ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ :

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বাংলা গদ্য, বাঙালীর মনোলোক এবং সমাজ-চেতনার উপরে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল, লর্ড কর্নোয়ালিসের অনতিসফল শাসন সংস্কারকে সার্থক করার জন্য ওয়েলেসলীর কূটনৈতিক উদ্দেশ্য : “for the better instruction of the Junior Civil Servants of the Company” (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘গদ্যের প্রথম যুগ’, সজনীকান্ত দাস, কলকাতা, ১৯৫৩, পৃষ্ঠা ৮৩)। ইংলন্ড থেকে সদ্য-আগত ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের সিভিলিয়ানরা ছিলেন এর ছাত্র। তাদের পদমর্যাদা ও দায়িত্ববহনের উপযুক্ত আইন, ইতিহাস, বিজ্ঞানের সঙ্গে এই বিরাট ভূখণ্ডকে শাসনবন্দী করার জন্য প্রথম এবং প্রধান উপায় ছিল এদেশের বিভিন্ন ভাষা ও আচার-আচরণের পরিচয় অর্জন। প্রথমে আরবী, ফার্সী ও হিন্দুস্থানী ভাষায় অধ্যাপনা, তার অস্ততঃ ছয় মাস (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) পর মিশনের প্রাচ্যভাষার খ্যাতিমান পণ্ডিত উইলিয়ম কেরীর তত্ত্বাবধানে ও প্রধানের দায়িত্বপদে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা চর্চা শুরু হল কলেজে। ১৮০১ থেকে ১৮৩১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত কর্মজীবনের মধ্যে তাঁর অবদান এককথায় নানামুখী। পণ্ডিত-মুনশীদের শিক্ষকতার জন্য আহ্বান, অনুরোধ অথবা পুরস্কারের ব্যবস্থা করে তাঁদের দিয়ে গদ্য-গ্রন্থ রচনা করানো, সরকারী ব্যয়ে তার মুদ্রণ এবং ক্রয়ের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ডাঃ কেরীর কৃতিত্বের কয়েকটি স্মরণীর দৃষ্টান্ত মাত্র। বস্তুত, স্বনাম-সাদৃশ্যে শুধু নয়, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা গদ্যসাহিত্য এবং সংস্কৃতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে উঠার মূলে উইলিয়ম কেরীর অবদান এবং সেই সঙ্গে মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের ভূমিকা) ছিল অপরিসীম।

১৮০০ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা মে শ্রীরঙ্গপত্তম জয়ের বার্ষিক উৎসবের দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে কলেজের কাজ শুরু হয়। ঐতিহাসিক সজনীকান্ত দাসের মতে, “আসলে কলেজের কাজ শুরু হয় ঐ সালের ২৪শে নভেম্বর থেকে” (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৮৪, উদ্ধৃত)। ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব ছিল, যদিও বাংলা সাহিত্য বা বাংলা ভাষার সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয় আরো আগে, ১৮১৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দ থেকেই এই বিদ্যায়তনের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার কারণ সম্ভবত, (ক) ১৮১৫ সালে রামমোহনের প্রথম দুখানি গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে কলকাতায় বুদ্ধিজীবী মহলে তার ক্রমশঃ প্রভাব বিস্তার, (খ) ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে স্কুলবুক সোসাইটির ও ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটির পুস্তক প্রকাশ এবং হিন্দু কলেজকে কেন্দ্র করে ইংরেজ ছাত্র নয় আপামর বাঙালী জিজ্ঞাসুজনের আত্মপ্রকাশ, (গ) ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দে ‘বাঙ্গাল গেজেট’, ‘দিগ্‌দর্শন’ ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা গদ্য ও বাঙালী মানসিকতার সমৃদ্ধিলাভ। সুতরাং বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ পর্বের আয়ুঃসীমা, ১৮১৫-র কাছাকাছি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাই ১৮৫৪ সন পর্যন্ত এই কলেজ টিকে থাকলেও ১৮২০-২২ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে এই কলেজ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যাও হ্রাস পায়।

সমকালীন অথচ কলেজের পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত আরো কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পাওয়া যায়; যেমন রামমোহন রায়ের ‘বেদাস্তগ্রন্থের’ প্রতিবাদে ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে লেখা মৃত্যুঞ্জয়ের ‘বেদাত্তচন্দ্রিকা’ গ্রন্থ, নাম না থাকলেও সমসাময়িক সাক্ষ্য থেকে পণ্ডিতজনের অনুমান গ্রন্থটি তাঁরই রচনা। ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দে লেখা মৃত্যুঞ্জয়ের পুত্র রামজয় তর্কালঙ্কারের ‘সাংখ্যভাষা সংগ্রহ’ রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেনের সহায়তায় স্কুল বুক সোসাইটির নির্দেশে অনুদিত তারিণীচরণের ‘নীতিকথা’ এবং ১৮২৬-এর কাশীনাথের ‘পাষণ্ডপীড়ন’ ও ‘সাধুসম্ভোষিণী’ গ্রন্থগুলির নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

বিষয়-বিভাগ : ফোর্ট উইলিয়াম গ্রন্থমালার প্রধান লক্ষণীয় বিশেষত্ব, তার বিষয়বৈচিত্র্য। এর একদিকে রয়েছে প্রতাপাদিত্য ও কৃষ্ণচন্দ্রের মত ব্যক্তির জীবনচরিত্র যা এক অর্থে ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক উপন্যাসের বীজ রূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য, রয়েছে ‘রাজাবলি’র মত আধুনিক ধরনের প্রথম ইতিহাস এবং ইতিহাসমালার’ মত গল্প-কাহিনীর সংকলন; আরো রয়েছে ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’র মত সুগভীর দার্শনিক নিবন্ধ, আর ‘লিপিমালা’ সঙ্কলিত পত্র-রচনার আদর্শ (model letter) এবং সর্বোপরি সংস্কৃত থেকে ইংরেজী থেকে হিন্দী থেকে শুধু অনুবাদ আর অনুবাদ। সুতরাং এই কলেজের বাংলা গ্রন্থগুলি মূলতঃ গল্প ও উপকথা, ইতিহাস এবং ন্যায় দর্শন, এই তিনটি শাখায় রিভক্ত হয়। অবশ্য অনুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সংস্কৃত উপকথা, বিদেশী ঈশপস্ ফেবল্স্ এবং আদি রসাত্মক মুসলমানী গল্পের দিকেই যেন কেরীর আগ্রহ বেশি ছিল। তবে ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনেই তাঁর সব কিছু আয়োজন। কেননা, ইংরেজ ছাত্রদের বাংলা শেখাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, হ্যালহেড বাইশ বছর আগে যা বলেছিলেন, সেই একই অবস্থা। বাংলা সাহিত্যে গদ্য নেই, অথচ গদ্য ছাড়া পড়ানো যায় না। তাই প্রথম শিক্ষার্থীর ভাষাশিক্ষার এবং ভাষাবাহিত এদেশের সংস্কৃতি পরিচয়ের উপযুক্ত গদ্যভাষায় পাঠ্যপুস্তক তাঁকে নিজে লিখে অথবা পণ্ডিত-মুন্সীদের দিয়ে লিখিয়ে নিতে হয়েছিল। কাজেই বিষয় নির্বাচনে তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকাই ছিল স্বাভাবিক।

দৃষ্টিকোণ : ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ছিল যাজক-শিক্ষক পরিচালিত। লর্ড ওয়েলেসলির মিনিট অনুসারে এই কলেজের প্রোভোস্ট ‘shall always be a Clergyman of the Church of England as established by law’ (১১শ ধারা)। কিন্তু, তবু বিচিত্রভাবে প্রথমদিকে গ্রন্থরচনায় বেশ কিছুদিন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গীর অনুসরণ দেখা যায়। তার পরিচয় পাওয়া যায় রামরাম বসুর লিপিমালা’য় “সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কর্তা জ্ঞানদ সিদ্ধিদাতা পরব্রহ্মের উদ্দেশ্যে নত” হয়ে হিন্দু দেবদেবীর কাহিনী বর্ণনায়, মুনশী চণ্ডীচরণের ভগবদ্গীতার বঙ্গানুবাদের জন্য ৮০ টাকা পারিতোষিক লাভে, অথবা বাল্মীকির রামায়ণ, জয়দেবের গীতগোবিন্দ প্রভৃতি হিন্দুধর্মগ্রন্থকে পাঠ্য রূপে নির্বাচনের দ্বারা পরধর্ম সহিষ্ণুতায়। অবশ্য দেশীয় পণ্ডিত-মুনশীদের দিয়ে দেশীয় পুরাণ-শাস্ত্রের অনুবাদ ভিন্ন কর্তৃপক্ষের আর অন্য উপায়ও বিশেষ ছিল না। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যগ্রন্থের মধ্যে কতটুকু ‘হিন্দু’ প্রভাব আছে বা নেই, তাকে সূক্ষ্মভাবে কেরীর পক্ষে দেখাও দরকার ছিল না। তৃতীয়ত, বায়ুমণ্ডলে বাস করে বাতাসের চাপ এড়ানো যায় না। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য এই সমস্ত গ্রন্থের অনুসরণ ছিল প্রায় অনিবার্য। তবু শেষের দিকে বিদ্যাসাগরের ‘বাসুদেবচরিত’ গ্রন্থপ্রকাশে কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছা প্রকাশে পূর্বের উদারতা ও পরমতসহিষ্ণু মনোভাব অনেক পরিমাণে বিনষ্ট হয়েছিল বলে মনে হয়।

বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা, হিন্দু ও মুসলমান আইন এবং ইতিহাস ইত্যাদি কলেজের পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে স্বয়ং কেরীর উদ্ভিদতত্ত্ব, ধর্ম এবং ভাষা বিজ্ঞানের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগের ফলে বাংলাদেশের নব্য মানসিকতা অংশত অস্তত জেগে ওঠার সুযোগ পায়। একথা হয়তো ঠিক, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কর্তৃপক্ষ, তাঁদের অনুগামী গদ্য লেখকগণ স্ব-সচেতন হয়ে দেশবাসীর জন্য বাংলা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন নি। কিন্তু তবু সেইসব গ্রন্থে পাঠকের চিত্ততৃপ্তি ও কৌতূহল জাগরণের উপাদান রেখে তারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে উঠেছেন।

গল্প ও উপকথা: ফোর্ট উইলিয়ম গ্রন্থমালার অধিকাংশতই ফার্সী, সংস্কৃত বা ইংরেজী আখ্যানের অনুবাদ। সতেরোটি গ্রন্থের মধ্যে দশটি প্রধানতঃ গল্পমুখ্য। কেননা, প্রেরণাদাতা কেরী স্বয়ং ছিলেন রোমান্সের মুগ্ধ পাঠক—”I was better pleased with romances”; (‘Memoir of W. Carey by E. Carey. p. 7)। সেইজন্য দেখা যায়, ‘লিপিমালা’ গ্রন্থটির উদ্দেশ্য ছিল লিপি লেখন শিক্ষা দান, কিন্তু আখ্যান-উপাখ্যানের মাধ্যমেই ঘটে তার উপস্থাপনা। অনুরূপভাবে, ‘ইতিহাসমালা’ গ্রন্থটিতেও ‘ইতিহাস’ নাম মাত্র। রূপ-সনাতন-বীরবর প্রভৃতি কাহিনীতে ঐতিহাসিক চরিত্র কিছু থাকলেও এর গল্প সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কয়েকটি রূপকথা, উপকথাও আছে। যেমন ‘হরিণীবদনা রাজকন্যা’র কথা, ‘ব্যাঘ্র-ব্যাঘ্রী ও ব্রাহ্মণ কথা’ ইত্যাদি। প্রথাবাহিত হলেও গল্প বলার ভঙ্গীতে আকর্ষণের ভঙ্গিমা আছে “এক রাজার অতি সুন্দরী কন্যা কিন্তু সে হরিণীবদনা জন্মিয়াছিল, রাজা তাহাতে সদা ভাবিত কি ক্রমে বিবাহ হইবেক স্বীকার কেহ করে না। এই মতে প্রায় বার তের বৎসর বয়ঃক্রম হইল।”

নীতি প্রতি কথা সম্বলিত উপাখ্যানের আকর্ষণ অনুভব করা যায় ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট’, ‘তোতা ইতিহাস’, ‘পুরুষ পরীক্ষা’ এবং হিতোপদেশে’র একাধিক অনুবাদে। ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ছিল সংস্কৃত ‘দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’র অনুবাদ। মূলের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য থাকার জন্য ভাষা অনেক স্থলে কষ্টবোধ্য। তবু বিদেশীর কাছে তার উপকথাগত প্রমূল্য লক্ষ্য করা যায় যুগপৎ শ্রীরামপুর ও লন্ডন থেকে এর অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশে এবং প্যারি নগরী থেকে ফরাসী অনুবাদ প্রচারের বিবরণে। ইংরেজী গদ্য কাহিনীর ইতিহাসে ম্যালরির ‘Morte Darthur’-এর যে ভূমিকা, বাংলা গদ্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বও বলা যায় প্রায় ততখানি। ‘ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্টের’ বিষয়বস্তু প্রায় হিতোপদেশের অনুরূপ — মানবেতর প্রাণীর সাহায্যে মানবনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। বিপরীতভাবে হিন্দী ‘তোতা কাহিনী’ অবলম্বনে লেখা ‘তোতা ইতিহাস’ বইতে উপদেশ যেন ছদ্মবেশ, বক্তার মুখ্য লক্ষ্য ব্যভিচার-গামিনী নারীর সতীত্ব রক্ষার সুলভ ফরাসী ‘কেচ্ছা’ পরিবেশন। সম্ভবত ১৮শ শতকের ‘কৃষ্ণনাগরিক’ রীতি অথবা ‘শুকসপ্ততি’, ‘তুতিনামা’ ইত্যাদি গল্পরসের প্রত্নস্মৃতি লেখকের মনে ছিল। অবশ্য ইউরোপীয় গদ্যসাহিত্যে বোকাচ্চো, র্যাব্‌লা অথবা রেস্টোরেশন যুগের সেডলী উইচালী-কনগ্রেভের রুচিও সর্বত্র শুচিশুদ্ধ ছিল না। পাঠ্যগ্রন্থরূপে কেরীর মত পাদ্রীর গ্রন্থটিকে স্বীকৃতিদান হয়ত প্রথমদিকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘সঙ অফ সঙস’-এর ভাবনা ‘Let him kiss me with the kisses of his month’, ‘গেস্তা রোমানোরাম’ জাতীয় গ্রন্থের শেষে নীতিমূলক ‘প্রয়োগ’ রীতি, অথবা কেরীর পূর্বজীবন অভিজ্ঞতার বিবরণ স্মরণ করলে (‘I had sunk into the most awful profligacy of conduct.’ ‘Memoir of W. Carey, p.8) তার এই প্রশ্রয়ের কারণ অনেকখানি বোঝা যায়।

‘হিতোপদেশ’ গল্পের উৎস সংস্কৃত, কিন্তু তার গৌরব বেড়েছে একাধিক অনুবাদে। অষ্টাদশ শতকেই বইটির কয়েকটি পদ্যানুবাদ এবং পরে বাংলা হরফ নির্মাতা চার্লস উইলকিন্সের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তবু কলেজ পাঠ্যগ্রন্থরূপে নির্বাচন ও মৃত্যুঞ্জয়ের অনুবাদের পর এর আকর্ষণ আরো বাড়ে বলে মনে হয়। কারণ, ফোর্ট উইলিয়ম গ্রন্থমালার মধ্যেই বিভিন্ন লেখকের তিনটি অনুবাদ আছে। ১৮৪০-এর মধ্যে তার সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত দশ। ‘পুরুষপরীক্ষা’র ভাষা শিথিল ও জড়তাগ্রস্ত।

‘কথোপকথন’ দ্বিভাষিক গ্রন্থ, বাঁ দিকের পাতায় বাংলা আর অন্য পাতায় ইংরেজী, পুরো নাম : ‘Dialogues, intended to facilitate the acquiring of the Bengali Language’. ‘Colloquies’ নামেও এই বইখানির প্রসিদ্ধি ছিল। এর একত্রিশটি অধ্যায় নানা বিষয় সম্পর্কিত সবগুলিই সংলাপিকা। কিন্তু কেরী গ্রন্থটির যথার্থই রচয়িতা বা সঙ্কলয়িতা কিনা তা সংশয়ান্বিত। কেরীর নিজের উক্তি “I have employed a some sensible natives to compose dialouges upon subject of a domestic nature” এবং তার এক বন্ধুর “These (colloquies, were composed in the original Bengali probably by a clever natives” উক্তিই এই সন্দেহের অন্যতম সূত্র। গ্রন্থটির বিশেষত্ব দারিদ্র্যসমাজের ব্যথা, কৃষাণ রায়তের প্রাত্যহিক দারিদ্র্যজ্বালা, জমিদার প্রজার নিত্য বিরোধের চিত্রণে—“হাড়ে ভেগো মাচকে যাবি কিনা আতিতো কোয়া করিছে। মুই ফুকারিছি তুই ২ ঘুমাইছিস। (তিয়ারিয়া কথা)”।

কিন্তু তবু নিরপেক্ষ বিচারে একথাও ঠিক, এই গ্রন্থে ‘মাইয়া কোন্দল’, ‘ঘটক বিদায়’, ‘খাতক মহাজন’ ইত্যাদি প্রসঙ্গ এত বেশি চেনা যে তাকে বিদেশীর রচনা বলে অনেকে মনে করেন না।

তুলনামূলকভাবে মৃত্যুঞ্জয়ের ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় কৃষাণী যখন দুঃখ করে বলে : “শাকভাত পেট ভরিয়া যেদিন খাই সেদিন তো জন্মতিথি”, কিম্বা ‘বিশ্ববঞ্চক উপাখ্যানে’ ঠকচূড়ামণি তাঁর স্ত্রীকে যখন বলে “ওলো মাগি, যা যা, শীঘ্র পিঠা করিগা—ক্ষুধাতে বাঁচি না”, তখন স্রষ্টার অভিজ্ঞতা বা এই শ্ল্যাঙ্ ব্যবহার অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়।

ইতিহাস: কেরীর নির্দেশ বা প্রেরণাতে তার অনুগামী বাঙালি লেখকদের ইতিহাস চর্চার প্রতি কৌতূহল জাগরণ হয়। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, ‘রাজাবলি’ এবং ‘মহারাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র’ গ্রন্থ তারই ফলশ্রুতি। প্রথমটি বাঙালীর রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত। পরবর্তী গ্রন্থ দুটি ইতিহাস গ্রন্থ। এর মধ্যে রাজীবলোচনের গ্রন্থটির একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। যেমন—১৮১১ খ্রীস্টাব্দে লন্ডনে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়। এছাড়া ১৮৩৪ এবং ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামপুর থেকে এবং ১৭৮০ শকে লঙ সাহেবের নির্দেশে গোপীনাথ চক্রবর্তী এ্যণ্ড কোম্পানী থেকেও পুনঃপ্রকাশিত হয়। শেষ সংস্করণে গ্রন্থের অনেক স্থানের ভাষাবিন্যাস গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন সংশোধন করে দেন। এর দ্বারা গ্রন্থটির পাঠ্যগ্রন্থ রূপে গুরুত্ব বোঝা যায়।