‘ফসিল’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ জীবাশ্ম। লক্ষ লক্ষ বছর আগে চাপাপড়া ভূগর্ভের মৃত্তিকার স্তরে আবদ্ধ থাকা প্রাণীদেহের শিল্পীভূত কঙ্কাল বা হাড়ের খণ্ডকে ফসিল বলে। নৃতাত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ফসিলের উপর গবেষণা করেই অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বহু বিচিত্র প্রাণীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ফসিল নামটির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে লক্ষ লক্ষ বছর ব্যাপ্ত এক বিশাল পটভূমি। সুবোধ ঘোষ তার ফসিল গল্পটিতে এই রকমই এক ব্যাপ্ত পটভূমিকে স্থাপন করেছেন।
‘ফসিল’ গল্পে দেখানো হয়েছে অবক্ষায়িত সামন্ততন্ত্রের রূপ। ‘নেটিভ স্টেট অঞ্জনগড়’কে কাহিনির স্থান রূপে উপস্থাপিত করে সামন্ত রাজাদের অবক্ষয় ও শোষণকে গল্পকার রূপ দিয়েছেন। পাশাপাশি সদ্য গড়ে ওঠা ধনতান্ত্রিক শাসনের নির্মমতাও গল্পের প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। যদিও একদিকে সামন্ততন্ত্রের ক্রমাবলুপ্তি অন্যদিকে ধনতন্ত্রের আগ্রাসন উপস্থাপনাই ফসিল গল্পের শেষ সত্য নয়। শোষণ প্রক্রিয়ায় সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র যে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে ফসিল গল্পে তা-ও বর্ণিত হয়েছে।
গল্পটির সূচনায় আছে অবক্ষয়িত সামন্ততন্ত্রের রূপ। পরবর্তী পর্যায়ে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের সুযোগে ধনতন্ত্রের অগ্রাসন-এর বিষয়টিও যথাযথ রূপ পেয়েছে। ফলত উভয়ের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং গল্পকার সেই সংঘাতের পটভূমিটিও রচনা করেছেন সুকৌশলে। কিন্তু আকস্মিক দুটি দুর্ঘটনা এই উভয় শাসকশ্রেণিকে একই মানদণ্ডে স্থাপন করে দিয়েছে। লেখক দেখিয়েছেন স্বীয় স্বার্থরক্ষার তাগিদে শোষক শ্রেণির মধ্যে কোনো ভিন্নতা থাকে না। নির্মমতাই তখন একমাত্র উপজীব্য বিষয়। যে নির্মমতার অগ্নিদাহে দগ্ধ হয়ে গেছে হতভাগ্য কুর্মী সমাজ। ১৪নং পীটের আকস্মিক খনি দুর্ঘটনায় মাইনিং সিন্ডিকেট গাফিলতি প্রমাণ করার জন্য এবং ধনতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করতে যখন সামন্ত প্রভু অঞ্জনগড়ের মহারাজ উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন ঠিক সেই সময়ই তিনি খবর পেয়েছেন ঘোড়ানিমের জঙ্গলে লকড়ি কাটতে গিয়ে তারই ফৌজবাদের গুলি চালনায় নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন প্রজা। এই নরহত্যার কলঙ্ক চাপা দিতেই সিন্ডিকেট ও মহারাজা বসে গেছেন একই টেবিলে। আর হতভাগ্য লাশগুলো এবং উভয় ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ও এ গল্পের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চরিত্র দুলাল মাহাতোর লাশটিকেও খনিগর্ভে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সমাজ শাসকদের পাপের একমাত্র সাকী দুলালকে তুলে এনে খুন করা হয়েছে। তারপর দামি পানীয়ের পাত্রে ঠাঁট ছুঁইয়ে শাসক মহারাজ আর বণিক গিবসন; উভয় শ্রেণির প্রতিনিধিদের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। গিবসন মহারাজার কথায় সায় দিয়ে বলেছে—“অনেক ক্লামজি ঝঞ্ঝাট থেকে বাচ। গেল। আমাদের উভয়ের ভাগ্য বলতে হবে।”
সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের এই মিলিত নির্মমতা, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অসহায় বিপন্নতা দেখিয়ে গল্পকার কাহিনির সমাপ্তি টানতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। গল্পটিকে কোনো নির্দিষ্ট কালসীমায় আবদ্ধ না রেখে তিনি মহাকালের ব্যাপক বিস্তৃত পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। “গল্পের শেষে রসজ্ঞ পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারেন যে অঞ্জনগড়কে নিয়ে লিখিত এই গল্পটি শুধুই অঞ্জনগড়ের নয়। মানুষের ইতিহাসে এই রকম অন্ধকারময় দিন বারবার এসেছে সেই ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য রেখেই গল্পের সমাপ্তি এবং নামকরণ—শুধু শ্রমিকদের দেহ শেষ পর্যন্ত ফসিল হয়ে যাবে ভেসেই এই নামকরণ নয়। জীবজগতের বিভিন্ন বিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে যেমন কিছু ফসিলকে আমরা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে জীবজগতের অভিব্যক্তির ধারাটিকে বুঝতে পারি; তেমনি মানবসমাজের ইতিহাস সঠিকভাবে জানতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে কিছু ঘটনা ও বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস—যা নিখুঁতভাবে রূপায়িত হয়েছে এই গল্পে।”
সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও অস্ত্বি রক্ষার তীব্র প্রয়াস, ধনতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি ও নির্মম আগ্রাসন, শ্রেণিদ্বন্দ্বের নিষ্ঠুর চিত্র, কৃষিজীবীর শ্রমজীবীতে রূপান্তর, শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক পরিণতি, মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ ও বিবেক বর্জিত আপোয়—ইত্যাদি নানা চিত্র ‘ফসিল’ গল্পে অতি সু কৌশলে অঙ্কিত করে লেখক গল্পটিকে স্থাপন করেছেন বৃহত্তর ইতিহাসের পটে। ফলত শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে মানুষের যে পরাভব এ গল্পে খণ্ডচিত্র রূপে । আভাসিত ছিল তা অন্তহীন চিরন্তনতায় ব্যাপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের সমাজ বদলে গেলেও শাসকের শোষণের যে কোনও সমাপ্তি নেই—এই নির্মম সত্যটি গল্পের অস্তিমে পরিস্ফুট হয়েছে। মানুষের সভ্যতার নিরক্ত অর্থহীনতাকে প্রকট করেছে মুখার্জির ছলছল চোখ আর দুরগামী ভাবনা।
“লক্ষ বছর পর, এই পৃথিবীর কোনও এক জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টিমেলে, দেখছে কতগুলি ফসিল। অর্ধপশুগঠন, অপরিণত মস্তিষ্ক ও আত্মহত্যা প্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণির পিতৃপুরুষের শিল্পীভূত অস্থিকঙ্কাল, আর ছেনি হাতুড়ী গাঁইতা ; কতগুলি লোহার ক্রুড় কিম্ভুত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধ হয় একদিন আকস্মিক কোন ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টাস আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখছে, শুধু কতগুল সাদা সাদা ফসিল ; তাতে আজকের এই এত লাল রসের দাগ নেই।”
ফসিল শব্দটিকে গল্পকার সুবোধ ঘোষ গল্পের নামকরণ প্রসঙ্গে সুগভীর ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করেছেন। ফসিল গল্পের অন্যতম চরিত্র মুখার্জির ভাবনার মধ্যে দিয়ে গল্পের পাঠকও লক্ষ লক্ষ বছর পেরিয়ে গিয়ে যখন গল্পের অন্তিমের ঘটনাটিকে অনুভব করতে চেষ্টা করছেন, তখন এই শ্রেণিদ্বন্দ্ব, সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী পটভূমিকা হারিয়ে যাচ্ছে।” ১৪নং পীটের যে লোকগুলি মাইনিং সিন্ডিকেটের, অবিমৃষ্যকারিতায় চাপা পড়ল বা সামন্ততন্ত্রের স্টিম রোলার যে সব হতভাগ্য কুৰ্মী প্রজাদের ধরাশায়ী করল, উভয়েরই স্থান হল খনিগর্ভে কালের ব্যবধানে, লক্ষ লক্ষ বছর পরে এরা ফসিল হয়ে যাবে। লক্ষ বছর পরের প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই ফসিল তুলে নিয়ে যাবে মিউজিয়ামে। ফসিলায়িত দেহগুলি ঘিরে শুরু হবে গবেষণা। কেউ বা আবিষ্কার করবে এদের আত্মহত্যা প্রবণ মানসিকতা, কেউ বা নির্ধারণ করবেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ। সেদিনের মানব শরীরের গঠন সৌকর্য অনেকখানিই বদলে যাবে। সেদিনের চোখে বর্তমানে মানব অবয়ব অর্ধপশুর সমগোত্রীয় বলে মনে হবে। কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক হয়তো স্থির করবেন অর্ধপশুদেহ এই সব সাব হিউম্যানরা হয়তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর তারই স্মারক স্বরূপ গাঁইতি, কোদাল, ছেনি, হাতুড়ি।”
এভাবেই গল্পকার শোষিত মানুষের সম্ভবনাহীন অসহায়তাকে প্রকট করে তুলেছেন। গল্পের নামকরণটিও তাৎপর্যলগ্ন হয়ে উঠেছে। “ছোটোগল্প বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করায় ক্ষণকালের ছবিতে ফুটিয়ে তোলে চিরকালের বাণী। ফসিল গল্পটির নামকরণ পরিণতি—সবকিছুই তো এই সত্যকে দ্যোতিত করে। এক বিশেষ কালের শ্রেণিদ্বন্দ্বের চিত্র থেকে লেখক পৌঁছে যেতে চেয়েছেন মানবসভ্যতার তাৎপর্যে। অতএব, গল্পের কাহিনিরেখা যদিও একটি বিশেষ সমসীমায় আবদ্ধ—মুখার্জির ভবিষ্যৎ চিন্তা ও নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখক অনায়াসে এ গল্পে সঞ্চারিত করেছেন মানবসভ্যতার লক্ষ বছরের বিস্তৃতি ও ফসিলের নিরক্ত সাদা রঙের গভীরে নিহিত রক্তাক্ত তাৎপর্য।”
Leave a comment