প্রশ্নঃ বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের ক্ষমতা বলয়ের সূচনা হয় পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে। আর তাদের ক্ষমতার ভিত রচিত হয় বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে। কারণ মীর জাফরের পতনের পর মীর কাসিম বাংলার নবাব নিযুক্ত হন। তার অনমনীয় মনােভাব, রাজস্বসহ ইংরেজদের বিভিন্ন দাবি পূরণে অস্বীকৃতি এবং তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাপ্রীতি ইংরেজদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।

বক্সার যুদ্ধের কারণঃ

১. মীর কাসিমের স্বাধীনচেতা মনােভাবঃ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর জাফরের পতনের পর ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে সিংহাসনে আরােহণ করেও মীর কাসিম ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি ইংরেজ কোম্পানির দেয়া সব ঋণ পরিশােধ করে তাদের প্রভুর আসন থেকে সাধারণ ব্যবসায়ীতে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এতে ইংরেজদের সাথে তার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

২. রাজধানী স্থানান্তরঃ মীর কাসিমের সকল কার্যক্রম ইংরেজরা তদারক করত। তাই ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য তিনি তাদের সম্মতি ব্যতীতই রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। এতে কোম্পানির সাথে মীর কাসিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

৩. প্রশাসন ও অর্থনীতিঃ ক্ষমতা গ্রহণ করেই মীর কাসিম রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামাে ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে সক্রিয় হন। এজন্য তিনি প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন এবং বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করেন। তার এসব কার্যকলাপ ইংরেজদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করে।

৪. সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠনঃ মীর কাসিম সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেনাবাহিনীতে আর্মেনিয়ার সৈন্য ভর্তি করে গুচী খান ও মুহাম্মদ তুর্কি খানকে সেনাবাহিনী সংগঠনের দায়িত্ব দেন। তারা গােলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীকে ইউরােপীয় পদ্ধতিতে গড়ে তােলেন। নবাবের এসব পদক্ষেপ ইংরেজরা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করতে থাকে।

৫. ফরমানের অবমাননাঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট ফররুখ সিয়ার ও পরে শাহ আলম কর্তৃক বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক যে সুবিধা লাভ করেছিল, মীর কাসিম তাদের সে সুবিধা সংকুচিত করেন। ইংরেজরা মীর কাসিমের এ পদক্ষেপকে তাদের অবমাননা মনে করলে নবাবের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক খারাপ হয়।

৬. অবাধ বাণিজ্যের প্রচলনঃ দেশীয় বণিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য মীর কাসিম বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্যের সুযােগ দেন। এতে দেশীয় বণিকগণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করে। নবাবের এ ব্যবস্থা ইংরেজদের ইচ্ছা ও স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

৭. অবৈধ বাণিজ্যঃ প্রদত্ত দস্তকের অপব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানির নামে কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে অবৈধ বাণিজ্য করতে থাকে। এতে নবাব বাধা দিলে সম্পর্কের অবনতি হয়।

৮. ভ্যান্সিটার্ট-এর মধ্যস্থতাঃ ইংরেজদের সাথে নবাবের সম্পর্ক সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌছলে গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট মধ্যস্থতা করার জন্য মুঙ্গের গমন করেন। তার মধ্যস্থতার উদ্যোগ ব্যর্থ হলে যুদ্ধ অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।

৯. এলিসের মনোভাবঃ Ramsay Muir তার Making of British Indig গ্রন্থে লিখেছেন, “এলিস নিজের এবং বন্ধু-বান্ধবদের অবৈধ অর্থোপার্জনের পথে বাধা দূর করার জন্য মীর কাসিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে বদ্ধপরিকর হন।”

বক্সার যুদ্ধের ঘটনাবলিঃ ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মেজর এ্যাডামসের নেতৃত্বে ইংরেজগণ এক হাজার ইউরােপীয় ও চার হাজার দেশীয় সৈন্য নিয়ে মীর কাসিমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মীর কাসিম ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিহত করলেও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অযােধ্যায় পলায়ন করেন। অতঃপর তিনি অযােধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌলা ও সম্রাট শাহ আলমের সাহায্য নিয়ে পুনরায় ইংরেজদের সাথে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর বক্সার নামক প্রান্তরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধে ইংরেজরা জয় লাভ করলে বাংলার সর্বশেষ দেশপ্রেমিক নবাবের পতন ঘটে। পরবর্তীতে নবাব মীর কাসিম ও শুজাউদ্দৌলা রােহিলাখণ্ডে পলায়ন করেন এবং সেখানেই নবাব মীর কাসিমের মৃত্যু ঘটে। ফলে সমগ্র বাংলা ইংরেজদের হস্তগত হয়।

বক্সার যুদ্ধের গুরুত্ব/ফলাফলঃ স্যার জেমস স্টিফেন বলেন- The Butle of Buxor deserves for more credit their of Palassey as the origin of the British power of India. অর্থাৎ ব্রিটিশ শক্তির উৎপত্তি হিসেবে ভারতে পলাশী যুদ্ধ অপেক্ষা বক্সারের যুদ্ধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

১. স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক নবাবের পতনঃ বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের ফলে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক নবাবের পতন হয়।

২. মীর জাফরের পুনঃ সিংহাসন লাভঃ বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম সিংহাসনচ্যুত হলে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে মীর জাফর সিংহাসনে পুনঃ অধিষ্ঠিত হয়। এবার নবাবের সৈন্য সংখ্যা হ্রাস এবং নবাবের দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়।

৩. মুসলিম শাসনের অবসানঃ সাময়িকভাবে মীর জাফর ক্ষমতায় বসলেও মূলত এ যুদ্ধের ফলে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং ইংরেজ বেনিয়াদের আধিপত্য সুনিশ্চিত হয়।

৪. ব্রিটিশ শাসনের গােড়াপত্তনঃ বক্সার যুদ্ধের ফলে বাংলা, বিহার ও. উড়িষ্যার শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়। রবার্ট ক্লাইভ গভর্নর হয়ে বাংলায় আসেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৫. আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠাঃ পলাশী যুদ্ধ অপেক্ষা বক্সারের যুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার আদর্শে উজ্জীবিত অধিক সৈন্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে ভারতীয়রা তাদের দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা ও আত্মত্যাগের নজির পেশ করে।

৬. সমগ্র বঙ্গ-ভারতে ইংরেজ শাসনের নিশ্চয়তাঃ বক্সার যুদ্ধ সমগ্র বঙ্গ-ভারতে তাদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতার নিশ্চয়তা দান করে। স্যার-জেমস স্টিফেনের মতে, “বঙ্গ-ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রতিষ্ঠায় বক্সার যুদ্ধ পলাশী যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখে।”

৭. ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ সংগ্রামঃ এ যুদ্ধ ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ সংগ্রাম। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা এ দেশের রাজন্যবর্গের সাথে যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছে তা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; বরং সেসব যুদ্ধ ছিল। সাম্রাজ্য বিস্তারের।

৮. বেতনভােগী কর্মচারীতে পরিণতঃ বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে সম্রাট শাহ আলম ও নবাব শুজাউদ্দৌলা ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদের আজ্ঞাবহ ও কোম্পানি কর্তৃক প্রদেয় বেতনভােগী কর্মচারীতে পরিণত হন।

৯. স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতঃ পলাশী যুদ্ধের চরম পরিণতি বক্সার যুদ্ধ। পলাশী যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা যে ক্ষমতা লাভ করেছিল তা পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত হয় বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে। এ যুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সূর্য দীর্ঘ দু’শ বছরের জন্য। অস্তমিত হয়।

উপসংহারঃ বক্সারের যুদ্ধ মূলত ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী ঘটনা। কারণ এ যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের স্কন্ধে জেঁকে বসে এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছর ভারতীয়দের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে। ভি. এ. স্মিথের ভাষায়- It was this battle, the elumination of an obstincte campaign which determined the British mastery of Bengal.