ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র, শ্রীমদ্ভবদ্গীতা রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র এবং লোকরহস্য ও বিবিধি প্রবন্ধের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রতিভাধর মানুষ। রচনার বিষয়বস্তু ও তার পরিবেষণ-রীতি-বৈচিত্র্যই বঙ্মিমচন্দ্রকে এইরূপ বহুরূপী করে তুলেছে। কিন্তু এই বহুরূপী মানুষটিরই অন্তরে একটি অখণ্ড ঐক্যবোধ বিরাজ করত। ‘কমলাকান্তের দপ্তরই বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র রচনা যেখানে তার বিচিত্র সংশ্লেষণ ঘটছে। কমলাকান্তের বিভিন্ন উক্তির মধ্য দিয়ে তার যে মানবপ্রেমিক রূপটি পরিস্পুট তা প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের অন্তরের রূপ। এই মানব-হিতৈষণার বাণীই তার ধর্ম্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র ও ভগবদ্গীতার টীকায় ব্যাখ্যাত।

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব, চিন্তা, কল্পনার সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব চিন্তা কল্পনা মিলে গেছে। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে কমলাকান্তের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। মানবপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্রের মানবলোকে বিশ্বহিতের কামনা বিরাজ করত, সে কামনা কমলাকান্তের মনেও বিরাজমান ছিল।

‘আমার মন’ প্রবন্ধেও কমলাকান্ত রঙ্গরসিকতা পরিহার করে জীবনকে গভীরভাবে দেখবার চেষ্টা করেছেন। এখানে তার এই স্বার্থলেশহীন নৈর্ব্যক্তিক মানবহিতৈষণার আদর্শই পরিস্ফুট। এই আদর্শের উপলব্ধিতেই কমলাকান্তের মুখ থেকে উচ্চারিত “বুঝিয়াছি, লঘুচেতাদিগের মনের বন্ধন নেই ; নহিলে মন উড়িয়া যায়। আমি কখন কিছুতে মন বাঁধি নাই—এজন্য কিছুতেই মন নাই। এ সংসারে আমরা কী করিতে আসি, ঠিক বলিতে পারি না—কিন্তু বোধ হয়, কেবল মন বাঁধা দিতেই আসি।” আত্মবিসর্জন ভিন্ন যে পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের কোনো মূল্য নেই, তার প্রতিপাদনকল্পে কমলাকান্ত কোনো তত্ত্ব উপস্থিত করেননি। শুধু অন্তরের অকৃত্রিম সরল বিশ্বাস দ্বারাই তিনি এই অভিমত প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। “আমি মরিয়া ছাই হইব, কিন্তু আমার এ আশা একদিন ফলিবে। ফলিবে, কিন্তু কত দিনে হায়, কে বলিবে কত দিনে।” কমলাকান্তের মনে এই ব্যাকুলতা প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্রেরই আন্তরিক ব্যাকুলতা।