতে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে পারি না; সেই আবরণ না থাকলে সংসার এতদিন পুড়ে মরত। যদি সমস্ত ধর্মবিদ চৈতন্যদেবের মতো ধর্মকে মানস-প্রত্যক্ষ দেখতে পেত, তবে কজন বাঁচত। বিভিন্ন বহ্নিতে মানুষের দহন নিয়ে, রামায়ণ, মহাভারত, প্যারাডাইস লস্ট, শেকসপীয়রের ট্র্যাজেডি প্রভৃতি রচিত হয়েছে। বহ্নি কী, ঈশ্বর, ধর্ম, জ্ঞান, স্নেহ প্রভৃতি কী আমরা জানি না; দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মগ্রন্থ, কাব্য তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবু সেই অলৌকিক, অপরিজ্ঞাত পদার্থকে ঘিরে আমরা ঘুরে বেড়াই, আমরা পতঙ্গ না তো কি। কমলাকান্তের নিজের আফিমের মাত্রা বৃদ্ধির কৈফিয়ৎ দান এবং নসীরামকে বাবুর বালিশে ঠেসান দেওয়া পতঙ্গের রূপ ধারণকে কেন্দ্র করে বঙ্কিমচন্দ্র যে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্য দিয়েই নাটকীয় গতিতে ওই রমণীয়তায় এই জীবন চিন্তার প্রকাশ আমাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

‘আমার মন’ প্রবন্ধে প্রথমেই তার মন কোথায় গেল, কে চুরি করল এই প্রশ্নের সূত্রে তার ঔদারিকতা নিয়ে কমলাকান্ত এক বিচিত্র রূপকল্পনায় হাস্যরস সৃষ্টি করেছে : “মানি, পাকের ঘরে আমার মন পড়িয়া থাকিত। যেখানে পোলাও, কাবাব, কোফ্ফার সুগন্ধ, যেখানে ডেকচী-সমারূঢ়া অন্নপূর্ণার মৃদু মৃদু, ফুটফুট বুটবুট টকবকোধ্বনি, সেইখানে আমার মন পড়িয়া থাকিত।” কিন্তু পাকের ঘরেও তার হারানো মনকে পাওয়া গেল না, বন্ধুর পরামর্শ মতো কমলাকান্ত প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছে তার হারানো মনের সন্ধান করে দেখল। প্রসন্নর সঙ্গে তার গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণ এবং তার প্রতি অনুরাগের কারণ নির্দেশ আমাদের মনকে হাস্যবেগের বিপুল তরঙ্গে প্লাবিত করে প্রসন্ন দেখতে শুনতে মোটাসোটা, গোলগাল, বয়স চল্লিশের নীচে, দাঁতে মিসি, হাসিভরা মুখ, কপালের ছোট উলকিটি টিপের মতো দেখাত, সে পথে রসের হাসি ছড়াতে ছড়াতে যেত, কমলাকান্ত তা কুড়িয়ে নিত বলে লোকে তার নিন্দা করত। নিন্দুকদের জ্বালায় কমলাকান্তের মুখ ফুটতে পারত না, নচেৎ তাদের গব্যরস ও কাব্যরসের বিলক্ষণ বিনিময় চলত। প্রসন্নর প্রতি কমলাকান্তের অনুরাগের অনেক কারণ ছিল প্রথমত, সে নির্জল দুধ দেয় ও দামেও সস্তা; দ্বিতীয়ত, সে কখনো কখনো ক্ষীর, সর, ননী তাকে বিনামূল্যে দিয়ে যায়; তৃতীয়ত, কমলাকান্ত একদিন তাকে তার দপ্তরের কয়েকটি প্রবন্ধ পড়ে শুনিয়েছিল। সে বসে শুনেছিল। এত গুণে কোন লেখক ব্যক্তি বশীভূত না হয়ে পারে। প্রসন্নর আর একটি গুণেও সে মুগ্ধ হয়, সে তার অনুরোধে আফিম ধরেছিল, নেশাখোরের পক্ষে তার নেশাটুকু ছাড়া তার মতো আনন্দদায়ক আর কি হতে পারে। কমলাকান্তের প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে তার এই গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণ এবং তার গুণকীর্তন নির্মল, বিশুদ্ধ হাস্য-রসের আস্বাদে আমাদের মন তৃপ্ত করে।

প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছেও নিজের হারানো মনের সন্ধান না পেয়ে কমলাকান্ত পথে বেরিয়ে কলসী কাঁখে এক যুবতীকে দেখতে পেয়েছে, তার রূপলাবণ্যের তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হতে দেখে তার মনে হয়েছে, এই তরুণীই তার মন চুরি করেছে। সে তার পেছনে পেছনে যেতে থাকে, যুবতী ফিরে দেখে ঈষৎ রুষ্টভাবে জিজ্ঞেস করে, সে তার সঙ্গ নিয়েছে কী কারণে। কমলাকান্ত বলে, সে তার মন চুরি করেছে, তাতে তার এই প্রতিক্রিয়া হয় “যুবতী কটূক্তি করিয়া গালি দিল। বলিল, চুরি করি নাই, তোমার ভগিনী আমাকে যাচাই করিতে দিয়াছিল। দর করিয়া আমি ফিরাইয়া দিয়াছি।” কমলাকান্তের এই বিড়ম্বনাও অত্যন্ত কৌতুকাবহ, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা অনুভব করি, হাস্যরস সৃষ্টিতে পাঠকদের নিছক মনোরঞ্জনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র এই সমস্ত অংশে কৌতুকরসের অবতারণা করেননি, তার মধ্য দিয়ে এই সূক্ষ্ম ইংগিত দিয়েছেন যে, যে জিনিসগুলি আত্মসুখ বা ইন্দ্রিয় সুখদায়ক, তারা আমাদের স্থায়ী সুখ এনে দিতে পারে না। এইভাবেই তিনি পরোপকারই মানুষের মনের ধ্রুব আশ্রয়, তার স্থায়ী সুখের একমাত্র উৎস-পরবর্তী অংশের এই মূল বক্তব্যের পটভূমি তৈরি করেছেন, পাঠকদের অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁর রচনার সেই বিশ্লেষণধর্মী ও মননপ্রধান অংশে টেনে নিয়ে গেছেন। পটভূমি বা প্রস্তাবনার কৌতুকরসসিক্ত অংশগুলির মধ্য দিয়ে এই মূল বক্তব্যের উপস্থাপনা নাটকীয়, কৌতুকরসে রমণীয়, চিত্তাকর্ষক ও রসোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হাস্যরস যে কীভাবে মননপ্রধান বিষয়কেও আকর্ষণীয় ও আলোকোজ্জ্বল করে তুলতে পারে, এখানে আমরা তার উদাহরণ পাই। সে চিরকাল নিজের রইল, কখনও পরের হল না, সেইজন্য পৃথিবীতে তার সুখের কোনো আশ্রয় নেই এবং বিয়ে করে নিজের সংসারকে ভালোবেসে তাবৎ মানব জাতিকে ভালোবাসতে না শিখলে সেই বিবাহ মিথ্যা, নিষ্ফল—এই গুরুগম্ভীর চিন্তা উপস্থাপনের পরেই উপসংহারে কমলাকান্ত এই উক্তি করে : “এক্ষণে কমলাকান্ত যুক্তকরে সকলের নিকট নিবেদন করিতেছে, তোমরা কেহ কমলাকান্তের একটি বিবাহ দিতে পার?” নেশাখোর, ভবঘুরে কমলাকান্তের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এই আবেদনের অসংগতি আমাদের মনকে হাস্যবেগে আলোড়িত করে, সেইজন্যই আমরা তার চিন্তা ও মননের প্রতি গভীর আকর্ষণ বোধ করি, তার সঙ্গে আমাদের এক নিবিড় আত্মীয়তার সম্বন্ধ রচিত হয়ে যায়, আমরা তার চিন্তা প্রত্যয়কে প্রাণবন্ত সত্য বলেই অনুভব করি।”

‘বড়বাজার’ প্রবন্ধটির সূত্রপাতও হাস্যরসে। প্রসন্ন গোয়ালিনী কমলাকান্তকে ক্ষীর, সর, দই, দুধ, ননী ইত্যাদি খাইয়ে আসছিল, আহারকালে সে মনে করত, প্রসন্ন শুধু পরলোকে সদ্‌গতির কামনায় পুণ্য সঞ্চয় করছে। কমলাকান্ত জানত এই সংসাররূপ অরণ্যে যারা পুণ্যরূপ মৃগ ধরার জন্য ফাঁদ পেতে বেড়ায় প্রসন্ন তার মধ্যে সুচতুরা, ভোজনান্তে সে নিত্যই প্রসন্নর পরকালে অক্ষয় স্বর্গ এবং ইহকালে মৌতাত বৃদ্ধির জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করত। কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদ আমাদের মনকে হাস্যবেগে আন্দোলিত করে তোলে। সেই হাস্যরস যে বঙ্কিমের সমাজ সমালোচনারই একটি বিশেষ ভঙ্গি, আমরা উপলব্ধি করি, সেইজন্যই তাকে এত গভীর ও অর্থপূর্ণ বলে মনে হয়। কমলাকান্ত তার এই ক্ষোভ ও বেদনার ভার লাঘবের জন্য আফিমের মাত্রা চড়িয়েছে, তার প্রসাদে এই পৃথিবীকে একটি বৃহৎ বাজাররূপে দেখতে পেয়েছে, যেখানে রূপ, বিদ্যা, সাহিত্য, তোষামোদ, যশ ইত্যাদি সবকিছুই পণ্যের মতো কেনাবেচা চলে। প্রথমাংশের হাস্যরসের মধ্য দিয়ে এই সমাজ বীক্ষণকে বঙ্কিমচন্দ্র আকর্ষণীয়, স্বচ্ছ ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন।

‘বিড়াল’ প্রবন্ধের সূচনায় আফিমের মৌতাত উপভোগে আবিষ্ট কমলাকান্তেরই চিত্র ও ভাবনাকে পাই সে তার শয়নকক্ষে চারপাই-এর ওপর হুঁকো হাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন, একটু মিট্‌মিট্ করে ক্ষুদ্র আলো জ্বলছে, দেওয়ালের ওপর তার চঞ্চল ছায়া প্রেতবৎ নৃত্যরত; আহার প্রস্তুত হয়নি, সেইজন্য হুঁকো হাতে নির্মীলিত নেত্রে সে ভাবছিল, সে যদি নেপোলিয়ন হত তবে ওয়াটার্নর যুদ্ধে জয়ী হতে পারত কিনা। এমন সময় ‘মেও’ করে একটি ক্ষুদ্র শব্দ হতেই কমলাকান্ত তাকিয়ে দেখে হঠাৎ কিছু বুঝতে পারল না; প্রথমে মনে হল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। নেপোলিয়নের ভূমিকা গ্রহণের এই কল্পনায় আত্মপ্রসাদক্ষীত কমলাকান্ত পাষাণের মতো কঠিন হয়ে বলবে মনে করল, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গেছে, এখন আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে না। বিশেষত অপরিমিত লোভ ভালো নয়। কোথায় বিশ্ববিখ্যাত বীর যোদ্ধা রণকুশলী সেনাপতি নেপোলিয়ান, ওয়াটার্লুর রণক্ষেত্র, আর কোথায় খট্টায়-উপবিষ্ট, নসীরামবাবুর আশ্রিত অহিফেনসেবী কমলাকান্ত, তার ওয়াটার্লুর যুদ্ধ জয়ের ও ওয়েলিংটনের বিড়ালত্ব প্রাপ্তির কল্পনা এবং ইংরেজের সেনাপতির লোভ সম্পর্কে তার বিচারসুলভ কঠোর নৈতিক মনোভাব—এই অসংগতি অত্যন্ত হাস্যকর বলে মনে হয়।

আবার মেও শব্দ হতেই কমলাকান্ত চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ওয়েলিংটন নয়, একটি ক্ষুদ্র মার্জার, প্রসন্ন তার জন্য যে দুধ রেখে গিয়েছিল, নিঃশেষে পান করার পর নিজের মনের সুখ প্রকটিত করার জন্যে ‘মেও’ বলছে। নিজের মনে বিচার করে কমলাকান্ত বোঝে, দুধ তার বাপের নয়, মঙ্গলার, দুইয়েছে প্রসন্ন, তাতে তার যে অধিকার বিড়ালেরও তাই; সুতরাং সে রাগ করতে পারে না। তবে চিরাচরিত একটা প্রথা আছে যে বিড়াল দুধ খেয়ে গেলে তাকে লাঠি নিয়ে মারতে যেতে হয়, তার অবমাননা করে কমলাকান্ত মনুষ্য সমাজে কুলাঙ্গাররূপে পরিচিত হবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়; তাছাড়া, এই মার্জারী তার স্বজাতিমণ্ডলে তাকে কাপুরুষ বলে উপহাসও করতে পারে: “ইহা স্থির করিয়া, সকাতরচিত্তে হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্নযষ্টি আবিষ্কার করিয়া সগর্বে মার্জারীর প্রতি ধাবমান হইলাম।” কমলাকান্তের পৌরুষের এই আস্ফালনও অত্যন্ত কৌতুকাবহ ও উপভোগ্য সন্দেহ নেই।

এই সমস্ত হাস্যরসাত্মক দৃশ্য, কল্পনা, চিন্তা ও আচরণের মধ্যে দিয়ে দরিদ্র শোষিত শ্রেণির ক্ষুধার জ্বালা, তাদের ক্ষুধার শোষণ বঞ্চনার মধ্য দিয়ে ধনীদের ঐশ্বর্য সংগ্রহের সামাজিক অন্যায় অবিচার এবং তার বিরুদ্ধে দরিদ্রদের ক্ষুধা দূর করার জন্মগত অধিকার তথা সমাজতন্ত্রবাদের উপস্থাপনাকে বঙ্কিমচন্দ্র কৌতুহলোদ্দীপক ও মনোজ্ঞ করে তুলেছেন। এই সমস্ত অংশে নাটকীয় দৃশ্যের মতো একটা ঘাত-প্রতিঘাত, কৌতুকের উত্তেজনা ও সেই সূত্রে পরবর্তী অংশের জন্য আগ্রহ লেখক তৈরি করেছেন। তার ফলেই সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা যেভাবে সজীব ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে, সাধারণ প্রবন্ধের গতানুগতিক যুক্তিতথ্যের বিন্যাসে তা কখনই সম্ভব হত না। বিড়ালের সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্যকে খণ্ডন করতে না পেরে এবং তার কাছে পরাজিত হয়ে বিজ্ঞ লোকের পরামর্শ অনুযায়ী এই উপদেশ দিয়েছে, এ সমস্ত অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা, তাদের আন্দোলনেও পাপ আছে, বিড়াল এই সমস্ত দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে যেন ধর্মাচরণে মন দেয়। প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দেবে বলেছে, জলযোগের সময় বিড়াল যেন আসে, দুজনে মিলে ভাগ করে খাবে; আজ যেন সে আর কারো হাঁড়ি না খায়, ক্ষুধায় নিতান্ত অস্থির হলে যেন আবার সে আসে, সে তাকে এক সরিষাভর আফিম দেবে। সমাজতন্ত্রের সমর্থন ও প্রচার থেকে বিড়ালকে নিরস্ত করার এই প্রয়াসও হাস্যকর, সেই হাস্যরসের মধ্য দিয়ে বিড়ালের মূল বক্তব্যই আমাদের কাছে অখণ্ডনীয় ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।