কার্লাইল জনসন সম্পর্কে বলেছিলেন : “a mass of genuine manhood”, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কেও এ মন্তব্য স্মরণযোগ্য। ড. স্যামুয়েল জনসন তাঁর সমকালের ইংরেজী সাহিত্যে ছিলেন ডিক্টেটর। বঙ্কিমচন্দ্রও আজ পর্যন্ত ‘সাহিত্য সম্রাট’ রূপেই আসীন। তবে পার্থক্য হিসাবে দেখা যায়, জনসনের মধ্যে সৃজনধর্মী সাহিত্যশক্তির অভাব ছিল, কিন্তু বঙ্কিমের মধ্যে তার প্রকাশ পূর্ণমাত্রায় দেখা যায়। উনিশ শতকের শেষপাদ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ‘দ্রোণাচার্য’। তাঁর রচনায় ‘কারয়িত্রী প্রতিভা’ ও ‘ভাবয়িত্রী প্রতিভা’ দুইয়েরই প্রভাব সুস্পষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্র মধুসূদনের মত ইউরোপ-ভ্রমণ না করলেও জ্ঞানচর্চার সূত্রে মানসভ্রমণে তাঁর মন হয়েছিল পাশ্চাত্য ভাবধারায় পরিশীলিত। রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিল, ফিক্টে, বার্ক, মেকলে, হার্শেল, অগস্ত কৌৎ, ম্যাক্সমুলার, দেকার্তে, ভোলত্যের প্রমুখ বহু মনীষীর চিত্তা উপাদানে সংগঠিত হয় তাঁর প্রবন্ধের রাজপ্রাসাদ। রোমান্টিক যুগের ইংরেজী গদ্যের প্রত্যক্ষতা ও ঋজুতা, ‘ফর্মে’র বৈচিত্র্য, কবিতার কারুকার্য খুব সম্ভবতঃ এই জাতপ্রাজ্ঞ প্রবন্ধ-শিল্পীর অজানা ছিল না। বার্ক, পিট ও গিবনের রাজনীতি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার অন্তরালে প্রেরণা দিয়েছিল। ‘ট্যাটলার’ ও স্পেটেটর’ পত্রিকার আদর্শ ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদককে প্রভাবিত করেছিল। তবে এইসব প্রভাব সাময়িক, সামগ্রিক নয়। সর্বত্র তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য, একক।

১৮৭২ সালের ১৪ই মার্চ শম্ভুচন্দ্র মুখার্জীকে একটি চিঠিতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেনঃ “I have myself projected a Bengali Magazine with the object of making it the medium of communication and sympathy between the educated and the uneducated classes.” সেই সূত্রেই সমকালীন বিশ্বচিত্তার সঙ্গে সমকালীন সাধারণজনের পরিচয় ঘটাবার প্রয়োজনে তিনি এই প্রবন্ধ-সরণি নির্মাণ করেন। তাঁর সৃষ্ট প্রবন্ধগুলিকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়—

  • (ক) দর্শন ও ইতিহাসধর্মী প্রবন্ধ।

  • (খ) বিজ্ঞানধর্মী প্রবন্ধ।

  • (গ) সাহিত্যধর্মী প্রবন্ধ।

  • (ঘ) ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দর্শন ও ইতিহাসধর্মী প্রবন্ধ:

প্রথম পর্যায়ে উল্লেখ করা যায়, ‘বিবিধ সমালোচনা’ (১৮৭৬), ‘সাম্য’ (১৮৭৯), ‘প্রবন্ধপুস্তক’ (১৮৭৯), ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১ম ভাগ-১৮৮৭, ২য় ভাগ-১৮৯২), ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮), ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ (মৃত্যুর পর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত, ১৯০২)। এই সব প্রবন্ধগুলি ধর্মচিন্তা, দার্শনিক তত্ত্ববিচার ও ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগে পূর্ণ। কিন্তু কোথাও যুক্তিবাহুল্যে ক্লান্ত নয়। জীবন্ত জাতীয়তাবোধ ও দৃঢ়বদ্ধ স্বাদেশিকতাই এগুলির ধ্রুবপদ। বস্তুত “জীবন লইয়া কি করিব”—এই উজ্জ্বল প্রশ্ন তাঁর আশৈশব। এই উজ্জ্বল প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেই তার সমগ্র জীবন শেষে স্বদেশী পূজায়, ধর্মের খোজে সম্পূর্ণ হয়। তার ‘ভাবয়িত্রী প্রতিভা’ মানবধর্ম, সমাজধর্ম প্রভৃতির সঙ্গে ধর্মচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শেষে হিন্দুধর্মের ভাবনায় কেন্দ্রীভূত হয়। তাঁর ঈশ্বর পুরাণপ্রতিম ‘অলৌকিক’ পুরুষ নয়, তা মানুষেরই apothe osis। তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ এক অনবদ্য প্রবন্ধ। এখানে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য, জাতির কালাপাহাড়ী সঙ্কটে কৃষ্ণকে আদর্শ মানুষ ও অনুশীলনতত্ত্বে’র আদর্শ বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করা। মানবতাবাদী ও ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গীতে কৃষ্ণচরিত্র-বিচারের প্রথম প্রয়াস এখানে দেখা যায়। তিনি ধর্মতত্ত্ব’ প্রবন্ধে কোঁৎ-এর নিরীশ্বরতা না মানলেও মেনেছেন Positivist-দের সমাজের প্রতি আনুগত্যের উপদেশঃ “সমাজকে ভক্তি করিবে। সমাজই রাজা, সমাজই শিক্ষক।”

অষ্টাদশ শতকে ফরাসী লেখক বোয়ালো ও রুপা, পোপ, অ্যাডিসন, জনসন, বার্ক প্রমুখ মনীষীদের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে সুস্পষ্ট। বাঙালীর তথা “ভারতবর্ষীয়দিগের ইতিহাস নাই–বাঙালীরা কখনও ইতিহাস লেখেন না…..বাঙালীরা মনে মনে জানে যে আমাদিগের পূর্বপুরুষদিগের কখনও গৌরব ছিল না, তাহারা দুর্বল, অসার, গৌরবশূন্য ভিন্ন অন্য অবস্থাপ্রাপ্তির ভরসা করে না— চেষ্টা করে না।” বঙ্কিমচন্দ্র তাই প্রথম ভারতবর্ষের প্রগতিভূমি বঙ্গদেশকে কেন্দ্র করে সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতি অনুধাবনে প্রাগৈতিহাসের চর্চায় হয়েছিলেন যত্নবান। জর্জ লুকাসের মন্তব্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য : “a real understanding for the problems of contemporary society can only grow out of an understanding of the society’s pre-history and formative history” (The Historical Novel, 1965, p. 231) ‘দুর্গেশনন্দিনী’ থেকে ‘সীতারাম’ পর্যন্ত বঙ্কিম-উপন্যাস এই প্রাগৈতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাম্য’ ও ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধগুলি সমাজ-সমস্যার অনুসন্ধানে আলোকিত। তীব্র ও তীক্ষ্ণ মর্মদাহের সঙ্গে বঙ্কিম বঙ্গদেশের কৃষকের জমিদারী-ব্যবস্থায় লাঞ্ছিত জীবনের চিত্রাঙ্কনে উদ্যোগী হন“হাসিম শেখ, আর রামা কৈবর্ত দুই প্রহর রৌদ্রে খালি পায়ে এক হাঁটু কাদার উপর দুইটি অস্থিচর্মবিশিষ্ট বলদে ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে….. যাইবার সময় কোন জমিদার, নয় মহাজন পথ হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়া দেনার জন্য বসাইয়া রাখিবে, কাজ হইবে না।… বল দেখি চশমা নাকে বাবু! ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে? তুমি লেখাপড়া শিখিয়া ইহাদের কি মঙ্গল সাধিয়াছ?”

এই বাণী বাংলার নিত্যসম্পদ। বর্তমান কালেও এই প্রশ্ন শিক্ষিত জনের বিবেক জাগরণে সমর্থ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী ব্যবস্থার সুগুণ এবং ত্রুটির দিকগুলিও এই প্রবন্ধে বিশ্লেষিত হয়। বঙ্কিমের চিন্তাসম্পদের এক উল্লেখযোগ্য রত্ন : ‘সাম্য’। এখানে তার বক্তব্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান না ঘটলে জাতির মুক্তি অসম্ভব। প্রজাদের দুর্দশা, পুরুষের বহুবিবাহ, স্ত্রী-পুরুষের বৈষম্য, শ্রম, ধনসঞ্চয়, বঙ্গদেশের কৃষক সবই এখানে উপস্থাপিত। তার শেষ কথা: “সকলের উন্নতির পথ মুক্ত চাই।” কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি সাধারণীকৃত হবে, শ্রেণীবৈষম্য কি বাতিল হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত এখানে অনুপস্থিত। অথচ সাম্যবাদের এইগুলিই হল মূলকথা। পরবর্তীকালে লেখক স্বয়ং এ গ্রন্থ বাতিল করেন এই যুক্তিতে, “সাম্য সব ভুলে ভরা আর ছাপাবো না” (শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা চিঠি, দ্রষ্টব্য)। বলা বাহুল্য, এই মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক।

‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য, অনুশীলন তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বহির্জীবন ও অস্তর্জীবন এই দুই দিকের উন্নতিসাধনের দিকে লক্ষ্য রেখে উদ্ভাসিত হয়। গুরু ও শিষ্যের কথোপকথনচ্ছলে এই তত্ত্বকথা বিবৃত। এই বিবৃতির শেষে আছে অনশ্বর উপদেশ ঃ “সকল ধর্মের উপর স্বদেশপ্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না।” (‘ধর্মতত্ত্ব, ২৮ অধ্যায়, উপসংহার)। পরাধীনতার গ্লানিতে এই মহানায়কের চিত্ত হয়েছিল বিদীর্ণ। তাই হার্বার্ট স্পেন্সার, ম্যাথু আর্নল্ডের চিন্তায় অনুশীলন তত্ত্বের মধ্যে এই স্বদেশী-ভাবনার প্রাধান্য না থাকলেও বঙ্কিমের ভাবনায় তা এক অনিবার্য, অভিনব সংযোজন হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ তার মতে “বিলাতি অনুশীলন তত্ত্ব নিরীশ্বর, এজন্য উহা অসম্পূর্ণ ও অপরিণত, অথবা উহা অসম্পূর্ণ ও অপরিণত বলিয়াই নিরীশ্বর,—ঠিক বুঝি না”।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিজ্ঞানধর্মী প্রবন্ধ:

বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ে স্মরণীয় প্রবন্ধ গ্রন্থ : ‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫)। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি হল ‘আশ্চর্য্য সৌরৎপাত’, ‘আকাশে কত তারা আছে?’ ‘ধূলা’, ‘গগনপৰ্য্যটন’, ‘চঞ্চল জগৎ’, ‘কতকাল মনুষ্য?’ ‘জৈবনিক’, ‘পরিমাণরহস্য এবং চন্দ্রলোক’। এইসব প্রবন্ধের দ্বারা তিনি শিক্ষিতজনকে সতর্ক করেন“বিজ্ঞানের সেবা করিলে বিজ্ঞান তোমার দাস, যে বিজ্ঞানকে ভজে, বিজ্ঞান তাহাকে ভজে। কিন্তু যে বিজ্ঞানের অবমাননা করে বিজ্ঞান তার কঠোর শত্রু।” এর আগেই অবশ্য বঙ্গদর্শনের প্রথম বছরের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় তিনি বিজ্ঞান-কৌতুক’ নামে সর্বজনবোধ্য বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ রচনার সূচনা করেন : “প্রধানতঃ হাক্সলী, টিল্ডল, প্রকটর, লাকিয়র, লায়েল প্রভৃতি লেখকগণের মতাবলম্বন” করে সৃষ্টি হয় অনেকগুলি প্রবন্ধ। তবে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞানেই নিবদ্ধ; যেমন “আকাশে কত তারা’ রচনায় আছে তাঁর বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা : “এ আশ্চর্য্য কথা কে বুদ্ধিতে ধারণা করিতে পারে? যেমন পৃথিবী মধ্যে এক কণা বালুকা, জগত্মধ্যে এই সসাগরা পৃথিবী তদপেক্ষাও সামান্য, রেণুমাত্র—বালুকার বালুকাও নহে।” এখানে বিজ্ঞানের রহস্য সাহিত্যের তুলিতে চিত্রিত। আবার দৃশ্যাত্মক বর্ণনায় কখনও কখনও চিত্রাভাস লক্ষ্য করা যায়; যেমন ‘ধূলা’ প্রবন্ধের অংশ বিশেষ : “ছায়ামধ্যে রৌদ্র না পড়িলে রৌদ্রে ধূলা দেখা যায় না, কিন্তু রৌদ্রমধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোকের রেখা প্রেরণ করিলে ঐ ধূলা দেখা যায়।”

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যধর্মী প্রবন্ধ:

তৃতীয় পর্যায়ে সাহিত্যধর্মী প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (প্রথম খণ্ড) অন্তর্ভুক্ত ‘উত্তরচরিত’, ‘গীতিকাব্য’, ‘প্রকৃত এবং অতিপ্রাকৃত’, ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’, ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রভৃতি রচনাংশ। প্রাচীন সাহিত্যালোচনায় প্রচলিত রীতি থেকে মুক্তি ভিন্ন আধুনিক সাহিত্যসমালোচনা অসম্ভব। আর বঙ্কিমচন্দ্রও প্রাচীন কালের সঙ্গে আধুনিক সমালোচকের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিশ্লেষণের তারতম্য নির্দেশ করেন এইভাবেঃ “যেমন অট্টালিকার সৌন্দর্য বুঝিতে গেলে সমুদয় অট্টালিকাটি এককালে দেখিতে হইবে…কাব্যনাটক সমালোচনাও সেইরূপ” (‘উত্তরচরিত’)। তত্ত্ববিমুখ হৃদয়নিষ্ঠা, যা প্রকৃতপক্ষে বস্তুনিষ্ঠার দোসর, তা বঙ্কিমের সমালোচনাকে যান্ত্রিক হতে দেয়নি। বরং প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গে তার দূরত্বকেই যেন নির্দেশ করছে। আবার এরই পাশাপাশি রাখা যায়— “আগেকার লোক কিছু মোটা কাজ ভালবাসিত, এখন সরুর উপর লোকের অনুরাগ।…. এখনকার রসিকেরা ডাক্তারের মত সরু ল্যান্সলেটখানি বাহির করিয়া কখন কুচ করিয়া ব্যথার স্থানে বসাইয়া দেন, কিছু জানিতে পারা যায় না। কিন্তু হৃদয়ের শোণিত ক্ষতমুখে বাহির হইয়া যায়” (‘দীনবন্ধু মিত্র’)। এই দুটি দৃষ্টাস্তেই সুস্পষ্ট হয় যেমন সমালোচনার অর্থ—‘সম্যক ঈক্ষণ’, তেমনি সমালোচক should find out for us more than we can find out ourselves” (আর্থার সাইমন্স)। এই উত্তরচরিত’ প্রবন্ধেই বঙ্কিমের ইঙ্গিতময় মন্তব্য: “যাহা স্বভাবানুকারী ও স্বভাবাতিরিক্ত, তাহাই কবির প্রশসংনীয় সৃষ্টি।” “স্বভাবানুকরণ’ অর্থ—“বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির সর্বাঙ্গীণ সৌষম্য সন্ধান।” তবে ‘স্বভাবাতিরিক্ত’ অর্থ তেমন সুস্পষ্ট নয়। খুব সম্ভবত প্লেটো এরিস্টটলের অনুকারবাদ—মাইমেসিস-তত্ত্বের ধারণাই এর মূলে ক্রিয়াশীল ছিল।

‘গীতিকাব্য’ প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্য— “যাহা অবক্তব্য তাহাতে গীতিকাব্যের অধিকার।” ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১২৮০ সালের পৌষ সংখ্যায় দীনেশচন্দ্র বসুর ‘মানসবিকাশ’ কাব্য সমালোচনার প্রয়োজনে আলোচ্য প্রবন্ধটির উদ্ভব। তবে ‘বিবিধ প্রবন্ধে’র মধ্যে গ্রন্থভুক্তির সময় বঙ্কিমচন্দ্র সমালোচনা অংশ বাদ দিয়ে শুধু তার বক্তব্য অংশটুকু যুক্ত করেন। এখানে তার মন্তব্য: “সকলই নিয়মের ফল। সাহিত্যও নিয়মের ফল…সাহিত্য দেশের অবস্থা এবং জাতীয় চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র।” সাহিত্য নৈসর্গিক নিয়মের ফল— বঙ্কিমচন্দ্রের এই মনোভঙ্গীর সঙ্গে ফরাসী সমালোচক তেইন-এর পরিবেশ-তত্ত্বের সাদৃশ্য অনুভূত হয়। তেইন সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিনটি শক্তির উপর জোর দিতে চেয়েছিলেন। (ক) জাতি, (খ) সামাজিক বা গোষ্ঠীগত পরিমণ্ডল এবং (গ) কাল ( race, milieu and moment)। কিন্তু এর সঙ্গে স্রষ্টার আত্মস্বভাবের স্বাতন্ত্র্য স্বীকারের ক্ষেত্রে তেইন নীরব ছিলেন। আর এখানেই বঙ্কিমের সঙ্গে তার পার্থক্য দেখা যায়। বঙ্কিম জানেন, সাহিত্য নিয়মের ফল। তবু সে-নিয়ম যথেষ্ট বিস্তৃত, উদার—শিল্পীর আত্মস্বভাবের স্বাধীনতার অবকাশ তার মধ্যে আছে। আসলে মানুষের মন বা শিল্পীর আত্মস্বভাব, তার অস্তঃপ্রকৃতি জড়বস্তু নয়। সুতরাং গূঢ় অর্থে সাহিত্য নৈসর্গিক নিয়মের অধীন হলেও, সে নিসর্গের শুধুমাত্র যন্ত্র নয়। তার মধ্যে মনের স্থান আছে, আছে স্রষ্টার আত্মস্বভাবের আপন নিয়মের অবকাশ। বঙ্কিমচন্দ্র জড়বাদী সাহিত্যিক ছিলেন না। জড়বাদীরা শিল্পীর আত্মস্বভাবের অধিকারকে মানেন না। বঙ্কিম লীলাবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকও ছিলেন না। কারণ লীলাবাদীরা সাহিত্যকে দেশকালের ঊর্ধ্বে তুলে সাহিত্যকে কেবল শিল্পীর আত্মস্বভাবের লীলা বলে মনে করেন। আসলে, পজিটিভিস্টদের ‘এম্‌পিরিক্যাল’ মতাদর্শ এবং ‘রোমান্টিক’ প্রবণতার সূত্র ধরেই তাঁর মধ্যে এই বিশিষ্ট মানবিকতার উদ্ভব হয়েছিল।

‘শকুন্তলা, মিরান্দা ও দেসদিমোনা’ প্রবন্ধটিতে বাংলা সাহিত্যে তুলনামূলক সাহিত্যালোচনার প্রথম প্রচেষ্টা দেখা যায়। বিশ শতকেও এ সত্য স্বীকৃত— “compari son and analysis are the chief tools of the critic” (Tradition and Individual Talent’ : T. S. Eliot) আবার ‘ঈশ্বর গুপ্তে’র সমালোচনায় যেমন তার রসবাদী মনের সরস দিকটি উদ্‌ঘাটিত হয়েছে তেমনি দীনবন্ধু মিত্রে’র সাহিত্যালোচনায় অখণ্ড মানব স্বভাব সম্পর্কে সমগ্র দৃষ্টির পরিচয় মেলে“রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে, ছেঁড়া তোরাপ, কাটা আদুরী, ভাঙা নিমচাদ আমরা পাইতাম।”

‘বাঙালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’-কে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘ম্যানিফেস্টো’। এখানে যুগনায়ক প্রাবন্ধিকের সমাজসচেতন মনের পরিচয় উদ্‌ঘাটিত। ‘লোকরহস্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি ক্ষুদ্র বা অণু-রচনার সমষ্টি। কিন্তু ভাবে ও ভাষায় আন্তরিক। শিক্ষিত বাবু-সম্প্রদায়ের প্রতি অম্লাক্ত ব্যঙ্গের প্রকাশ যেমন এখানে আছে, তেমনি ‘ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল’, ‘গৰ্দ্দৰ্ভ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে পশুর মধ্যে মনুষ্যভাবের আরোপ অপরূপ রূপকে আচ্ছাদিত করেছেন। এর মধ্যে ‘কঙ্কাবতী’র লেখক ত্রৈলোক্যনাথের আসন্ন পদধ্বনিও যেন শোনা যায়। ‘‘ইংরাজস্তোত্র’ ‘বাবু’তে জাত্যাভিমানের জ্বালা ব্যঙ্গের স্পর্শে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে : “(হে ইংরেজ) আমার স্পীচ্ শুন, আমার এশে পড়, আমায় বাহবা দাও,—আমি তাহা হইলে সমগ্র হিন্দুসমাজের নিন্দাও গ্রাহ্য করিব না” আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৭ ॥” (ইংরাজ স্তোত্র’)। এই পদলেহনকারী ব্যক্তির পরিচয় ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’ রচনায় বিবৃত।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধ:

ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধের সূচনাও বঙ্কিমের হাতে। এই ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধ তথ্য-বিনির্ভর এবং যুক্তি-রিক্ত। ব্যক্তিরস এবং ব্যক্তির স্বগত গুঞ্জরণই সেখানে মুখ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকাস্ত’-এর দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যেও দুস্প্রাপ্য। বর্তমানে ‘কমলাকান্তে’র তিনটি অংশঃ ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৪টি নিবন্ধ), ‘কমলাকান্তের পত্র’ (৫টি নিবন্ধ) এবং ‘কমলাকান্তের জোবানবন্দী’ নামে একটি অংশ। বইটির প্রথম সংস্করণ ও প্রকাশকাল ১৮৭৫ খ্রীঃ, নাম ছিল তখন ‘কমলাকান্তের দপ্তর, প্রথমভাগ।

আফিঙ্খোর ব্রাহ্মণ কমলাকান্ত কার ভাব-সন্তান, সেই উৎস খুঁজতে পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেক সমালোচক : De Quincey-র ‘Confessions of An opium eater, Addison-এর ‘Coverly Papers’ Dickence-এর ‘Pickwick Papers’-এ মামলা অংশে Sam Waller-এর জবানবন্দীর অংশ প্রভৃতি। কিন্তু প্রকৃত বিচারে কমলাকাক্ত শুধু তার স্রষ্টার হৃদয় যন্ত্রণার দোসর, তার পূর্বজ কেউ নেই।

কমলাকান্তের মধ্যে পাণ্ডিত্যের যে পরিচয় পরিস্ফুট, তা খুব অকিঞ্চিৎকর নয়। কিন্তু তা যেন উপরি পাওনা। আসল প্রাপ্তি সাহিত্যস্রষ্টা, স্বাদেশিক, হিউমারিস্ট, কবি-মনের বহু বিচিত্র রামধনু-ব্যক্তিত্বের দর্শনলাভ। একটি ত্রিশী কাচ বা প্রিজমে’র মতোই কমলাকাত্তের স্বচ্ছ নানায়তনিক মনটি এই প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্ত। তার দৃষ্টিতে কখনও “মনুষ্যমাত্রেই পতঙ্গ” (“আমার মন’) যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বিভিন্ন বহ্নিতে প্রজ্জ্বলন্ত, কখনও বা তার উপলব্ধি : “প্রীতি সংসারে সর্ব্বব্যাপিনী— ঈশ্বরই প্রীতি—প্রীতিই আমার কর্ণে এক্ষণকার সংসারে সংগীত” (‘একা’)। আবার সব বুঝেও কখনও বা হাহাকার “আমি চিরকাল আপনার রহিলাম পরের হইলাম না। এইজন্যই পৃথিবীতে আমার সুখ হইল না (‘আমার মন’)।” এর মধ্যেই কমলাকান্তের কবি-মন হালকা সুরে ‘বসন্তের কোকিল’ কে? ব্যাখ্যা করে, ‘ফুলের বিবাহ’ দিয়ে তির্যক ব্যঙ্গে ‘বড়বাজারে’ মনুষ্য সমাজের বাজার দর কষতে থাকে : ‘Experimental Indology’, ‘সাহিত্যের বাজার’, ‘যশের ময়রাপটি পার হতে হতে দেখে একখানি দোকান—একমাত্র যেখানে সুযশ বিক্রয় হয়—বিক্রেতা কাল, মূল্য জীবন’।

বিষয়ের দিক থেকেও কমলাকান্তের মন বহুস্পর্শী। এখানে ‘বিড়ালে’র মুখ দিয়ে সুতীক্ষ্ণ শ্রেণীবৈষম্যের ব্যাখ্যা যেমন লভ্য, তেমনি আছে ভাবাবেগের উত্তাপ। রিচার্ড জে ফারিঙ the pegions at the British Museum’ রচনায় মিউজিয়ামের সামনে সূর্যের আলোয় উপবিষ্ট পায়রাগুলির বর্ণনা করেছিলেন এইভাবে : “In the sunshine, by the shady verge of woods, by the waters where the wild dove sips, their alone will thought be found.”

আর কমলাকাস্ত ‘ফুলের বিবাহ’ সংবাদ দেয় এইভাবে : “গোলাব তখন বাতাসের সঙ্গে নাচিয়া নাচিয়া, হাসিয়া হাসিয়া, লাফাইয়া লাফাইয়া খেলা করিতেছিল, বিবাহের নাম শুনিয়া আহ্লাদিত হইয়া কন্যার বয়স জিজ্ঞাসা করিল। ভ্রমর বলিল, ‘আজ কালি ফুটিবে’।” এই চিত্ররূপ কমলাকান্তের শিল্পী-মনকেই প্রকাশ করে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যরীতি :

শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের লক্ষণ: “Is a kind of lucky dip into the experience or into fantasy-often into both. The ordinary essayist dips again and again, and seldom brings up anything worth showing to his neighbors.” (Lind). কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র “dipped again and almost invariably come back with a parcel of treasure.” প্রছন্ন পরিহাসরস, ভাষার প্রসাদগুণ, কাব্যধর্মিতা বঙ্কিম-প্রবন্ধের কালজয়িতার স্মারক।

  • (ক) শব্দচয়নে উদারতা ও পরিমিতিবোধ তার গদ্যে লক্ষ্য করা যায়। আবার শব্দমোহ ও প্রগতিমাধুর্যের বিপদ থেকে আত্মরক্ষার প্রবণতাও দেখা যায়।
  • (খ) দুরচ্চার্য শব্দ, বৃথা অনুপ্রাস, অস্পষ্টতা ও অর্থাভাস বর্জনের চেষ্টা আছে।
  • (গ) প্রশ্নাত্মক বাক্য ব্যবহারের দ্বারা পাঠকমনে উৎসুক্য ও সংশয় জাগ্রত রাখার কৌশলও তার গদ্যরীতির মধ্যে দেখা যায়।
  • (ঘ) সংযোজক অসমাপিকা ক্রিয়াপদের সংখ্যা হ্রাস ও সমাপিকা ক্রিয়াপদের অধিক ব্যবহারে বাক্যে দ্রুততা সৃষ্টি করা হয়েছে।
  • (ঙ) অন্তরঙ্গ বর্ণনাভঙ্গির দ্বারা পাঠকের সঙ্গে রচয়িতার সহৃদয়-সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা দেখা যায়।
  • (চ) নাটকীয় আকস্মিকতার দ্বারা পাঠক-চিত্তকে সচকিত করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহ দেখা যায়।