কমলাকান্ত ও বিড়ালের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ধনী-দরিদ্রের সামাজিক অসাম্য সম্বন্ধে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ অবলম্বনে আলোচনা করো।

‘সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দণ্ডবিধান কর্তব্য।”—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে চুরির করার মূল কারণ ও তা দুরীকরণের যে পথনির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা উপরোক্ত উদ্ধৃতির আলোকে বিচার করো।

‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ত্রয়োদশ সংখ্যক রচনা। এই রচনাটি কমলাকান্তের দপ্তরে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। দপ্তরের অন্যান্য রচনার তুলনায় এই রচনাটির প্রসিদ্ধি অপেক্ষাকৃত অধিক। নানা দিক দিয়ে ‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। এর মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র সহজ সুরে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা কঠিন সমস্যা আলোচনা করে তার অন্তঃস্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাম্য’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সে সময়ে বর্তমান সম ভোগবাদ (communism) এ দেশে প্রচারিত হয়নি— বঙ্কিমচন্দ্র কার্ল মার্কস প্রমুখ চিন্তানায়কের রচনার সহিত অবশ্যই পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি অন্যান্য সমাজতন্ত্রবাদী বা সাম্যবাদী লেখকদের রচনা অল্পবিস্তর পড়েছিলেন। বিশেষত ফরাসি বিপ্লবের সময়ে রুশো প্রমুখ সমাজদ্রষ্টাসকল মানুষের সমান অধিকার বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত যে নূতন আদর্শ প্রচার করেন, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক চিন্তাশীল পুরুষদের মতই বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি প্রধানত বাঙলাদেশের দরিদ্র কৃষকদের দুরবস্থা দেখে ব্যথিত হয়ে ‘সাম্য’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

‘দপ্তরের বর্তমান সংখ্যাটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের বিড়ালের মুখ দিয়ে সাম্যতন্ত্রের কয়েকটি কথা বলিয়েছেন। বিড়ালের অনেক কথার মধ্যে আমরা ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ বা ‘সাম্য’ গ্রন্থের রচয়িতা বঙ্কিমের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই; তবে তিনি এই সংখ্যাটির বিষয়বস্তুকে ভাবগম্ভীর করে তোলেননি। প্রবন্ধের গুরুগাম্ভীর্য বা পাণ্ডিত্যধর্মিতা এর মধ্যে নেই। উপস্থাপনা ও পরিবেশন নৈপুণ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বিষয়বস্তুকে সর্বশ্রেণির পাঠকের নিকট উপভোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন।

সংক্ষিপ্তসার : আহার সামগ্রী প্রস্তুত হতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। কমলাকান্ত চক্রবর্তী রাত্রে চারপায়ার উপর শুয়ে হুঁকাহস্তে অর্ধসুপ্ত অবস্থায় চিন্তা করছিলেন, তিনি যদি কমলাকান্ত না হয়ে নেপোলিয়ান হতেন, তবে ওয়াটার্লু যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন কিনা। এমন সময় নিকটে শব্দ হল ‘মেও’। কমলাকান্ত ভাবলেন যে ডিউক অব ওয়েলিংটন বোধহয় বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। আবার শব্দ হল ‘মেও’। কমলাকান্ত এবার চক্ষু খুলে একটি ক্ষুদ্র বিড়ালকে দেখতে পেলেন। বিড়ালটি প্রসন্ন গোয়ালিনী প্রদত্ত দুধ পান করে পরম তৃপ্তিতে কমলাকান্তের প্রতি প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপে ডাকছে। পাছে বিড়াল কাপুরুষ ভাবে, এই ভয়ে কমলাকান্ত বহু খুঁজে একটি লাঠি সংগ্রহ করে বিড়ালের প্রতি ধাবিত হলেন। বিড়াল বিশেষ ভীত না হয়ে শুধু এক পাশে সরে বসল। কমলাকান্ত নিজ শয্যায় ফিরে এসে ‘আফিমের কল্যাণে বিড়ালের ‘মেও’ ডাকের তাৎপর্য স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেন।

বিড়ালটি তার ‘মেও’ ডাকের মধ্য দিয়ে যেন একথাই বলতে চেয়েছে, দুধপান করবার মতো সামান্য একটি কার্যের জন্য এইরূপ হৈ চৈ মারামারি করে বিশেষ কোনো লাভ নেই। সংসারে ক্ষীর, সর, দুধ, দই প্রভৃতি ভালো ভালো জিনিসের উপর শুধু মানুষের অধিকার থাকবে না, বিড়ালের থাকবে, এটা অত্যন্ত অন্যায় বিচার। মানুষের যেমন ক্ষুধা পিপাসা আছে, বিড়ালেরও তেমনি ক্ষুধা আছে একথা মানুষ বুঝতে পারে না কেন ? মনুষ্যসমাজে বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের ফল দিন দিন যেরূপ হচ্ছে তাতে তিনি নিশ্চয় এতদিনে বুঝতে পেরেছেন যে অধুনা চতুষ্পদ বিজ্ঞ জন্তুর নিকট উপদেশ গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় নেই। সুতরাং কমলাকান্ত যেন তার নিকট হতে নিবিষ্টমনে এখন উপদেশ শোনেন। তার প্রথম উপদেশ, সে দুধ খেয়েছে বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে কলাকান্তকেই পরোপকারে সাহায্য করেছে। পরোপকার মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই ধর্মলাভে সে কমলাকান্তকে সাহায্য করেছে।

বিড়াল আরও বলল যে সে চুরি করে দুধ খেয়েছে সত্য, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় এ কাজ করেনি। খেতে না পেয়ে সে চুরি করেছে। প্রচুর পরিমাণে খেতে পেলে সে কখনও দুধ চুরি করত না। এ সংসারে যাহারা বড়ো বড়ো সাধু বলে পরিচিত, তারা চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তারা ধনসম্পদ সঞ্চয় করে, কিন্তু তার সামান্য অংশও গরিব লোককে দেয় না। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েই গরিব লোক চুরি করে। সুতরাং চুরির মূল কারণ এইসব তথাকথিত সাধু। চুরির জন্য এদেরই দণ্ড দেওয়া উচিত। সামান্য একটু খাবারের সন্ধানে বিড়াল প্রাচীরে প্রাচীরে করুণ আর্তনাদ করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আর্তনাদই সার। তার প্রতি কেউ সামান্যতম দয়া প্রদর্শনও করে না। করবে কেন ? যাদের পেট ভরা, গরিবের জন্য দয়া প্রদর্শন করাকে তারা লজ্জাকর মনে করে। বড়োলোকের জন্য তাদের সকল সহানুভূতি ঝরে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই দুধ যদি সে না খেয়ে কোনো শিরোমণি বা ন্যায়ালংকার উপাধিধারী লোক খেতেন, তবে তাঁদের জন্য আরও দুধের ব্যবস্থা করা হত। বড়োলোক হলে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা গরিবের চেয়ে বেশি হবে, এমন কোনো কথা নেই। আসলে তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির অভ্যাস। গরিবের জন্য তাদের অন্তরে সামান্যতম সহানুভূতি নেই।

অবশ্য বড়োলোকের পোষা সোহাগের বিড়ালের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। সোহাগী বিড়ালের প্রচুর আদর যত্ন করা হয়। রাস্তার বিড়ালের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। খেতে না পেয়ে তাদের উদর কৃশ হয়ে যায়, অস্থি আঙ্গুলে গোনা যায়, লেজ ঝুলে পড়ে, জিহ্বা বের হয়ে পড়ে। তার এরূপ শোচনীয় অবস্থা দেখে কারও দয়া হয় না। চোরের দণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু নির্দয়ের দণ্ডের ব্যবস্থা নেই। দরিদ্র যদি অভাবের তাড়নায় আহার সংগ্রহ করতে যায়, সেজন্য তাকে দণ্ড পেতে হয়, অথচ ধনী দিনের পর দিন ধনের পাহাড় জমাচ্ছে, সেজন্য সে কোনো দণ্ড পায় না। মানবসমাজে রীতিনীতি অতি বিচিত্র। সুতরাং এ অবস্থায় গরিবের পক্ষে চুরি করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।

কমলাকান্ত ভাবিলেন যে বিড়ালের কথাগুলি সমাজতান্ত্রিক। এইসব কথা হতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ধনী যদি ইচ্ছানুসারে ধন সঞ্চয় না করতে পারে কিংবা ধন সঞ্জয় করে চোরের জন্য ভোগ না করতে পারে, তবে সমাজের ধনবৃদ্ধি হবে না। ধনবৃদ্ধি না হলে সমাজের মঙ্গল হবে না। বিড়াল বলল যে, সমাজের ধনবৃদ্ধির অন্য নাম ধনীর ধনবৃদ্ধি। এতে গরিবের কোনো মঙ্গল নেই। তখন কমলাকান্ত তাকে বুঝাতে চাইলেন যে ধনীর ধনবৃদ্ধি ছাড়া সমাজের কোনো উন্নতি বা মঙ্গল হবে না। বিড়াল তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারল না। গরিবলোক যদি খেতে না পেল, তবে সমাজের উন্নতিতে তার কি লাভ ? কলমকান্ত বুঝতে পারলেন, বিড়ালটির তর্কশাস্ত্রে অধিকার আছে। সুতরাং তর্ক করে একে কিছু বুঝানো যাবে না। তিনি বললেন যে সমাজের উন্নতিতে গরিবের প্রয়োজন না থাকতে পারে, কিন্তু ধনীর আছে। সুতরাং এ অবস্থায় গরিব যদি চুরি করে, তবে তার দণ্ডবিধান করা কর্তব্য।

এর জবাবে বিড়াল বলল, চোরকে দণ্ড কেন, ফাঁসি দিলেও সে আপত্তি করবে না। তবে সেই সঙ্গে একটি নিয়ম করতে হবে যে যিনি বিচারক চোরকে ফাঁসি দিবেন, তাঁকে পূর্বে তিনদিন উপবাস করতে হবে। তাতেও যদি তাঁর চুরি করে খাবার ইচ্ছা না জন্মে, তবে তিনি অনায়াসে দণ্ড দিতে পারবেন।

বিড়ালের কথা শুনে কমলাকান্ত হতবুদ্ধি। তিনি ঠিক করলেন, তর্কে পরাজিত হবার পর গম্ভীরভাবে উপদেশ দেওয়া ভালো। তিনি গম্ভীরভাবে বিড়ালকে বললেন যে, তার এই সব কথা অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ। এর আলোচনাও পাপ। বিড়াল এইসব কথা চিন্তা না করে ধর্মকর্মে মন দিলে তার আত্মিক উন্নতি হবে। প্রয়োজন হলে তাঁর নিকট হতে নিউম্যান ও পার্কের ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ যেন সে নিয়ে যায়। সে এখন নিজের জায়গায় ফিরে যাক এবং কারও খাদ্যদ্রব্য পুনরায় যেন চুরি না করে। বিড়াল বলল যে সে ক্ষুধা অনুসারে কমলাকান্তের কথা বিবেচনা করবে।

বিড়াল চলে গেলে কমলাকান্তের মনে গভীর আনন্দ হল, কারণ তিনি একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হতে আলোকে আনতে পেরেছেন।