প্রশ্নঃ ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৬ ও ১০৭ ধারার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। কোন পরিস্থিতিতে সদাচরণের মুচলেকা প্রদানের আদেশ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে থাকেন? উহার উদ্দেশ্য কি?
ধারা-১০৬ এবং ধারা ১০৭ এর মধ্যে পার্থক্যঃ ধারা ১০৬ তে বলা হয়েছে যে, দন্ডবিধির ৮ম অধ্যায়ে বর্ণিত অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়ে থাকলে (অবশ্য দন্ডবিধি ১৪৩, ১৪৯, ১৫৩ ক বা ১৫৫ ধারাসমূহ এর ব্যতিক্রম) এবং দন্ডাজ্ঞা প্রদানকারী আদালতের মতে যদি শান্তি রক্ষার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোন মুচলেকা দেয়া বাঞ্ছনীয় প্রতীয়মান হয় তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তির সামর্থ অনুযায়ী অনুর্ধ্ব ৩ বছরের জন্য মুচলেকা দেয়া নির্দেশ দিতে পারেন।
ধারা-১০৭ মতে কোন ব্যক্তি কর্তৃক জনশক্তি বিঘ্নিত করার আশংকা রয়েছে বলে ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রতীয়মান করার হয় তাহলে অনুর্ধ্ব ১ বছরের জন্য শান্তি রক্ষার মুচলেকা দেয়ার ব্যাপারে সেই ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর আদেশ দেয়া যেতে পারে।
দু’টি- ধারা মূলত: শান্তিরক্ষা করার জন্য করা হয়েছে। ১০৬ ধারাটি প্রযোজ্য হবে অভিযুক্ত ব্যক্তির অতীত আচরণের জন্য ভবিষ্যৎ শান্তি ভঙ্গের আশংকা থাকলে এবং ধারা ১০৭টি প্রযোজ্য হবে যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক জনশান্তি বিঘ্নিত হবার আশংকা থাকে সেক্ষেত্রে।
১০৬ ধারার উদ্দেশ্য হচ্ছে আসন্ন শান্তিভঙ্গ প্রতিরোধ করা যে শান্তিভঙ্গ ইতোপূর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের কোন কার্যের সাথে ১০৭ ধারা সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়া ১০৬ ধারাটি ব্যক্তিগত শান্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে এবং ১০৭ ধারাটি জনশান্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে থাকে।
রিভিশন এখতিয়ারঃ রিভিশন বলতে ভুল ত্রুটি সংশোধনের জন্য পুনরায় দেখা বুঝায়। নিম্ন আদালতের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য উচ্চ আদালতের যে এখতিয়ার রয়েছে তাকে রিভিশনের এখতিয়ার বলে। বিচার কার্যক্রমে নানাবিধ ভুল-ত্রুটি হতে পারে। আইন সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যার অভাব, পদ্ধতিগত অনিয়ম, যথাযথ সাবধানতার অভাব এবং রূঢ়ভাবে মামলা পরিচালনার ফলে এরূপ ভুল- ত্রুটি হয়ে যেতে পারে। এগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকলে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে অবিচার হয়ে দাঁড়াবে। তাই উচ্চতর আদালতকে নিম্ন আদালতের নথিপত্র তলব করে এগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সংশোধনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৫ ধারা মতে নিম্নলিখিত আদালতগুলির তাদের অধীনস্থ আদালতের বিচার কার্যক্রমের উপর রিভিশনের এখতিয়ার রয়েছে-
(১) সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, (২) দায়রা জজ, (৩) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, (৪) সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রদত্ত যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট, (৫) প্রধান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ।
হাইকোর্ট বিভাগের রিভিশন এখতিয়ারঃ ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৯ ধারায় হাইকোর্ট বিভাগের উপর এবং ৪৩৯ (ক) ধারায় দায়রা আদালতের উপর রিভিশনের এখতিয়ার অর্পণ করা হয়েছে। ৪৩৯ ধারায় রিভিশনের এখতিয়ারটি অবশ্য ৪৩৫ ধারায় প্রদত্ত হাইকোর্ট বিভাগের নথি তলব করার ক্ষমতার বিস্তৃত বিষয়। সেজন্য ৪৩৯ ধারার সাথে ৪৩৫ ধারাও বিবেচনা করতে হয়। বিচার প্রশাসন তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই আইনের অপব্যাখ্যার কারণে কিংবা পদ্ধতিগত কোন কারণে কিংবা যথাযথ সতর্কতার সাথে বিচার কার্য-পরিচালনার অভাবে বিচারের পরিবর্তে অবিচার হবার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই নিম্ন আদালত কোন বিচার কার্যে কি পেয়েছেন, কি রায় বা আদেশ দিয়েছেন সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নথি তলব করে এবং প্রয়োজনবোধে সংশোধন করে দেয়ার এখতিয়ার হাইকোর্ট বিভাগের রয়েছে । হাইকোর্ট বিভাগের রিভিশনের এখতিয়ার চূড়ান্ত এবং এর পরে আর রিভিশনের সুযোগ থাকে না। হাইকোর্ট বিভাগের রিভিশনের এখতিয়ার যদিও খুব ব্যাপক ও বিস্তৃত ইহা অধিকার হিসেবে দাবী করা যায় না কেননা ইহা আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাধীন। ইহা উচ্চ আদালতের একটি অসাধারণ ক্ষমতা যা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। পরিস্থিতি এরূপ হস্তক্ষেপের দাবী না করলে সাধারণত হাইকোর্ট বিভাগ তার রিভিশনের এখতিয়ার প্রয়োগ করেন না।
স্ত্রী দায়রা জজের রিভিশনাল এখতিয়ারঃ নিম্নে আদালতের বিচারে যদি কোন অনিয়ম, ভুল বা ন্যায়-নীতির পরিপন্থী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয় তবে তা সংশোধনের জন্য উচ্চতর আদালত রিভিশনের এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারেন। ৪৩৯ ধারায় হাইকোর্ট বিভাগের উপর রিভিশনের যে এখতিয়ার প্রদত্ত রয়েছে তা অক্ষুণ্ণ রেখে ১৯৭৮ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৩৯ ক ধারা সংযোজন করে হাইকোর্ট বিভাগের এরূপ সকল ক্ষমতা দায়রা জজের উপর অর্পিত হয়েছে। এর ফলে নিম্ন আদালতের ভুল-ভ্রান্তি বা অবৈধ কার্যকলাপের প্রতিকার স্থানীয়ভাবে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
৪৩৯ ক (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, এমন যে কোন কার্যক্রমে যার নথি দায়রা জজ কর্তৃক তলব করা হয়েছে বা যা অন্যভাবে তাঁর অবগতিতে আনা হয়েছে, তখন ৪৩৯ ধারা মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগ যে সকল ক্ষমতা প্ৰয়োগ করে থাকেন, দায়রা আদালত সেগুলির সকল বা যে কোন একটি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ৪৩৯ ধারা মোতাবেক রিভিশনের এখতিয়ার প্রয়োগ করে নিম্ন আদালতের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে যে প্রতিকার দেন তেমনি প্রতিকার দায়রা আদালত রিভিশনের মাধ্যমে তাঁর অধ:স্তন আদালতের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে দিতে পারবেন।
এই ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে যে, যেখানে দায়রা আদালতে কোন ব্যক্তি কর্তৃক বা তার পক্ষে রিভিশনের জন্য দরখাস্ত পেশ করা হয়েছে। সেখানে ঐ ব্যক্তির দরখাস্তের উপর দায়রা আদালতের প্রদত্ত সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে ।
সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিভিশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হয়। অনুরূপভাবে দায়রা আদালতের অধ:স্তন আদালতের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন বিষয়ে দায়রা আদালতের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে।
(৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে যে, বর্তমান অধ্যায়ের আওতায় দায়রা জজের যে কোন সাধারণ বা বিশেষ আদেশ বলে স্থানান্তরযোগ্য যে কোন মোকদ্দমা সম্পর্কে একজন অতিরিক্ত দায়রা জজ একজন দায়রা জজের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
অতএব দেখা যায় যে, শুধু দায়রা জজেই স্থানীয়ভাবে রিভিশনের প্রতিকার দেন না, প্রয়োজনবোধে এবং দায়রা জজের অনুমতিক্রমে অতিরিক্ত দায়রা জজ অনুরূপ প্রতিকার দিতে পারেন। এছাড়া সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদন ছাড়াও আদালত নিজেই (Suo moto) এই এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারেন।
Leave a comment