“চটিয়া ও জগন্নাথ পুরের মন্দির দখল করে দখল না রেখেই চলে গেছে বীরসা। না পেলে তাকে ধরা না পাওয়া গেল তার সাড়া শব্দ। চিরুনি দিয়ে চুল যেমন করে আঁচড়ায়, তেমনি করে জঙ্গল আর পাহাড় খুঁজল পুলিশ”
মহাশ্বেতাদেবী অরণ্যের অধিকার ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ১৮৯৫ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ভারতের ছোটনাগপুর অঞ্চলে বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্ব যে মুণ্ডা বিদ্রোহ স্থান পেয়েছিল, বলা যেতে পারে তার আক্ষরিক অনুসরণ—‘অরণ্যের অধিকার। ইতিহাসের ঘটনাকে অবিকৃত রেখে উপন্যাসখানি রচিত হলেও লেখিকা এর কাহিনি নির্মাণে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। চরিত্রগুলিকে দেখে মনে হবে তারা ইতিহাসের কোনো ব্যক্তি নয়। আমাদের মতোই যাদের মধ্যে দিয়ে সারাক্ষণ স্ফুরিত হতে থাকবে মানব রস। আর প্রায়োগিক দিক প্রমাণ করবে ইতিহাসের অঙ্গনে পদচারণা নয় মানবজীবন সমৃদ্ধ উপন্যাসের অঙ্গনে অধিষ্ঠিত আছি। মরমীয়া কথা শিল্পী মহাশ্বেতাদেবী তাঁর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে মোটের ওপর পাঠককে এক নতুনত্বের আস্বাদ এনে দিয়েছেন।
উপন্যাসের শুরুতেই আছে—“৯ জুন ১৯০০। রাঁচি জেল।” পাঠক সচকিত হয়ে ওঠে। ঘটনার কোনো টানাপোড়েন, নেই মানব জীবনের হাসি-কান্নার কোনো ছন্দায়িত দোল নেই, একেবারেই প্রথম থেকেই সাল তারিখ নির্দিষ্ট রাঁচি জেলের বর্ণনা। বীরসা মুণ্ডা সরকার বিরোধী কোনো কার্যকলাপের জন্য ধরা পড়ে রাঁচি জেলে অবস্থান করছে এবং বিচারের পূর্বেই তার জেলখানার মধ্যেই মৃত্যু ঘটে রক্তবমন জনিত কারণে। কিন্তু পাঠক জিজ্ঞাসার যে তিমির অবস্থান করছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। অথচ ঘটনা ক্রমেই এগিয়ে চলল। বীরসা মারা গেছে, সরকারি নির্দেশ এল বীরসাকে তাদের সামাজিক রীতি মেনে দাহ করা হবে না, প্রমাণ পাট লোপের জন্য তাকে একেবারেই পুড়িয়ে ফেলা হবে। এ ঘটনায় পাঠক হয়তো কিছু কিছু অনুমান করতে পারে বীরসার ওপর ইংরাজ বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রোশ ছিল। তার বদলা নিতে এমন অত্যাচার অবিচার করা হয়েছে বীরসার ওপর। পাঠক কিন্তু বুঝতে পারে না বীরসা এমনকি করেছিল যে তার শেষ পরিণতি এমন হল। সামান্য মুণ্ডা উপজাতির ছেলে হয়ে তার মধ্যে এমন কি গুণাবতী ছিল বা এমনকি কার্যকলাপে নিজেকে যুক্ত করেছিল যার জন্যে মশা মারতে কামান দাগার মতো। ইংরাজ সরকারের এত তৎপরতা। কিন্তু বিস্ময়ের গ্রন্থি মোচন হল না কোনো মতেই।
‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে লেখিকা আসলে একটা নতুন রীতি গ্রহণ করেছেন। উপন্যাসের প্লটের শেষ করুণ পরিণতিকে অতি মুন্সীয়ানার দ্বারা উপন্যাসের শুরুতেই প্রকাশ করে পাঠক মাঝে বিস্ময় ও কৌতূহল উৎপাদন করে তারপর ক্রমেই মূল কাহিনির মাঝে প্রবেশ করেছেন, একে একে মূল কাহিনির গ্রন্থি উন্মোচিত করেছেন। ধানী মুণ্ডা, ভরমি মুণ্ডার মুখে এ কাহিনি সুনারা সহ অন্যান্য বন্দি মুণ্ডারা শুনে বীরসার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে যে ধারণা লাভ করতে শুরু করেছিল পাঠকও তাদের অঙ্গীভূত হয়ে উদগ্রীব নেত্রে পাঠ করতে থাকে উপন্যাসখানি। উদ্দেশ্য বীরসার অতীত ইতিহাস জানা। এইভাবে উপন্যাসের কাহিনি পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে। এ এক অভিনব পদ্ধতি। শেষ পরিণতি শুরুতেই ব্যক্ত করে পাঠককে প্রথমে চমকে দেওয়া তারপর একে একে সামগ্রিক তথ্য প্রদানে কাহিনির জট ধীরে ধীরে খোলা। লেখিকার এ কৌশল বড়ো উপায়ের হয়েছে।
বিদ্রোহীদের সংগঠিত একত্রিত করতে শুরু, বক্তৃতা আর মিটিং মিছিলের দ্বারা সম্ভব নয়। প্রয়োজনে একই সুরের দ্বারা সবাইকে বাঁধা ও উদ্বোধিত করা। আলোচ্য উপন্যাসে মেলে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ। এখানে স্থান পেয়েছে বহু সংগীত, যে সঙ্গীতগুলির সুরের ধারণা ধারায় আপ্লুত হয়ে দলে দলে মুণ্ডারা একই ছত্র ছায়ায় এসে মিলিত হয়েছিল। সংগীত তথা জাতীয় সংগীতের সুর যে বিদ্রোহের বিপ্লবের স্তূপে অগ্নি সংযোগ করে উপন্যাস মধ্যে তার বড়ো দৃষ্টান্ত—“বোলোপে বোলোপে হেগা মিসি হোন্ কো….।” এমনি আরো বহু সংগীত উপন্যাস মধ্যে সংযোজিত হয়ে বীরসা মুণ্ডার বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ইতিহাসে বর্ণিত মুণ্ডাদের কাছে মুণ্ডাদের সমাজে বীরসা অবতার রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, বীরসা হয়েছিল মুণ্ডাজাতির মুক্তিদাতা। ইতিহাসের এই বিষয়টি লেখিকা উপন্যাস মধ্যে খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন। ঔপন্যাসিক বীরসার অবতারত্বকে আশ্বর্য রচনার কৌশলে বাস্তবসম্মত উপায়ে প্রতিস্থাপন করেছেন উপন্যাস মধ্যে।
ইতিহাসে আছে, বীরসা একই সময়ে বহু নারীকে মোহগ্রস্ত করতে পারত, এমনকি একাধিক নারীর সঙ্গে তার প্রণয় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। জঙ্গলের মাঝে ইংরাজ সৈন্যের হাতে বীরসা যখন ধরা পড়েছিল তখন তার সঙ্গে ছিল দু-জন পত্নী। কিন্তু উপন্যাস মধ্যে বীরসা চরিত্রখানি আদর্শরূপে অঙ্কিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক ইঙ্গিত জানিয়েছেন, বীরসার রূপে গুণে বীর্যে অনেক নারীই তার প্রতি বশীভূত। সোনত্রার জঙ্গলে পলাতক জীবনে তার সঙ্গিনী ছিল ডোনকার স্ত্রী সালী আর পরমী, তাদের সঙ্গে বীরসার ছিল না কোনো প্রণয় সম্পর্ক। মূলত তারা তাদের ভগবানকে সেবা করার জন্য বীরসার সঙ্গ নিয়েছিল। এককথায় লেখিকা বীরসা চরিত্রকে আদর্শ মহাপুরুষ রূপে চিত্রিত করেছেন। সমালোচক মহলে ইতিহাসের এই রূপান্তর সাধনের জন্য নিন্দাবাদ রচিত হলেও মহাশ্বেতাদেবী যে একটা নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে বীরসাকে সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।
ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে, জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহে রাঁচি জেলের বন্দি মুণ্ডারা জলাভাবে এবং পুলিশের অসামাজিক প্রহারে রক্তবমি করে মারা গিয়েছিল। বীরসাও রক্তবমি করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। কিন্তু উপন্যাস মধ্যে লেখিকা ইংরাজ সরকারের অত্যাচারকে জনসমক্ষে ঘৃণীত রূপে প্রতিপন্ন করতে বীরসা মৃত্যু সম্পর্কিত নতুন তথ্য পেশ করেছেন। তিনি অমূল্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন আর্সেনিক প্রয়োগে বীরসাকে স্নো পয়জন দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য বীরসাকে জীবিত অবস্থায় জেল থেকে না ছাড়া। এই সত্যবাণী ঔপন্যাসিক উচ্চারণ করে ইংরাজদের অত্যাচার আর অবিচারত্বের মাত্রাকে নিম্ন কলঙ্কের পর্যায়ে প্রতিস্থাপন করে বীরসার মহত্বকে প্রকট করেছেন এবং সাথে সাথে নিরীহ মুণ্ডা জাতির প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
বীরসা ধরিত আবা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে মুণ্ডারী সমাজে। এই ধরতি আবা কিংবা ভগবান রূপে বিরাজ করতে হলে যে নতুন নীতির বা নতুন চিন্তা ভাবনার দ্বারা সবাইকে প্রভাবিত করতে হয় বীরসা তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল। তাই বীরসা সমাজের চিরায়ত প্রথা—’করম’ পূজা, ‘মাগো’ উৎসব, ‘পাইকা’ নাচ, মেয়েদের ফুল পবা, পুরুষদের কাঁকই গোঁজা, কানে গহনা পরা, বোঙা বুঙির পূজা দেওয়া প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করে। পরিবর্তে সবার কাছে যে ব্যক্ত করল তার নতুন ধর্ম অন্য রকমের, অন্যান্য দেবতার মতো, “আমি তাদের দুলাই না, ভুলাই না। তাদের বাঁচতে শিখাব, মরতে শিখাব। আবার মারতেও শিখাব। তবে নতুন বীতকরণ হবে না মোর ধর্মে?” তার ধর্মের নতুন রীতকরণ হল—“বীরসাইত হতে হলে নতুন জন্ম নিতে হবে। পুরাণের রীতিকরণ ছাড়তে হবে। কষ্ট করতে হবে।” এককথায়, সমাজের যাবতীয় কুসংস্কার বিদূরিত করে বীরসা তার সমাজের প্রত্যেক মানুষকে মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। উপন্যাস মধ্যে বীরসার ধর্ম সম্পর্কিত এই তথ্য পেশ করে ঔপন্যাসিক বীরসাকে ভগবান রূপে কল্পনা করার পশ্চাতে এক সত্যকার ভাব ব্যঞ্জনা সংযুক্ত করেছেন।
সর্বোপরি, উপন্যাসের ঘটনা ক্রমিক পরম্পরায় বর্ণনা দানের পর ও লেখিকা উপসংহার অধ্যায়টি সংযুক্ত করে উপন্যাসের অবয়ব গঠনে আলাদা একটা মাত্রা এনে দিয়েছেন। উপন্যাস শেষ হওয়ার পরও উপসংহার অংশটি কেন সংযোজিত করলেন লেখিকা, এমন প্রশ্ন বহু পাঠক সমালোচকের মনে উদিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যায় সমগ্র উপন্যাসের সারাংশ হল উপসংহার অংশটি। এই উপসংহার অংশটি যদি সংযোজিত না হত, তাহলে সমগ্র উপন্যাসখানি কেমন অসম্পূর্ণতায় পর্যবসিত হত। বন্দিদের ওপর পুলিশি নির্যাতন, বিচার ব্যবস্থায় অনৈতিকতা, তদন্তের নামে অত্যাচার, বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে নিরীহ মুণ্ডাদের হত্যা, বিদ্রোহোত্তর পর্বে মুণ্ডা সমাজের সংসারের করুণ চিত্র প্রভৃতির বাস্তব স্বরূপ উপসংহার পাঠে প্রকট হয়ে ওঠে। কাজেই উপন্যাসের গঠনরীতির ক্ষেত্রে উপন্যাস শেষে উপসংহার অংশটি সংযোজনের মধ্যে এক অভিনব কৌশল যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তা সমগ্র অরণ্যের অধিকার উপন্যাসখানি পাঠ করে বোঝা সম্ভব।
Leave a comment