বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক বা গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাসগুলির মধ্যে বঙ্কিমপ্রতিভার উজ্জ্বলতম দিকটিকে লক্ষ্য করা যায়। তার সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) প্রসিদ্ধ। ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩) ও ‘রাধারাণী’ও (১৮৭৬) গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস; কিন্তু এই দুটিতে বঙ্কিমপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর তেমন নেই।

সামাজিক উপন্যাস রচনার পেছনে মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্তলােকে তৎকালীন বাঙলাদেশের সমাজ-চেতনার দিক সবচেয়ে বেশি কাজ করে গিয়েছে। যখন তিনি ‘বিষবৃক্ষ’ রচনা করেন তাঁর পুর্বে তিনখানি রােমান্সধর্মী উপন্যাসের রচনাকর্ম তিনি সমাধা করেছেন এবং বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠাও হয়েছে। তখনকার সমাজসমস্যাই যেন তাকে সামাজিক উপন্যাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করল, কিন্তু সামাজিক উপন্যাস হলেও বিষবৃক্ষের মধ্যে তার রােমান্টিক মনােভাবের একটা স্পষ্ট স্বাক্ষর লক্ষ্য করা যায়। ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পাঁচবছরকালই তিনি সামাজিক উপন্যাস রচনায় আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, এই সময়ের মধ্যে তিনি ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ নামে দুটি রােমান্সধর্মী উপন্যাসও রচনা করেছিলেন। কিন্তু তখন মনের কেন্দ্রমূলে যে কাজ করে গেছে পারিবারিক জীবনের সংঘাত-সমস্যা, তা স্পষ্ট বােঝা যায়, যখন দেখি ‘চন্দ্রশেখরে’র মূল উপাদান রােমান্টিক হলেও পারিবারিক জীবনের বেদনাতুর সংকট মুহূর্তের কথাই সেখানে জটিলতার সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গতঃ এটাও মনে রাখতে হবে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসও অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিকের স্পর্শ থেকে মুক্ত নয়। শুধু ‘ইন্দিরা’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এই স্পর্শের প্রভাব থেকে বহু পরিমাণে মুক্ত।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের সিংহভাগই ‘ঐতিহাসিক-রােমান্স’ নামে চিহ্নিত হলেও বস্তুতঃপক্ষে একমাত্র রাজসিংহ’ব্যতীত অপর কোন উপন্যাসেই ইতিহাস প্রধান স্থান অধিকার করতে পারেনি। এই সমস্ত রােমান্সধর্মী উপন্যাসেও গার্হস্থ্যজীবন এবং জীবনের চিত্রই প্রাধান্য লাভ করেছে। কিন্তু যেহেতু এদের কাহিনী অতীতাশ্রয়ী এবং বাস্তব পটভূমির সঙ্গে সম্পর্ক রহিত, এই কারণে এদের গার্হস্থ্যধর্মী ও পারিবারিক উপন্যাস বলে স্বীকার করা যায় না। শ্রীপরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তার সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, “একথাও অবশ্য স্বীকার্য যে বঙ্কিমচন্দ্র-রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং রােমান্সগুলিতে ঐতিহাসিক পটভূমিকা থাকলেও কাহিনীভুক্ত নরনারীর পারস্পরিক ও গার্হস্থ্যধর্ম প্রধান হয়ে উঠেছে। তৎসত্ত্বেও এগুলিতে একদিকে ইতিহাসের টানা এবং অন্যদিকে কল্পনায় যে কাহিনী গ্রথিত হয়, তাতে সমসাময়িক পারিবারিক জীবনের বিশ্বাসযােগ্য চিত্র অনেক সময়ই থাকে না—তাই গার্হস্থ্য জীবন-কাহিনী বিবৃত হওয়া সত্ত্বেও ওগুলিকে সামাজিক ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাসরূপে গ্রহণ করা চলে না।”

ইন্দিরা আকারে ছােট এবং প্রকারে একটা বড় গল্প। উপন্যাস-সুলভ কাহিনীর জটিলতার ও কল্পনার সুগভীর ঐশ্বর্য এর মধ্যে নেই। পরিহাসরসিক বঙ্কিমচন্দ্রের কৌতুকরস সৃষ্টির দক্ষতাই এই গ্রন্থের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। দাম্পত্য-জীবনের একটা রসসন্ধানী দৃষ্টিই যেন বঙ্কিমচন্দ্রকে এই রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল; কিন্তু কাহিনীর ক্ষুদ্র অবয়বের মধ্যে একটি বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষরও লক্ষ্য করা যায়। এর নায়িকা ইন্দিরাও নিজের জীবন কাহিনীর মধ্যে নিজস্ব বুদ্ধির একটা অম্লান পরিচয় রেখে গেছে। গ্রন্থের নায়িকার মুখেই কাহিনী বিবৃত হয়েছে, এবং মনে হয়, ইন্দিরার রমণী-হৃদয়ের সমস্ত মাধুর্যকে বঙ্কিমচন্দ্র যেন অনুভব করে তার শিল্পে গেঁথে তুলেছে। এতে জীবনের কোনাে সমস্যা নেই বটে, কিন্তু জীবনের এক সুন্দর চিত্র আছে। আঙ্গিক রীতিতে এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটি বাঙলা সাহিত্যে একটা অভিনবত্বের গৌরব নিয়ে এসেছিল।

‘বিষবৃক্ষ’কেই বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বপ্রথম সমাজিক উপন্যাস বলা যায়। এই উপন্যাসে তিনি যেমন প্রেমের একটা সমস্যাজটিল প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তেমনি তার সঙ্গে একটি নীতিবাদের প্রশ্ন জড়িয়ে দিয়েছেন। এই গ্রন্থের নায়ক নগেন্দ্র দত্ত এবং তার পত্নী সূর্যমুখী রূপে ও গুণে বহু নারীর অগ্রগণ্যা। কিন্তু দৈববশে কুন্দকে দেখে রূপমুগ্ধ নগেন্দ্র দত্ত তাকে বিয়ে করে নিজেই নিজের সংসারে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করলেন। সেই বৃক্ষের মূলদেশে আরও বিষ সঞ্চারিত করে দিল হীরা ও দেবেন্দ্র। কাহিনীর মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে এই হীরা-দেবেন্দ্রর উপস্থিতিতে। নীতিবাদী বঙ্কিম জীবনশিল্পের প্রভাবে কুন্দের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েও কুন্দকে অবৈধ প্রেমের শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুর অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। কিন্তু ‘বিষবৃক্ষ’-এর শিল্পী বঙ্কিমের সাক্ষাৎ লাভ করি সেইখানে, যেখানে তিনি পুরুষ-নারীর প্রেমমাধুর্যপূর্ণ হৃদয়বৃত্তির ছবিগুলােকে উজ্জ্বল বর্ণে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। বঙ্কিম বলেছেন, “বিষবৃক্ষে নানা ফল ফলে। নগেন্দ্রনাথে যে বিষফল ফলিল, তাহা মানসিক, দেবেন্দ্রনাথে যে ফল ফলিল, তাহা প্রধানত শারীরিক। অসংযম সকল ক্ষেত্রেই যে দেহে ফল ফলায় তাহা নয়। দেবেন্দ্রনাথে উহা দেহেই ফলাইয়াছিল।” কাহিনীতে কিছু অলৌকিক ঘটনার সংযােজন এই উপন্যাসের শিল্পগুণের হানি ঘটিয়েছে।

‘রজনী’ বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ‘রজনী’র ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলেছেন যে ইংরেজ ঔপন্যাসিক লিটন-রচিত ‘লাস্ট ডেস অব পম্পি’ নামক উপন্যাসের নিদিয়া নান্নি ফুলওয়ালীর চরিত্রটিকে অনুসরণ করে তিনি এই উপন্যাসের নায়িকা চরিত্র রচনা করেছেন। তার সঙ্গে যােগ করেছেন একটা মানসিক ও নৈতিক তত্ত্ব। বঙ্কিম নিজে এই গ্রন্থটিকে উদ্দেশ্যমূলক বললেও শিল্পসৃষ্টির অপরূপত্নে এটি একটি চিরন্তন মর্যাদা অর্জন করেছে। বঙ্কিম এই উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন যে, রূপ দেখতে না পারলেও যেন রূপের তৃষ্ণা মানব মনে স্বাভাবিক, তেমনি রূপের মত স্পর্শও মানব-মানবীর মনে প্রেমবৃত্তির উজ্জীবন ঘটায়। অন্ধ যুবতীর মনস্তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণে বঙ্কিম-প্রতিভার একটি কালজয়ী রূপ এই উপন্যাসে অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে। রজনীর প্রেমমধুর হৃদয় মাধুর্য, লবঙ্গলতার প্রেম-জগতের তীব্র গভীর দ্বন্দ্ব, অমরনাথের ত্যাগদীপ্ত পৌরুষ বঙ্কিম-প্রতিভার বিস্ময়কর সৃষ্টি। এই উপন্যাসে প্রেমের তীব্রতার সঙ্গে সমাজনীতির সংঘর্ষের একটি শিল্পসুন্দর অতুলনীয় চিত্রকেই আমরা লাভ করি। তেজস্বিনী লবঙ্গলতা সমাজ-অনুমােদিত সহজ পথেই অমরনাথকে চেয়েছিল, চোরের কলঙ্কিত রূপে সে অমরনাথকে চায় নি। তার প্রেমের এই বলিষ্ঠতাই আমাদের মুগ্ধ করে। তিনটি প্রধান চরিত্রের মুখে উত্তম-পুরুষে কাহিনী বর্ণনা এই উপন্যাসের আঙ্গিকগত বিশিষ্টতা।

‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। সমাজ জীবনের একটি সমস্যাই এই উপন্যাসের উপজীব্য। বাঙলা সাহিত্য সার্থক সামাজিক উপন্যাসের ভিত্তিপত্তনও হয় এই ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ বঙ্কিম স্বপ্নজগৎ ত্যাগ করে সত্যের সংসারে অবতরণ করেছেন, দেশকালের দূরদর্শিতার সুযােগ ছেড়ে তিনি চারপাশের জগতের জটিলতাকে গ্রহণ করেছেন। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের রােমান্স-সুলভ অতিপ্রাকৃতের উপস্থাপনা একেবারেই নেই, অধিকন্ত মনস্তত্ত্বের দ্বন্দ্বজটিল রূপ এমন একটা শৈল্পিক সিদ্ধিতে মণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে যে তা বাঙলা সাহিত্যের উপন্যাসের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। রমণীর রূপ পুরুষজীবনে নিয়তিরূপিণী, কিভাবে তা অনতিক্রম্য ট্র্যাজিডির পথে পুরুষকে টেনে নেয় এবং সর্বধ্বংসী শূন্যতার কি প্রচণ্ড হাহাকারে পুরুষজীবন ভরে ওঠে, তা এই উপন্যাসের উপজীব্য। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ইউরােপীয় ট্রাজেডির মধ্যে ভারতীয় জীবনযাত্রার এক আশ্বাসময় প্রশাস্তিকে রূপময় করে তুলেছেন। সর্বরিক্ততার পরেও নায়ক গােবিন্দলাল ভ্রমরাধিক ভ্রমর ক লাভ করেছে। নারীব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে ভ্রমর বাঙলা সাহিত্যে একটা চিরস্মরণীয় চরিত্র। বাস্তব জীবনের বাসনা-কামনার সত্যতার দিক দিয়ে রােহিণী চরিত্রের তুলনা হয় না। সমাজিক নীতিগত দৃষ্টিকোণ দিয়ে বঙ্কিম রােহিণীকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করালেন বটে, কিন্তু তার প্রাণপ্রাচুর্যটুকু রােহিণী-চরিত্রে সঞ্চার করিয়ে শিল্পী বঙ্কিম অমর হলেন। কাহিনীর নাট্যগুণসমৃদ্ধ বিকাশ, বাইরের শক্তি ও চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধের সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি, গভীর বিশ্লেষণ, দৃশ্যগুলির সাংকেতিক ব্যঞ্জনা, বর্ণনার তীক্ষ্ম বাস্তবতা ইত্যাদি দিক থেকে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ বাঙলা উপন্যাস সাহিত্যে এখনও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

‘রাধারাণী’তে জীবন সমস্যার কোন চিত্র নেই, যা আছে সে শুধু সাধারণ জগতের সহজ সরল একটা প্রেমের কাহিনী। বঙ্কিম প্রতিভার কোন স্বাক্ষরই তাতে দেখা যায় না। বাঙলাদেশের সামাজিক ভিত্তিতে এর কাহিনী স্থাপিত হলেও বঙ্কিমের স্বভাবসুলভ রােমান্সের রং তাতে লেগেছে।

সামাজিক উপন্যাসের আলােচনার শেষে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজচেতনাকে আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্রের যে সহানুভূতিশীল শিল্পীমন ছিল এবং সেই সঙ্গে সুগভীর জীবনবােধের অধিকারী তিনি ছিলেন তা বােঝা যায় যখন তিনি মানব-মানবীর প্রেমকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে উপলব্ধি করেছেন এবং চরিত্রচিত্রণের মাধ্যমে বাঙলাদেশের রসপিপাসু হৃদয়গুলাের কাছে অন্তরজগতের শাশ্বত বার্তা শােনালেন। পুরুষ ও নারীর এই চিরন্তন প্রেমবৃত্তিকে অবলম্বন করেই তিনি সামাজিক সমস্যারও অবতারণা করেছেন। প্রেমের দুর্দম শক্তিকে তিনি যেমন স্বীকৃতি দিয়েছেন তেমনি বৈধব্য জীবনের অপরিতৃপ্ত প্রেম-পিপাসাকেও বাস্তবরূপ দিতে দ্বিধাবােধ করেন নি। এখানেই তিনি জীবনের সার্থক রূপকার। কিন্তু তার শিল্পী-মন নীতিবাদী-মনের কাছে মাঝে মাঝে পরাজয় স্বীকার করেছে। মনীষী-শ্রেষ্ঠ বন্ধিমচন্দ্র স্বেচ্ছাবৃত সমাজ-শিক্ষকের ভূমিকা থেকে সরে আসতে পারেননি বলেই বৃহত্তর সমাজের হিত-চিন্তা থেকে বিরত হতে পারেন নি; এমন কি তার শিল্পীসত্তা একটু ক্ষু্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এটুকু কঠোরতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। রােহিণীর প্রতি পুরােপুরি সহানুভূতিশীল থেকেও কেবল সমাজের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য নির্মমভাবে তার মৃত্যুবিধান করতেও দ্বিধাবােধ করেননি। কিন্তু তা হলেও বলতে হয় যে তার মনে সমাজবৃত্তির গুণে রক্ষণশীলতা থাকলেও এবং তার প্রভাব মাঝে মাঝে তার উপন্যাসের শিল্পগুণ ক্ষুন্ন করলেও, তিনি মূলতঃ শিল্পী। এবং যথার্থ শিল্পী বলে পুরুষ ও নারীর প্রেমকে পরিপূর্ণ জীবনবােধ দিয়ে উপলব্ধি করে তাকেই চিরকালের সাহিত্যের সামগ্রী করে তুলেছেন।