সুকান্তের কালজয়ী কবিতা ‘বোধন’। সেখানে কবি পৌঁছে গেছেন ভাবীকালে—যেখানে বহু বছর পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক কতকগুলি ফসিল দেখে ভাবছে—’তেরশ সালের মালিক মজুতদার মানুষ ছিল কী? জবাব মেলে না তার।” জবাব দিয়েছেন সুবোধ ঘোষ—অন্য ভঙ্গিতে, অনন্য ইঙ্গিতে। এই ফসিল ও না-মানুষের অথবা Sub-human-এর। আশ্বর্য তথ্যেও সংকেতে, বাণীর বয়নে ও চয়নে, পরিবেশ রচনায়, সংঘাত—অভিঘাতে—’ফসিল হয়ে উঠেছে দূরদর্শী।

গল্পের রাজা, বণিক আর কুর্ম্মি শ্রমিক—তিনটি শ্রেণি যেমন প্রাণিত হয়েছে অমিত নৈপুণ্যে, তেমনি এর গল্পটিও হয়েছে প্রাণকাড়া। ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি” অঞ্জনগড়ের রাজা শুধু তাই-ই নয় লাঠির জোরে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। এল বণিক—তাদের মানদণ্ড দেখা দিতে চাইল রাজদণ্ড রূপে। মাঝে রইল শ্রমিক—কুৰ্ম্মি আদিবাসীরা। আগে ছিল জমিদার দলিত, এখন শোষিত। তারা এখন বণিকদের কূটকৌশলের শিকার। মাহাতো দুলাল, গিবসনের দাবার ঘুটিমাত্র। প্রথমে রাজা-বণিক সংঘর্ষে ওঠে বিষ। তারপর পরস্পরের স্বার্থে তার স্বার্থত্যাগ করে। আসলে তার অত্যাচার-শোষণে মুদ্রার এ পিঠও পিঠ। কাজে এক, প্রয়োগ আলাদা। তাই কুর্ম্মিদের হত্যার দায় ঝেড়ে ফেলতে হাত মেলায় তারা। মাঝখানে থাকে মি. মুখার্জীর মতো একমাত্র দরিদ্র-দরদী বিবেকমনা মানুষটি। একমাত্র এই মুখার্জী লক্ষ বছর পরের যাদুঘরে দেখেছিল “ফসিল”।–“আর্দ্র পশু গঠন, অপরিণত মস্তিষ্ক ও আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের সাবহিউম্যান শ্রেণির পিতৃপুরুষের শিলীভূত অস্থিকঙ্কাল। আর ছেনি হাতুড়ির গাঁইতা—কতগুলি লোহার কিম্ভুত অস্ত্রশস্ত্র।……..তারা দেখছে কতকগুলি সাদা সাদা ফসিল, তবে আজকের এই এত লাল রক্তের কোনো দাগ নেই।” বণিকযুগের হাতে বেমানান প্রস্তরযুগের কুর্ম্মিদের পতন ঘটল, ঘটল কেননা দুলাল মাহাতোরা অস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহ করতে জানে না, তাদের শিক্ষা নেই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেবার। আধুনিক সভ্যতার মারপ্যাচ আর রাজনীতির কাছে এই সাবেক কালের পুরাতন সভ্যতার বুদ্ধিহীন মানুষরা অচল। পশুর মতো তারা অন্যের দাসত্বে অভ্যস্থ, সহজে তাদের লোক ঠকায়। তা মাহাতো যতই আউড়াক “এবার আর কাউকে বিশ্বাস নয়” এবং “পেট আর ইজ্জত এর ওপর যে ছুরি চালাতে আসবে, তাকে আর কোনো মতেই ক্ষমা নয়”, আসলে সেও পুতুল মাত্র, বণিকের দ্বারা পরিচালিত। কাজেই, শত চেষ্টাতেও বামন চাঁদ ধরতে পারেনি মাহাতো tragedy কে দ্রুততর করেছে। তাই সর্বপ্রথম ‘ফসিল’ হয়েছে সে। তাই নামকরণ সম্পর্কে ভূদেব চৌধুরী বলেন—“দেশী মহারাজা বিদেশি ব্যবসায়ীর জান্তব ষড়যন্ত্রে নিছক দুলাল মাহাত্যের মৃতদেহ নিক্ষিপ্ত খানিগহ্বর আরও অনেক দুর্ঘটনা-দুর্গত শ্রমিক স্বজনদের দলিত দেহস্তূপের মাঝখানে—ফসিল হবার অপেক্ষায়। সাহসী কল্পনায়, রূঢ় প্রত্যক্ষ বর্ণনায়, পাড় দিয়ে সংকেতগর্ভ বর্ণ বিন্যাসের এই অনন্য কুশলতা শিল্পীর প্রবণতা ও প্রতীতির মূল হতে উঠে এসেছিল।” (বাংলা সাহিত্যের ইতিকথার চতুর্থ পর্যায়)

সুবোধ ঘোষের অন্য অনেক গল্পের মতো এখানেও শেষভাগ যেন কেন্দ্রশক্তি থেকে দূরে সরে গেছে। ‘মূল বিষয়ের সহিত ভূগর্ভ-সমাহিত মৃতদেহগুলির ফসিলে পরিণতির যোগসূত্র অতি সামান্য” (১) গল্পের শেষে লেখক সারা গল্পের “extreme reality থেকে সরে যেন দার্শনিক হতে চেয়েছেন। বাস্তব থেকে দর্শনের এই অভিসারে গল্পের শিল্পমূল্য নষ্টই হয়নি, নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে (২) কুর্ম্মির মতো আদিম সমাজের প্রতি নির্মমতা গল্পের এ হেন নামকরণের মর্মান্তিক হয়েছে। সহানুভূতি নয়, নিমর্মতাই প্রাধান্য পেয়েছে। (৩) সর্বোপরি, সারা গল্পে বণিক-রাজার দ্বন্দ্ব আর হাত মেলানো—মাঝখান থেকে হঠাৎ গণতন্ত্রের অবতার হতে চাওয়া কুর্ম্মিদের হত্যালীলা—পরিবেশকে টানটান উত্তেজনায় ভরিয়ে তোলে। শেষে হঠাৎ লক্ষ ছর পরে পৌঁছে কুর্ম্মিদের Sub-human হিসাবে প্রদর্শন—এতে ‘literary justice তো বটেই, যোগসূত্রও নষ্ট হয়েছে। শুধু কুর্ম্মিরাই ফাঁদে পড়ায় ফসিল হয়, রাজা এবং বণিকরা বেকসুর খালাস পেল কেন ? তাদের সম্পর্কে লেখক একেবারে নীরব হলেন কেন? ‘ফসিল’ তাই সবার জন্য নয়।

সমকালে থেকে সামনের কালের দিশা দেখানকেই বলি সাহিত্য। দূরকে দেখার শক্তি ছিল সুবোধ ঘোষের। তাই—Subhuman-রা সর্বদাই পরাজিত হয়। জীবনের কুরুক্ষেত্রে এই বাস্তবসত্যের সাহসী স্বীকারে নামকরণটি সার্থক।