মার্কসবাদ বিরোধী: মার্কস এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিন দশক বাদে ইংল্যান্ডে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদই হল বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদের (evolutionary socialism) প্রথম সুসম্বন্ধ মতবাদ। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ হল মার্কসীয় বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের বিকল্প ব্যবস্থা। সমাজতন্ত্রবাদের এই ফেবিয়ানবাদী রূপটি মার্কসবাদ-বিরোধী, কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ বিরোধী এবং শোধনবাদ-বিরোধী। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা মার্কসবাদের মূলনীতিসমূহকে বাতিল করে দেন। আবার কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের মত তাঁরা স্বপ্নের জগতে বিচরণ করেন না। তাঁরা বাস্তব জগতের বিদ্যমান পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণ করেন এবং প্রায়োগিক কর্মসূচী প্রণয়ন করেন। ফেবিয়ানবাদীরা শোধনবাদীদেরও বিরোধিতা করেন। কারণ তাঁরা কিছু ক্ষেত্রে কতকাংশে মার্কসবাদকে গ্রহণ করার এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মার্কসবাদকে বাতিল করার মত জগাখিচুড়ি দর্শনের সমর্থক নন। শোধনবাদীরা মার্কসবাদের কিছু ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করেছেন এবং মার্কসবাদের প্রধান নীতিগুলিকে বাতিল করে দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা মার্কসবাদকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন। ম্যাক্স বীয়ার তাঁর History of British Socialism শীর্ষক গ্রন্থে মার্কসবাদ ও ফেবিয়ানবাদের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন: “The Philosophy which served Marx in his analysis of capitalist society and in the mobilisation of the working class for socialism consists of the labour theory with class struggle as the dynamic force. The socialism of Webb is based on the extension of the theory of rent and on the growth of the social conscience of the nation.”
রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদ: ইংল্যান্ডের ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ হল রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তারা সামাজিক জীবনে ন্যায় ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী। এই মতবাদের সমর্থকরা সাম্য ও সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনের নীতিতে আস্থাশীল। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক ও বিবর্তনমূলক পথে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে সামাজিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাকে পরিচালনা করার পক্ষপাতী। এই মতবাদের লক্ষ্য হল শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সামাজিক পরিবর্তন সাধন। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মাধ্যমে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বিলোপ সাধনের পক্ষপাতী নন।
ফেবিয়ানবাদ: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বাস্তবে রূপায়ণের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনীতিক সক্রিয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তাঁরা শ্রেণীসংগ্রাম, বিপ্লব ও বলপ্রয়োগের কথা বলেননি। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এবং এ ধরনের সমাজব্যবস্থার অন্যায় অবিচার, অসাম্য-বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরোধিতা করেছেন। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা ধীরে চলার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে ফেবিয়ানদের সমাজতন্ত্রবাদের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দিয়েছেন।
- উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ সাধন করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও পরিষেবা সমূহকে সরকারী মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসতে হবে।
- জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে শিল্পসংস্থাসমূহ পরিচালিত হবে। ব্যক্তিবর্গের মুনাফার লক্ষ্যে শিল্প পরিচালিত হবে না। স্বভাবতই উৎপাদনের প্রকৃতি ও পরিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় হবে সামাজিক প্রয়োজন, মুনাফার সম্ভাবনা নয়।
- ব্যক্তিগত মুনাফার পরিবর্তে সামাজিক পরিষেবাই উৎসাহ-উদ্দীপক বা উদ্দেশ্য হিসাবে পরিগণিত হবে। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনে বিশ্বাসী। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীরা উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসাবে ধীরে চলার নীতিতে এবং গণতান্ত্রিক ও বিবর্তনমূলক উপায়-পদ্ধতিতে বিশ্বাসী।
ইংল্যান্ডেই প্রথম ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ফেবিয়ান সোসাইটি (Fabian Society) এ রকম সমাজতন্ত্রবাদের স্রষ্টা। তদনুসারে সমাজতন্ত্রবাদের এই রূপটির নামকরণ হয় ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ। বিখ্যাত রোমান সেনাপতি ‘কুইনটাস ফেবিয়াস’ [Quintus Fabius (275-302 B. C.)] এর নামকে অনুসরণ করে ‘ফেবিয়ান’ কথাটি দেওয়া হয়। হান্নিবাল (Hannibal)-এর বিরুদ্ধে রোমান জেনারেল ফেবিয়াসের যুদ্ধনীতি ফেবিয়ান সোসাইটির পরিচালন-নীতি হিসাবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। এই রোমান জেনারেলের নীতি ছিল ‘সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করা’।
১৮৮৪ সালে ফেবিয়ান সোসাইটির প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৮৯ সালে ফেবিয়ান রচনাসমূহের (Fabian Essays) প্রকাশ ইংল্যান্ডের রাজনীতিক চিন্তাধারায় সমষ্টিবাদ (collectivism)-এর প্রবণতাকে সূচীত করে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের বিকল্প হিসাবে এই প্রবণতার সূত্রপাত ঘটে। লেইড্লার (H. W. Laidler) তাঁর Social-Economic Movements শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদী ধারণা অনুসারে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রবাদে সংক্রমণ হল এক ক্রমান্বয়িক প্রক্রিয়া। এই মতবাদে বিদ্যমান আর্থনীতিক ও রাজনীতিক সংস্থাসমূহের দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে শিল্পের সামাজিকীকরণের কথা বলা হয়। এই মতবাদে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে চিহ্নিত করা হয়, যে গোষ্ঠীটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থার প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করতে পারবে। সমাজতন্ত্রবাদে উত্তরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে ফেরিয়ানবাদে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পক্ষে জনসাধারণের সামাজিক সচেতনতার বিকাশ ও বিস্তারের উপর জোর দেওয়া হয়।
প্রবক্তাগণ: ফেবিয়ান সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে সমকালীন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও স্বনামধন্য মনীষী ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জর্জ বার্নাড শ (G. B Shaw), গ্রাহাম ওয়ালাস, সিডনি ওয়েব, বিয়াত্রিস ওয়েব (Beatrice Porter Webb), সিডনি ওলিভার, অ্যানি বেসাত্ত, এডওয়ার্ড পিস (Edward R. Pease), মাসিনঘাম (H. W. Masingham), উলিয়াম ক্লার্ক ক্যাম্পবেল (J. Campball) প্রমুখ। এইচ. জি. ওয়েলস্-ও কিছুদিন ফেবিয়ান সোসাইটির সদ্যস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে যাঁরা সদস্য হন তাঁদের মধ্যে জি. ডি. এইচ. কোল এবং হ্যারল্ড ল্যাস্কি (H. J. Laski)-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি
এক: আধুনিককালে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা সমাজের সাংগঠনিক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়। এখনকার সমাজব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র হল একটি ঘটনা। ওয়েব-এর অভিমত অনুযায়ী মানবসভ্যতার ইতিহাসে গণতন্ত্রের অপ্রতিহত অগ্রগতি নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্রবাদের প্রক্রিয়াও মোটামুটি অব্যাহত।
দুই: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদে শ্রেণীসংগ্রামের নীতিকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। ফেবিয়ানদের মতানুসারে সমাজে যে সংঘাত পরিলক্ষিত হয় তা হল জনসমাজের সঙ্গে বিনিয়োগকারী বিত্তবানদের; এই সংঘাত মজুরীজীবীদের সঙ্গে মজুরীজীবীদের নিয়োগকারীদের সংঘাত নয়। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত অনুযায়ী উৎপাদনের উপাদানসমূহ ও বণ্টনের মালিকানা হস্তান্তরিত করতে হবে সমাজের কাছে, শ্রমিক শ্রেণীর কাছে নয়। এবং এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া হবে ক্রমান্বয়িক। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “this transfer should be done gradu ally, applied at any time only to such industries as can be successfully administered by the community and with compensation and such relief to the expropriated individuals as may seem fair to the representatives of the community in the parliament.”
তিন: ফেবিয়ানরা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যসমূহে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়-পদ্ধতি অনুসরণ করার পক্ষপাতী। ফেবিয়ানরা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তাঁরা সমাজতান্ত্রিক প্রচার কার্য ও ভোট ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে চান। তাদের মতানুসারে জনমতের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা বিপ্লবের পরিবর্তে বিবর্তনে বিশ্বাসী। জঙ্গী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পরিবর্তে তারা সংস্কারমূলক উপায়-পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলেন। সমাজে যাতে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে ফেবিয়ানরা সতর্ক ছিলেন। তাঁরা নিজেদের সামাজিক সংস্কারক হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁরা সমাজতন্ত্রবাদকে ব্যবহারিক খ্রীষ্টধর্ম হিসাবে প্রতিপন্ন করে সকলের সহানুভূতি অর্জনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাজন তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। “Their method of attack on capitalism was one of sapping rather than assault, craft rather than force, of subtlety rather than violence…. They tried to create the impression that socialism and collectivism were synonymous terms and what they were aiming at was a harmless and beneficient extension of the state and municipal enterprise.”
চার: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা জমিজমা ও শিল্পমূলধনের উপর ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সমগ্র জনসম্প্রদায়ের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেছেন। এঁদের অভিমত অনুসারে শিল্পমূলধনের উপর প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথাসম্ভব জনসম্প্রদায়ের হাতে আসা দরকার। সমকালীন ইংল্যান্ডে শিল্প পুঁজির উপর এক শ্রেণীর স্বত্তাধিকারীর একচেটিয়া অধিকার কায়েম হয়েছিল। এই অবস্থায় জীবিকার্জনের জন্য অধিকাংশ মানুষকে এই মালিক শ্রেণীর উপরই নির্ভরশীল থাকতে হত। এই অবস্থার অবসানের জন্য ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা উদ্যোগী হন।
পাঁচ: মার্কসীয় ধ্যান-ধারণাকে পরিশীলিত বা পরিমার্জিত করার জন্য ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা বিভিন্নভাবে। উদ্যোগী হয়েছেন। (ক) ফেবিয়ানরা তাঁদের আর্থনীতিক ধ্যান-ধারণাকে মূল্যের শ্রমতত্ত্বের পরিবর্তে রিকার্ডোর (Ricardo) খাজনা তত্ত্বের ভিত্তিতে বিকশিত করেছেন। (খ) সামাজিক পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে ফেবিয়ানরা শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর উপর পুরোপুরি নির্ভর করেননি। তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধারণা চেতনাকে সঞ্চারিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। (গ) ফেবিয়ানরা প্রথম প্রচেষ্টাতেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। তাঁরা ক্রমান্বয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রসমূহে সমাজের ক্রমান্বয়িক গণতন্ত্রীকরণের কথা বলেছেন। ফেবিয়ানরা শিল্পের রাষ্ট্রীয় ও সমবায়িক মালিকানা, শ্রমিক সংঘসমূহের বিকাশ, শিক্ষামূলক আন্দোলনসমূহের অগ্রগতি, সামাজিক সচেতনতার সম্প্রসারণ প্রভৃতির উপর জোর দিয়েছেন।
ছয়: ফেবিয়ানদের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁরা বৃহত্তর ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। ফেবিয়ানরা বিশ্বাস করতেন যে প্রচারকার্যের মাধ্যমে মানুষের মনের পরিবর্তন সাধন সম্ভব। এই কারণে তাঁরা সমাজের অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনের পরিবর্তন সাধনের উপর জোর দিয়েছেন।
সাত: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত অনুযায়ী সমস্ত জমিজমা কোন-না-কোনভাবে জাতীয়করণ করা দরকার। উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সর্বশক্তি নিয়োগ করে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে।
আট: ফেবিয়ানদের মতানুসারে সমাজের পুনর্গঠন করা প্রয়োজন এবং তা এমনভাবে করা দরকার যার ফলে সকলের সাধারণ কল্যাণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সুনিশ্চিত হবে। তাঁরা মনে করেন যে, প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে মুষ্টিমেয় মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি ও আরাম-আয়াসের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হয়। কিন্তু অসংখ্য মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য ও বঞ্চনা-যন্ত্রণার বিনিময়ে মুষ্টিমেয় মানুষের বিলাস-বৈভবের জীবনধারার ব্যবস্থা করা হয়।
নয়: সাবেকি অর্থনীতিবিদ্রা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থনে মূল্যের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসবাদে মূল্যের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থনে। ফেবিয়ানরা মূল্যের এই দুই তত্ত্বকেই বাতিল করে দিয়েছেন। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা এ ক্ষেত্রে রিকার্ডো (Ricardo) ও মিলের মতবাদকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। ফেবিয়ানদের মতানুসারে মূল্য সৃষ্টি করে সমাজ, শ্রমিকরা নয়। অর্থাৎ মূল্য হল সামাজিকভাবে সৃষ্ট বিষয়। সুতরাং মূল্য সমাজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সমাজতন্ত্রবাদের উদ্দেশ্য হল সমাজের সকলের জন্য সমাজ-সৃষ্ট মূল্য অর্জন করা। ধীরে ধীরে জমিজমা ও শিল্পমূলধনকে জনসমষ্টির কাছে হস্তান্তরিত করতে হবে এবং রাষ্ট্রকে অধিকতর জনসাধারণের প্রতিনিধিমূলক করে তুলতে হবে। এইভাবে উপরিউল্লিখিত উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়া যাবে।
দশ: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণমূলক সংস্থা হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। ফেবিয়ানদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রের কার্যাবলীর মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনীতিক অন্যায়-অবিচারের অবসান বা ত্রুটি-বিচ্যুতির মোকাবিলা করা সম্ভব। রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে এঁদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল মানুষের প্রতিনিধি ও অছি, তাদের অভিভাবক, তাদের কাজের লোক, তাদের ম্যানেজার, তাদের সচিব, এমনকি তাদের অংশীদার। ব্যাপক বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়াই বিদ্যমান রাষ্ট্রকে, একেবারে নির্দোষ না হলেও, বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যাবে। এই উদ্দেশ্যে ভোটাধিকারের ভিত্তিকে অধিকতর সম্প্রসারিত করতে হবে, সামাজিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে যাবতীয় অসাম্য-বৈষম্যের বিলোপ সাধন করতে হবে এবং শিক্ষা সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্যকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
এগার: ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ অনুসারে রাজনীতিক দলসমূহের অস্তিত্বকে স্বীকার করা উচিত। প্রয়োজনবোধে ফেবিয়ানদের নিজস্ব রাজনীতিক সংগঠন থাকা দরকার। ফেবিয়ানদের রাজনীতিক সংগঠনের কাজ হবে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনমতকে সংগঠিত করা। জনমত সংগঠনের জন্য তাঁরা বিভিন্ন রকমের প্রকাশনার উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী।
ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা ও মূল্যায়ন
(১) ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ বিভিন্ন বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রীরা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। মার্কসবাদীরা ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদকে ‘বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রবাদ’ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। শ্যুমুপিটার (J. A. Schumpeter) তাঁর Capitalism, Socialism and Democracy শীর্ষক গ্রন্থে ফেবিয়ানদের ‘বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এঙ্গেলস ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদকে ‘পচা-গলা সমাজতন্ত্রবাদ’ (rotten socialism) হিসাবে উপেক্ষা করেছেন।
(২) ফেবিয়ানদের আদর্শবা এবং কল্পনাবাদী হিসাবেও সমালোচনা করা হয়েছে। সমালোচকদের অভিমত অনুসারে ফেবিয়ানরা হল রুশো ও গ্রীন-এর মত আদর্শবাদী এবং ফুরিয়ে ও ওয়েন (Faurier and Owen)-এর মত কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী।
(৩) অ্যাডাম স্মিথ এবং হার্বার্ট স্পেনসার-এর অনুগামী উদারনীতিবাদীরা ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। এঁদের অভিযোগ অনুসারে ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষতি সাধন করে ফেবিয়ানরা রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে প্রসারিত করেছে।
(৪) ফেবিয়ানরা রাষ্ট্রকৃত্যকদের মাধ্যমে জনসাধারণের সঙ্গে রাষ্ট্রকে একীভূত করেছেন। কিন্তু সমালোচকদের অভিযোগ অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্রকৃত্যকরা। এই রাষ্ট্রকৃত্যকরা ব্যবসায়ী ব্যক্তিবর্গের থেকে অধিক শোষক প্রকৃতির হতে পারে। সরকারী কৃত্যকদের উপরই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। কিন্তু এই সমস্ত সরকারী আমলারা শাসিত জনসাধারণের থেকে স্বতন্ত্রভাবে ঊর্ধ্বতন শাসক এলিট শ্রেণী গড়ে তুলবেন না, তা জোর করে বলা যায় না।
(৫) ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য ব্যবহারিক বিষয়াদির সঙ্গে অধিকতর সম্পর্কিত; তাত্ত্বিক বিষয়াদির সঙ্গে এর সম্পর্ক দুর্বল। এই কারণে ফেবিয়ান মতাদর্শ বলতে যা বোঝায়, তা দুর্বল। রাজনীতিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয় বিষয়াদির সঙ্গে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্যের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। ল্যানকাসটার তাঁর Masters of Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Surely there is something incompatible with democracy in a plan under which man are enrolled in the service of the community under strict subordination and paid by bureaucratically deter mined allowances.”
(৬) ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীদের উপায়-পদ্ধতিসমূহও সমালোচিত হয়েছে। ফেবিয়ানরা মতাদর্শগত বিচারে সমাজতন্ত্রবাদ হিসাবে যা প্রতিপন্ন করেন, বাস্তবে তা না বুঝিয়ে একেবারে অন্য বিষয় বোঝান। তাঁরা মতাদর্শগত বিচারে পুঁজিবাদের অবসান, জমিদারি অধিগ্রহণ, প্রতিযোগিতার অবসান, ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিলোপসাধন প্রভৃতির পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা রাষ্ট্রীয় ও পৌর প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগ-আয়োজনের পরিধিকে প্রসারিত করেন। বার্কার (Ernest Barker) তাঁর Political Thought in England শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The Fabian Society is the least open and least straightforward social organisation. It habitually and on principle sails under a false flag, wishing not to arouse suspicion as to its objects. Fabians rely for their success chiefly on their artfulness.”
ফেবিয়ান সমাতন্ত্রবাদের বিরূপ সমালোচনা প্রসঙ্গে গ্রে-র একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “Suffering from the Narcissus complex, they rather too much given to contemplating themselves. In their missionary zeal for truth of self advertisement, they were perhaps too adapt to winnow with every wind and to go into every way.
বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদের অবদানকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ফেবিয়ানদের সদর্থক অবদানকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়।
(১) ফেবিয়ান সমাজের সদস্যের মধ্যে সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত বহু ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের মতামত মানুষকে তখন বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ফেবিয়ানদের মর্যাদাপূর্ণ ও পরিশীলিত পদ্ধতি মানুষকে মুগ্ধ করেছে। স্বভাবতই ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা সহজেই তাঁদের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রচার ও প্রসারে সাফল্য পেয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে কোন রকম তিক্ততা বা মতান্ধতার সৃষ্টি হয়নি। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে যুক্তিবাদিতা, মর্যাদাবোধ, প্রশান্তিপূর্ণ মানসিকতা বর্তমান ছিল। ফেবিয়ানদের মধ্যে দলীয় সংকীর্ণতা ছিল না।
(২) শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের পক্ষে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীদের সদর্থক ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। বস্তুত ফেবিয়ানরা শ্রমজীবীদের স্বার্থের সামগ্রিক উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্নভাবে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেছেন। ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলন নানাভাবে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীদের কাছে ঋণী। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এবিষয়ে বলেছেন: “What they (Fabians) said and did was taken over by the leaders of the labour movement and that ultimately went into the philosophy of the Labour Party.”
(৩) প্রকৃত প্রস্তাবে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদীরা সংস্কারমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। হিতবাদী বেন্থাম (Bantham)-এর মত তাঁরা সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রসমূহে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসমূহ সম্পর্কে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছেন। এ বিষয়ে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রীরা যুক্তিগ্রাহ্য ও অর্থবহ বহু আলোচনা করেছেন।
পরিশেষে কোকার (F. W. Coker)-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা আবশ্যক। কোকার তাঁর Recent Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “(It) may be said generally that the Fabian So cialists have contributed more to practice than to theory. The diligence and intelligence with which they have assembled and explained facts about the actual economic and social conditons of Great Britain have contributed substantially to the success with which national and local government in that country have gradually and cautiously put into actual operation a very moderate sort of socialism.”
Leave a comment