সূচনা: আলজেরিয়া হল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের তীরে। অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

[1] ফ্রান্সের লক্ষ্য: আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত নিজের উপনিবেশগুলিতে ফ্রান্সের লক্ষ্য ছিল, উপনিবেশগুলি ফরাসি সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত করা এবং সেখানকার বাসিন্দাদের ফরাসি নাগরিকে। পরিণত করা এবং সুতীব্র শােষণ চালায়। এই উদ্দেশ্যে ফ্রান্স আলজেরিয়ার বাসিন্দাদের ফরাসি ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি চর্চায় যথেষ্ট উৎসাহ দেয়। আলজেরিয়ার শহরগুলির বাসিন্দারা প্রথমে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি আয়ত্ত করে নিজেদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলতে বসে। অবশ্য এ কাজে ফ্রান্স আলজেরিয়ার শহরাঞ্চলের মতাে গ্রামাঞ্চলে সাফল্য পায়নি।

[2] ফরাসিদের আধিপত্য: ফ্রান্স আলজেরিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে বহু শ্বেতাঙ্গ ফরাসি এখানে বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আরজেরিয়ায় বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গ ফরাসি বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লক্ষ। এই শ্বেতাঙ্গ ফরাসিরা শীঘ্রই আলজেরিয়ার ধনী ও প্রভুত্বকারী জনগােষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা আলজেরিয়ার ১/৩ অংশ কৃষিজমির মালিক হয়ে ওঠে। আলজেরিয়ার রপ্তানি বাণিজ্যের বেশিরভাগটাই তারা দখল করে নেয়। তাদের শােষণ ও নির্যাতনে আলজেরিয়ার স্থানীয় দরিদ্র বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এর ফলে তাদের মনে শ্বেতাঙ্গ ফরাসিদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।

[3] আলজেরীয়দের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা: আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদী ও সাধারণ মানুষ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনের বিরােধিতা করে ফরাসিদের দেশত্যাগ করতে বলে; কিন্তু সেখানকার শ্বেতাঙ্গরা আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনকে সমর্থন করে এবং আলজেরিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সম্পর্ক অটুট রাখার দাবি জানায়। ফলে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে আলজেরীয়দের ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়।

এটি আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। আরবের মুসলিমরা সপ্তম শতকের শেষদিকে উত্তর আফ্রিকা জয় করে এখানে ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষার প্রচলন করলে আলজেরিয়ায়ও ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষার প্রসার ঘটে। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে এখানে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসিদের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার উপনিবেশগুলিকে ফরাসি সাম্রাজ্যের অংশে এবং আফ্রিকার বাসিন্দাদের ফরাসি নাগরিকেরূপান্তরিত করা। তাই ফরাসিরা এখানে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানাের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ফ্রান্সের এই উদ্যোগ সফল হয়নি।

[4] ইন্দোচিনে ফরাসিদের ব্যর্থতা: আফ্রিকার আলজেরিয়ার মতাে এশিয়ার ইন্দোচিনও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়ার ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচিনে ফরাসি শাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের ব্যাপকতায় সেখানে ফরাসি আধিপত্য ধ্বংস হয় এবং ফরাসি অধীনতা ছিন্ন করে ইন্দোচিন স্বাধীনতা লাভ করে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনের সাফল্য আলজেরিয়ার সাধারণ মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উৎসাহিত করে। তারা অনুধাবন করে যে, তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে আলজেরিয়া থেকেও ফরাসিদের আধিপত্য ধ্বংস করা সম্ভব।

[5] মিছিলে আক্রমণ: আলজেরিয়ার সাধারণ মানুষ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনে নিজেদের বিভিন্ন অধিকার ও সুযােগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, অথচ সেখানকার বহিরাগত শ্বেতাঙ্গরা প্রভূত অধিকার ও সুযােগসুবিধা ভােগ করে। এজন্য আলজেরিয়ার জনগণ বিদেশি আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে একটি বিক্ষোভ মিছিল করলে ফরাসি সরকার এই মিছিলে আক্রমণ চালায়। এর ফলে মিছিলে অংশগ্রহণকারী কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং সারাদেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ফরাসি সরকার জেনারেল জেকুইস ম্যাসু (Jacques Massu)-কে আলজেরিয়ায় পাঠিয়ে তীব্র দমননীতি চালাতে শুরু করে। এর মধ্যেই আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদীরা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়।

[6] ফ্রান্সের কঠোরতা: আলজেরিয়া ছিল ফরাসিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ। তারা এই উপনিবেশটি কোনােভাবেই হাতছাড়া করতে বা আলজেরিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে মােটেই পাত্তা দিতে রাজি ছিল না। এজন্য ফরাসি সরকার আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তীব্র দমনপীড়ন শুরু করে। ফলে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে।

উপসংহার: এই আন্দোলন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনে নেতৃত্বের অগ্রভাগে থাকেন আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা বেন বেল্লা। তীব্র আন্দোলনের দ্বারা শেষপর্যন্ত ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়া ফরাসি অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভ করে।