অথবা, প্লেটোর সাম্যবাদ বলতে কী বুঝ?
ভূমিকাঃ প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে আলােচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে শাসক শ্রেণীর সাম্যবাদ। শাসকের দায়িত্ব পালনকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে প্লেটো অভিভাবক তথা শাসক ও সৈন্যবাহিনীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত পরিবার প্রথা বিলােপের প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাবই ‘প্লেটোর সাম্যবাদ’ নামে অভিহিত হয়েছে। অধ্যাপক স্যাবাইন বলেন, ‘‘দি রিপাবলিক গ্রন্থের ন্যায়বিচার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্লেটোর রাষ্ট্রীয় মতবাদ চূড়ান্ত বা সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়েছে।”
সাম্যবাদের ধারণাঃ নিম্নে উভয় প্রকার সাম্যবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-
(১) সম্পত্তির সাম্যবাদঃ প্লেটো তার সাম্যবাদ ব্যবস্থায় অভিভাবক শ্রেণীর জীবন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করার কথা ঘােষণা করেছেন। তার মতে শাসক ও দার্শনিকদের সহায়-সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, কল কারখানা ইত্যাদি নিজস্ব কোনাে জিনিস থাকবে না। রাষ্ট্রের অভিভাবকদের কোনাে ব্যক্তিগত গৃহ কিংবা জমি কিংবা অপর কোনাে সম্পত্তি থাকবে না। অপর নাগরিকের নিকট থেকে প্রাপ্ত খাদ্যই তাদের মাহিনা হবে।
(২) পারিবারিক সাম্যবাদঃ অভিভাবক শ্রেণীকে স্থায়ী আবাসন, স্ত্রী, পুত্র, পরিজনকে বর্জন করতে হবে। পারিবারিক জীবনে তাদের কোনাে অধিকার থাকে না। কারণ স্থায়ী পরিবার ব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা বিরাট অন্তরায়। এর ফলে অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে এটি আমার- ওটি তােমার প্রভৃতি বিভেদমূলক ব্যবহার সৃষ্টি হবে।
প্লেটোর সাম্যবাদের সমালােচনাঃ মহান দার্শনিক প্লেটো প্রবর্তিত সাম্যবাদ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এটিকে সমালােচনা করেছেন। নিম্নে সেসব সমালোচনা তুলে ধরা হলো-
(১) ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থীঃ প্লেটোর সাম্যবাদে অভিভাবক শ্রেণীকে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বযুগে, সর্বকালে, সবদেশে মানুষের বাঁচার জন্য এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য ন্যূনতম ব্যক্তিগত সম্পত্তি আবশ্যক।
(২) গণতন্ত্রের পরিপন্থীঃ প্লেটোর সাম্যবাদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এখানে তিনি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যৌন মিলন প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র অভিভাবক শ্রেণীর নর-নারীর অংশগ্রহণে কথা বলেছেন। কিন্তু সৈনিক ও উৎপাদক শ্রেণীকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রেখেছেন, কাজেই এটি অগণতান্ত্রিক।
(৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সমন্বয়হীনতাঃ প্লেটো অভিভাবক শ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং উৎপাদক শ্রেণীর হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(৪) রাষ্ট্রতত্ত্বের বিনাশসাধনঃ এরিস্টটল প্লেটোর সাম্যবাদের কঠোর সমালােচনা করে বলেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা ও দখল সমগ্র ভালােবাসার ভিত্তি। রাষ্ট্রে অতিরিক্ত ঐক্যসাধন করতে গিয়ে তিনি শুধু পরিবারই বিনষ্ট করেননি, বরং রাষ্ট্রতত্ত্বও নষ্ট করেছেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্লেটোর সাম্যবাদ তার দার্শনিক চিন্তার অন্যতম দিক। কিন্তু তার এই চিন্তা আধুনিককালে অবাস্তব ও অসম্ভব।
Leave a comment