মহম্মদ-বিন-তুঘলকের মৃত্যুর (২০ মার্চ, ১৩৫১ খ্রিঃ) দুদিন পরে (২৩ মার্চ) সিন্ধুতে সামরিক ছাউনির ভেতর অভিজাত ও সেনাপতিগণ ফিরোজ তুঘলককে পরবর্তী সুলতান মনোনীত করেন। ফিরোজ ছিলেন মহম্মদ তুঘলকের কাকা রজবের পুত্র। ফিরোজের মা ছিলেন ভাট্টি রাজপুতগোষ্ঠীর হিন্দুরাজা রণমল ভাট্টির কন্যা নইলা। বাল্যকাল থেকেই ফিরোজ ছিলেন মহম্মদের স্নেহধন্য ও সহযোগী। মহম্মদের আকস্মিক মৃত্যু সুলতানি বাহিনীর মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সিন্ধু অভিযানে মোঙ্গলরা মহম্মদ তুঘলককে সৈন্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। মোঙ্গলনেতা তরমাশিরিনের জামাই নওরোজ এই অভিযানে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুলতানের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে নওরোজের নেতৃত্বে মোঙ্গল সৈন্যরা সুলতানি বাহিনীকেই আক্রমণ করে। থাট্টার স্থানীয় জনগণও সুলতানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। নেতৃত্বহীন সুলতানি বাহিনী দিশাহারা অবস্থায় কেবল মারই খেতে থাকে। এমতাবস্থায় সেনাপতি ও অভিজাতগণ ফিরোজকে সুলতান হিসেবে মনোনীত করে পরিস্থিতির সামাল দেয়।
দিল্লির সিংহাসনে ফিরোজের দাবির বৈধতা সম্পর্কে কিছুটা মতভেদ আছে। মহম্মদ তুঘলক মৃত্যুর পূর্বে ফিরোজকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এদিকে সুলতানের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ামাত্র সুলতানের সহকারী খাজা-ই-জাহান এক নাবালককে মৃত সুলতানের পুত্র হিসেবে সিংহাসনে বসিয়ে ফিরোজকে তার অভিভাবক হিসেবে কর্মসম্পাদনের জন্য আহ্বান জানান। আবার সুলতানের ভগিনী খুদাবন্দজাদা নিজ পুত্র দাওয়ার মালিককে পরবর্তী সুলতান মনোনীত করার দাবি উত্থাপন করে বিষয়টিকে আরও জটিলতর করে তোলেন। বারাণীর মতে, ফিরোজ সুলতান-পদে মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু স্যার উলসী হেগ নির্দিষ্ট তথ্যের অভাবহেতু বারাণীর বক্তব্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, খাজা জাহান কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন সিংহাসনের বৈধ দাবিদার। আবার ড. বীপ্রসাদ মনে করেন, মহম্মদ তুঘলকের কোনো পুত্রসন্তান বর্তমান থাকলে তাঁর ভগিনী কখনোই নিজপুত্রের দাবি উত্থাপনের সাহস পেতেন না। তাঁর মতে, উলসী হেগ ফিরোজকে ‘জবরদখলকারী’ বলে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা-ও যথার্থ নয়। কারণ সুলতানি আমলে নির্দিষ্ট কোনো উত্তরাধিকারী আইন ছিল না। সিংহাসনের অধিকারী ফিরোজ ছিলেন বুদ্ধিমান ও শক্তিমান ব্যক্তি। পরন্তু সেনাপতি ও অভিজাতদের স্বীকৃতি ফিরোজকে যথেষ্ট বৈধতা প্রদান করেছিল। যাই হোক্, খাজা-ই-জাহান শেষ পর্যন্ত ফিরোজের দাবি মেনে নেন এবং আনুগত্য প্রকাশ করেন।
ফিরোজের সিংহাসনারোহণ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হিন্দুমাতার সন্তানও মসনদে স্বীকৃতিলাভের যোগ্য, জাতিচিন্তা বা ধর্মচেতনা মনোনয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন প্রতিভাত হয়। দ্বিতীয়ত, ফিরোজের মনোনয়ন প্রমাণ করেছিল যে, মধ্যযুগেও সামরিক প্রতিভাধর না-হয়েও সুলতানি সিংহাসনে বসা যায়। তৃতীয়ত, আবার প্রমাণিত হয় যে, সুলতান মনোনয়নের কাজে অভিজাতদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সিন্ধুতে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ফিরোজকে সিংহাসনে বসার অনুরোধ করলে ফিরোজ প্রথমে তা গ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিলেন। পরে দিল্লির উলেমা এই অভিজাতদের ইতিবাচক মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সিংহাসন গ্রহণ করেন। ড. আগা মেহদী হোসেনের মতে, ফিরোজ সিংহাসনে বসার জন্য অনেক আগে থেকেই উলেমাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। সিংহাসনে বসার পর তাঁর উলেমা-প্রীতি ড. হোসেনের মন্তব্যকেই সমর্থন করে। যাই হোক্, ফিরোজ বিদ্রোহী মোঙ্গলদের দমন করে বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং দিল্লির পথে অগ্রসর হন। খাজা-ই-জাহান উপায়ান্তর না দেখে ফিরোজের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ফিরোজ প্রথমে তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন; কিন্তু পরে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। দিল্লিতে প্রবেশ করে একুশ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর অভিষেক ক্রিয়া পালন হয়।
ফিরোজের অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনহিতকর কার্যাবলি:
ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বকাল সামরিক কর্তৃত্ব বা সাফল্যের দিক থেকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সংস্কার বা জনহিতকর সামাজিক কর্মসূচির দিক থেকে। ফিরোজ যখন সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বয়স চল্লিশ অতিক্রান্ত। মহম্মদ তুঘলকের সঙ্গী হিসেবে তিনি দেখেছেন কীভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষোভ মুসলমানদের কাছ থেকে সুলতানকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কীভাবে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। তাই ফিরোজ প্রথম থেকেই ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ অভিজাতদের প্রতি তোষণ-নীতি অনুসরণ করতে থাকেন। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছরের শাসনকালে তিনি এমন কিছু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন যা তাঁর সামরিক দুর্বলতাকে ঢেকে দিতে পারে। তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ছিল যুগোত্তীর্ণ। রাজ্যজয় দ্বারা গৌরব অর্জনের পরিবর্তে জনকল্যাণমুখী দ্বারা প্রজাসাধারণের সুখশান্তি প্রতিষ্ঠাকে তিনি অধিক গুরুত্ব দেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন: “He was probably the first Muslim ruler in India, who regraded the promotion of material welfare of subjects as a more important duty of the king than wars and conquests.” ফিরোজের এই কাজে প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী খান-ই-জাহান মকবুল। তেলেঙ্গানার ব্রাহ্মণবংশজাত এই ধর্মান্তরিত হিন্দু ছিলেন বিচক্ষণ ও দক্ষ প্রশাসক। সুলতান প্রকাশ্য সভায় এঁকেই প্রকৃত সুলতান বলে সম্মানিত করতেন। প্রতিদানে ইনিও স্বার্থশূন্যভাবে সুলতান ফিরোজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিলেন। সুলতানের কর্তব্য হিসেবে ফিরোজ শাহ যে উচ্চ আদর্শ পোষণ করতেন, তার বহু উল্লেখ সমসাময়িক রচনা থেকে পাওয়া যায়। সামস-ই-শিরাজ আফিফ-এর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি এবং ইয়াহিয়া শিরহিন্দের ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি’ গ্রন্থে ফিরোজকে তাঁর উদারতা ও আদর্শবাদের জন্য একজন মহান ও সফল শাসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফিরোজ তুঘলক স্বয়ং তাঁর ‘ফুতুহ-ই ফিরোজশাহি’ গ্রন্থে তাঁর রাজাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তাবাকত্-ই-আকবরী’ গ্রন্থের মতে, ফিরোজের ‘ফতোয়াৎ’ হল একটি অনুশাসন যা প্রধানত সুন্নি-গোষ্ঠীভুক্ত মুসলমানদের জন্য জামা মসজিদে উৎকীর্ণ করা আছে। এখানে ফিরোজ অতীতে অপরাধীদের, বিশেষত মুসলমানদের ওপর অঙ্গচ্ছেদ, অগ্নিদগ্ধ করা, জীবন্ত চামড়া খুলে নেওয়া ইত্যাদি নৃশংস শাস্তিবিধানের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন এবং দয়ালু ঈশ্বর কর্তৃক নির্দিষ্ট পুরুষ হিসেবে মুসলমান ও অন্যান্যদের ওপর এই অন্যায় জুলুম বন্ধ করার দায়িত্ব স্বীকার করেছেন। ফিরোজ এখানে মূলত মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. নিজামী লিখেছেন যে, এই সকল শাস্তি দেওয়া হত প্রধানত দুটি অপরাধের জন্য— বিদ্রোহ এবং সরকারি অর্থ প্রদান না করা। এবং একাজে অংশ নিত প্রধানত মুসলমানরা। তাই ফিরোজ কেবল মুসলমানদের কথাই উল্লেখ করেছেন। ফিরোজ এইসকল অত্যাচার নিষিদ্ধ করেন এবং অরাজনৈতিক অপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব কাজির ওপর ন্যস্ত করেন। কিন্তু ফিরোজ চুরি, রাহাজানি, হত্যা ইত্যাদির জন্য বিকল্প শাস্তির উল্লেখ না করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
ফিরোজ শাহর অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে উদারতার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর সিংহাসনারোহণের কালে দেশের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও কর ব্যবস্থা প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। প্রথমেই তিনি মহম্মদ তুঘলকের আমলে প্রদত্ত সমস্ত ‘তক্ভি’ ঋণ মকুব করার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে রাজকোষ কিছুটা আঘাত পায় ঠিকই, কিন্তু জনসাধারণের মনে সুলতানের প্রতি আস্থাও স্থাপিত হয়। তিনি সমস্ত রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করেন এবং চাষিদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে অর্থ আদায় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দেন। কর আদায়ের জন্য প্রজাসাধারণের ওপর দৈহিক নির্যাতনের রীতিও তিনি নিষিদ্ধ করে দেন।
বারাণীর মতে, ফিরোজ উৎপাদনের ভিত্তিতে কর ব্যবস্থা নির্ধারণ করে তাঁর রাজত্বকে দৃঢ়ভিত্তি দিয়েছিলেন। আফিফ লিখেছেন : সারাদেশের জমি ও উৎপাদন সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহের ভার সুলতান খাজা হাসিমউদ্দিন জুনাইদ নামক ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করেন। জুনাইদ প্রায় ৬ বছর সারাদেশ ভ্রমণ করে দেশের বার্ষিক আয় স্থির করেন ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ তঙ্কা। তবে জুনাইদ জমি জরিপ করে কিংবা উৎপাদনের গড় বিশ্লেষণ করে করের এই হার নির্ধারণ করেননি। মোটামুটিভাবে সহকারী কর্মচারীদের অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই এই হার নির্ধারিত হয়েছিল। তবে আফিফ সরকারি প্রাপ্য হিসেবে প্রাথমিক যে অঙ্কের উল্লেখ করেছেন, সেটিকেই ফিরোজের রাজত্বের শেষ দিন। পর্যন্ত সরকারি প্রাপ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মৌরল্যান্ড, ড. নিজামী প্রমুখ আফিফের বিবরণ সঠিক নয় বলে মনে করেন। কারণ ফিরোজ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ফলে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকারি প্রাপ্য তঙ্কা বা জিতলের হিসেবে স্থির হয়েছিল। এর কারণ সম্ভবত দেশের সর্বত্র শস্যের দাম এক ধরে নিয়ে এই হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। মোরল্যান্ড মনে করেন, সমস্ত প্রদেশে সরকারি পাওনার পরিমাণ সমান ছিল না। কারণ স্থানীয় উৎপাদনের অর্ধেক শস্যের বাজারমূল্য রাজস্ব হিসেবে সংগৃহীত হত। যেহেতু সমস্ত অঞ্চলের উৎপাদনের হার সমান নয়, তাই শস্যমূল্য এক ধরে নিলেও প্রাপ্য রাজস্বের তারতম্য ছিল অনিবার্য।
ফিরোজ প্রজাদের করভার লাঘব করার জন্য প্রথমেই পঁচিশটি তুচ্ছ, বেআইনি ও অন্যায্য কর রহিত করে দেন। কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’তে বলা হয়েছে: “Firuz abolished some twenty five vaxatious cessess mostly in the nature of octroi duties which had weighted heavily upon merchants and tradesmen.” কিন্তু ‘ফতোয়া-ই-ফিরোজশাহিতে এই ধরনের ছাব্বিশটি কর মকুবের কথা বলা হয়েছে। যাই হোক্, সুলতান ফিরোজ যে অনেকগুলি অজনপ্রিয় শুল্ক মকুব করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বণিকদের কাফেলার ওপর অন্যায় জুলুম এবং বিনা পারিশ্রমিকে সরকারি ইট বহন করে ফিরোজাবাদ শহর নির্মাণে সহযোগিতা করার রীতি বহিরাগত বণিকদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল। শুল্কবিভাগের কর্মচারীদের অসততা ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও সুলতানের জ্ঞাত ছিল। বণিকদের অসন্তোষ প্রশমন এবং শুল্ক-কর্মচারীদের অসাধুতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ফিরোজ শাহ শরিয়তে উল্লেখ নেই এমন সমস্ত কর বিলোপ করে দেন।
রাজকোষে অর্থাগমের জন্য তিনি শরিয়তের নির্দেশ মোতাবেক খরাজ, জাকৎ, জিজিয়া ও খামস— এই চার প্রকার কর বহাল রাখেন। ‘খরাজ’ বা ভূমিরাজস্ব ছিল কোষাগারের আয়ের প্রধান উৎস। সাধারণভাবে উৎপাদনের এক-দশমাংশ খরাজ হিসেবে গ্রহণ করা হত। আলাউদ্দিন খলজির আমলে ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ছিল মোট উৎপাদনের অর্ধেক। এই বিচারে ফিরোজের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে কৃষি উৎপাদকশ্রেণির কষ্ট অনেকটাই লাঘব করেছিল। ‘জাকৎ’হল মুসলমানদের দেয় সম্পত্তি-কর। মোট সম্পত্তির ওপর দুই থেকে আড়াই শতাংশ হারে এই কর দিতে হত। সাধারণভাবে এই অর্থ দরিদ্র মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের কাজে ব্যয় করা হত। “জিজিয়া’ হল অ-মুসলমানদের ওপর আরোপিত একপ্রকার ধর্ম-কর। পবিত্র গ্রন্থে অবিশ্বাসীদের ‘জিম্মি’ বা সুরক্ষিত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি মুসলিম রাষ্ট্রে এই সুরক্ষা বা নিরাপত্তার বিনিময়ে অবিশ্বাসীদের ওপর জিজিয়া কর আরোপ করা হয়। অবশ্য এই কর প্রদানের কারণে অ-মুসলমান ‘জাকৎ’ প্রদান থেকে রেহাই পেত এবং তাদের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী বা যুদ্ধে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল না। ইতিপূর্বে ব্রাহ্মণরা জিজিয়া প্রদান থেকে রেহাই পেতেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ ব্রাহ্মণদের ওপরেও জিজিয়া আরোপ করেন। আয়ের ভিত্তিতে অ-মুসলমানদের তিনটি স্তরে ভাগ করে তিনটি হারে জিজিয়া আদায় করা হত। রাজত্বের মাঝামাঝি সময়ে ফিরোজ উলেমাদের অনুমোদনক্রমে একটি সেচ কর আরোপ করেছিলেন। সরকারি উদ্যোগে যে-সকল জমি সেচের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেগুলির উৎপাদনের এক-দশমাংশ সেচ কর হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। ‘খামস’ হল লুণ্ঠিত দ্রব্য বা খনিজ দ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ।
আফিফের বিবরণ থেকে জানা যায়, ফিরোজ সামরিক ও অসামরিক কর্মচারীদের জীবিকার জন্য তঙ্কার বিনিময়ে তাদের ভূমিরাজস্ব বিলিবণ্টন করে দেন। ১০ হাজার, ৫ হাজার ও ২ হাজার তঙ্কা বেতনের পরিবর্তে সমপরিমাণ রাজস্বের জমি তিনি সরকারি কর্মচারী, বিশেষত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিলিবন্দোবস্ত দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফিরোজের পূর্ববর্তী কোনো সুলতানই কর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে ভূমিরাজস্ব বণ্টনের নীতি নেননি। আলাউদ্দিন স্পষ্টতই এই ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। কারণ কোনো গ্রাম কোনো বিশেষ কর্মচারীদের অধীনে বন্দোবস্ত থাকলে সেই গ্রামের বসবাসকারী মানুষেরা উক্ত সরকারি কর্মীর অধীনে ও নেতৃত্বে রাজদ্রোহী হতে পারত। আফিফ লিখেছেনঃ ফিরোজ দেশের সমস্ত গ্রাম, জেলা (খাতাত) এবং শহর সেনাদের মধ্যে বিলি করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক নিজামীর মতে, আফিফের এই বিবরণ তাঁর অজ্ঞতা ও মূর্খামির ফল। নিজামীর মতে, ফিরোজের আমলেও সরকারি কর্মচারীরা রাজস্ব আদায় করত। যে সকল সামরিক কর্মী বেতন হিসেবে জমির রাজস্ব বন্দোবস্ত পেতেন, তাঁরা সুলতানের নির্দেশনামা (ইলাক) দেখিয়ে নির্দিষ্ট জমির রাজস্ব আদায়কারীর কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন। সাধারণভাবে আদায়ীকৃত রাজস্বের অর্ধাংশ কর্মচারীর বেতন হিসেবে দিতে হত। অর্থাৎ খাজনা আদায়ের ব্যাপারে assignee বা স্বত্বাধিকারী সরকারি কর্মীর (সৈন্য) কোনো ভূমিকা ছিল না। আফিফ নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, সৈন্যরা অনেক ক্ষেত্রে নগদ অর্থে বেতন পেত। অবশ্য রাজস্বের স্বত্বাধিকারী ইচ্ছা করলে তাদের ‘ইত্লাক’ দালালের কাছে অল্প দামে বিক্রি করে দিতে পারত। এর ফলে একশ্রেণির দালাল প্রচুর অর্থ রোজগার করতে সক্ষম হয়েছিল।
অসামরিক কর্মচারীরা প্রাপ্ত বন্দোবস্তের অধীনে রাজ্যাংশের শাসনদায়িত্বও পালন করতেন, যা সামরিক কর্মীরা করতেন না। সরকারি কর্মী ছাড়া উলেমা, বিদ্বান, ধর্মীয় স্থান, প্রাক্তন কর্মী ইত্যাদিও দানখয়রাত হিসেবে ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ভোগ করতেন। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়, এমন কোনো কর আদায় না করার বিষয়ে ফিরোজ রাজস্ব কর্মচারীদের কঠোর নির্দেশ দেন। কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যশুল্কও ফিরোজ রহিত করে দেন।
আফিফের মতে, ফিরোজের রাজস্ব সংস্কারের ফলে দেশ ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছিল। তাঁর মতে, “প্রজাদের গৃহ শস্য, সম্পদ, স্বর্ণ, অশ্ব ও মহার্ঘ আসবাবে পরিপূর্ণ থাকত। প্রত্যেক রমণী স্বর্ণ বা রৌপ্যালংকারে ভূষিতা থাকতেন। প্রত্যেকের ঘরে শোভা পেত মহার্ঘ আসবাব।” আফিফের মতে, এই সুফল কেবল শহর নয়, সমগ্র দেশেই সম্প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু নিজামী মনে করেন, ফিরোজের এই ব্যবস্থা সাধারণ প্রজাকে সরকারি কর্মচারীদের লোভ ও শোষণের শিকারে পরিণত করেছিল। তারা ইচ্ছামতো অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছিল এবং এটিই ছিল সুলতানির পতনের অন্যতম একটি কারণ।
অর্থনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম অঙ্গ হিসেবে ফিরোজ সেচব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করেন। ১৫০ মাইল দীর্ঘ একটি খাল কেটে যমুনা নদী থেকে হিসার-এ জল আনা হয়। শতদ্র থেকে ঘর্ঘরাতে জল আনার জন্য কাটা হয় প্রায় ৯৬ মাইল দীর্ঘ একটি খাল। সিরমুর উপত্যকা থেকে একটি খাল টানা হয় হালী পর্যন্ত। অন্য দুটি খাল কাটা হয় যথাক্রমে ঘর্ঘরা থেকে ফিরোজাবাদ এবং যমুনা থেকে ফিরোজাবাদ পর্যন্ত। এ ছাড়া দেড় শতাধিক কূপ খনন করে তিনি কৃষি-সেচ ও পানীয় জলের সুরাহা করেন। এই সকল সেচ-পরিকল্পনার ফলে কৃষি-উৎপাদনের এলাকা অনেকটাই বৃদ্ধি পায় এবং সরকারি কোষাগারের আয়ও বৃদ্ধি পায়।
সুনির্মাতা হিসেবেও ফিরোজ তুঘলক কম কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না। ফেরিস্তার মতে, ফিরোজ ৫০টি বাঁধ, ৪০টি মসজিদ, ৩০টি কলেজ, ২০টি প্রাসাদ, ১০০টি সরাইখানা, ২০০টি শহর, ৩০টি জলাধার, ১০০টি চিকিৎসালয়, ৫টি সমাধি সৌধ, ১০০টি স্নানাগার, ১৫০টি সেতুসহ অসংখ্য বাগিচা, বিনোদন-গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ নির্মিত শহরগুলির মধ্যে অন্যতম হল ফিরোজাবাদ, ফতেয়াবাদ, হিসার, জৌনপুর, ফিরোজপুর ইত্যাদি। আফিফ তাঁর রচনায় ফিরোজাবাদ শহরের বিশালতা ও বৈভবের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বর্তমান নিউ দিল্লির কোটলা ফিরোজ শাহ সেই সমৃদ্ধ নগরের অংশবিশেষ বলে চিহ্নিত হয়। নির্মাণকার্যে ফিরোজের প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর প্রধান স্থপতি মালিক গাজি সাহানা। স্থাপত্যকর্মে নিজের একান্ত অনুরাগ সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে ফিরোজ লিখেছেন : “ঈশ্বর আমার ওপর যে সকল গুণাবলি সম্প্রসারিত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল নির্মাণের একান্ত ইচ্ছা। সেজন্য আমি বহু মসজিদ, বিদ্যালয় ও ধর্মক্ষেত্র নির্মাণ করেছি, যেখানে ত্যাগী, পবিত্র জ্ঞানীগণ ঈশ্বরের আরাধনা করতে এবং নির্মাতাদের জন্য প্রার্থনা জানাতে পারেন।” ঐতিহাসিক উলসী হেগ নির্মাতা হিসেবে ফিরোজের দক্ষতা ও কৃতিত্বকে রোমক সম্রাট আগস্টাস-এর সাথে তুলনা করেছেন। ড. স্মিথও (V. A. Smith) মনে করেন যে, “পূর্বসুরিদের নির্মাণকর্মকে রক্ষা করার যে সহজাত অনীহা এশীয় রাজাদের ছিল, ফিরোজ তা অতিক্রম করতে সক্ষম হন এবং তাঁর পূর্বসুরিদের নির্মিত স্থাপত্যকর্মগুলিকে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকে বিশেষ নজর দেন” (“Asiatic kings, as a rule show no interest in buildings erected by their predecessors…….. Firuz Shah was peculiar in devoting much attention to the repair and re-building of the structures of the former kings….giving the resotoration of those buildings the priority over his own construction.”)।
শাসনতন্ত্রকে ফিরোজ এক প্রজাহিতকর মিশন’ বলে গণ্য করতেন। তাই প্রজাদের বৈষয়িক উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে দুঃখী ও দুঃস্থদের সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতার ভার লাঘবের চেষ্টা করেন। মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের আমলে রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে তিনি সরকারি সাহায্য দেন এবং শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘মার্জনা-পত্র’ সংগ্রহ করে সেগুলিকে মহম্মদ তুঘলকের সমাধির পাশে রাখেন, যাতে ঈশ্বর মহম্মদের কৃত-অপরাধ মার্জনা করেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এটি ফিরোজের কোমল ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ মনোভাবের অন্যতম নিদর্শন। তিনি লিখেছেন : “There is however, no doubt that in doing this Firuz was actuated by a spirit of piety and benevolence rarely witnessed among the rulers of the age.” এই মানবিকতা ও মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর আরও কয়েকটি প্রজাকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে। জনসাধারণের চিকিৎসার জন্য তিনি দিল্লিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ‘দার উল্-সিফা’ নামক এই চিকিৎসালয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। এই হাসপাতালের ব্যয়নির্বাহের জন্য সুলতান কয়েকটি গ্রামের রাজস্ব স্থায়ীভাবে বরাদ্দ করেছিলেন। সম্ভবত, রাজ্যের অন্যত্র এ ধরনের আরও কয়েকটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়েছিল। দুঃস্থ পরিবারের বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিবাহে অর্থসাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্যে সুলতান ‘দেওয়ান-ই-খয়রাত্ নামে একটি দপ্তর গঠন করেন। এখান থেকে অনাথ ও দুঃস্থ বিধবাদেরও অর্থসাহায্য দেওয়া হত। এ ছাড়া, দেশের যোগ্য ব্যক্তিদের অর্থসাহায্য করার জন্য ‘দেওয়ান-ই-হস্তিহক’ নামে আরও একটি দপ্তর স্থাপন করেন। আফিফলিখেছেন : প্রতি বছর এই দপ্তর থেকে প্রায় ৪,২০০ ব্যক্তি সাহায্য পেতেন এবং বরাদ্দের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৬ লক্ষ টাকা। বেকার যুবকদের চাকুরির সংস্থান করে দেওয়ার দিকেও তিনি দৃষ্টি দেন। দিল্লির কতোয়ালকে তিনি বেকার যুবকদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন এবং যোগ্যতা অনুসারে চাকুরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
বিদ্যাচর্চা ও বিদ্বান ব্যক্তির প্রতি ফিরোজের অনুরাগের অভাব ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে ফিরোজ শাহ জ্ঞানচর্চায় আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন। আগ্রহী ব্যক্তিদের জ্ঞানান্বেষণে যাতে বাধা না পড়ে, সেদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল। বিদ্যানুশীলনের জন্য তিনি বহু মাদ্রাসা এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজকোষ থেকে পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়মিত অর্থসাহায্যেরও ব্যবস্থা করেন। ইতিহাসচর্চার প্রতি তাঁর আন্তরিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর উৎসাহে জিয়াউদ্দিন বারাণী এবং সামস্-ই-সিরাজ আফিফ যথাক্রমে ‘ফুতুহ-ই-জাহান্দারী’ও ‘’তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’গ্রন্থ দুটি রচনা করেন। ইতিহাসমূলক উপাদানে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থ দুটিকে সমকালীন ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁর বিদ্যানুরাগের আর একটি প্রমাণ হিসেবে বলা যায় যে, নগরকোট অভিযানের শেষে প্রায় ৩০০টি সংস্কৃত গ্রন্থ তাঁর দখলে আসে। সুলতান সেই অমূল্য পুঁথিগুলিকে সযত্নে একটি পাঠাগারে সংরক্ষিত করেন। আজাজউদ্দিন খালিদ ঘানী নাম্নী জনৈক পণ্ডিতের সাহায্যে বেশ কয়েকটি সংস্কৃত পুঁথি তিনি ফারসিতে অনুবাদ করেন। এগুলি ‘দালাল-ই-ফিরোজশাহি’ নামে সংকলিত হয়। সরকারি ব্যয়ে বিদেশ থেকে পণ্ডিতদের এনে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োগ এবং শিক্ষার্থীদের অনুদান মঞ্জুর করার ব্যবস্থা ফিরোজ শাহ-র আন্তরিক শিক্ষানুরাগের পরিচয় দেন।
Leave a comment