অথবা, প্লেটোকে সর্বাত্মকবাদের প্রবক্তা বলার কারন বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি সাধনে যে সব চিন্তানায়কের অবদান চিরভাস্বর তাদের মধ্যে গ্রীক চিন্তাবিদ প্লেটো ছিলেন অন্যতম। তিনি এমন এক মহাপুরুষ ছিলেন যার চিন্তাধারা সর্বকালের সর্বযুগের সম্পদ। এই গ্রীক মহাপন্ডিত খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৮ সালে এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৬ সালে তিনি তার বিখ্যাত দর্শনপীঠ একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে অধ্যাপনার সময় তিনি ৩৬টি দর্শনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলাের মধ্যে ‘দি রিপাবলিক’ একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। আর এ গ্রন্থে তিনি সর্বাত্মকবাদের নীল নকশা এঁকেছেন।
রিপাবলিক গ্রন্থের মূলবক্তব্যঃ প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থ তার দার্শনিক প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। কেউ কেউ মনে করেন তিনি তার এই গ্রন্থে সর্বাত্মকবাদের নীল নকশা এঁকেছেন। সর্বাত্মকবাদ আলােচনার পূর্বে রিপাবলিক গ্রন্থের মূলবক্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা আবশ্যক। এই গ্রন্থটি বিশেষ কোনাে নীতি বা তত্ত্বের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলােচনা নয় বরং এটি শিক্ষা, শিল্প, দর্শন, রাষ্ট্রতত্ত্ব, সমাজনীতি প্রভৃতি সকল দিকের জ্ঞান ভান্ডারে পরিপূর্ণ প্রামাণ্য বিশ্লেষণ। এই গ্রন্থের মূল বক্তব্যকে চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে সজ্জিত করা হয়েছে। এগুলাে হলাে (১) আদর্শ রাষ্ট্র (২) ন্যায় নীতি (৩) সাম্যবাদ এবং (৪) শিক্ষাব্যবস্থা।
সর্বাত্মকবাদঃ সর্বাত্মকবাদ হলাে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে মানুষের জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয়, কৃষ্টিগত, শিল্প-বাণিজ্য, আত্মিক ও বৈষয়িক সবকিছুই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সর্বাত্মকবাদ বলতে বুঝায় এমন এক শাসনব্যবস্থা-
(১) যেখানে আইনের ভূমিকা নেই অর্থাৎ আইনের শাসন নেই।
(২) শাসকগণ তার কর্ম-অপকর্মের জন্য কারাে নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
(৩) সর্বাত্মকবাদে সমস্ত শাসনক্ষমতা এক বা একাধিক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে, যেখানে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
(৪) শাসন পরিচালনায় যেখানে জনগণের কোনাে প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
মােটকথা সর্বাত্মকবাদ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের এক বিশেষ রূপ-“কিছুই রাষ্ট্রের উর্ধ্বে নয়, বাইরেও নয়, বরং সবকিছুই রাষ্ট্রের জন্য।”
প্লটোকে সর্বাত্মবাদের প্রবক্তা বলার কারনঃ নিম্নে প্লটোকে সর্বাত্মকবাদের প্রবক্তা বলার কারন তুলে ধরা হলােঃ
(১) ব্যক্তিত্বকে অস্বীকারঃ প্লেটো তার সর্বাত্মকবাদের ব্যাখ্যায় ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন। সমালােচকদের মতে ব্যক্তি নয় রাষ্ট্রই চূড়ান্ত লক্ষ্য-এ নীতিকে তিনি সমর্থন করেছেন। ফলে ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।
(২) অভিভাবক শ্রেণীর প্রাধান্যঃ প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সর্বাত্মকবাদের আশ্রয় নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি অভিভাবক শ্রেণীকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে। তার মতে তাদের বিরুদ্ধে কোননারকম অভিযােগ করা যাবে না।
(৩) অগণতান্ত্রিকঃ প্লেটোর সর্বাত্মকবাদের ব্যাখ্যায় অগণতান্ত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সমালােচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্লেটো তা এড়িয়ে গেছেন।
(৪) অধিকারকে অস্বীকারঃ প্লেটো তার সর্বাত্মকবাদ ব্যাখ্যায় মানুষের প্রকৃতিগত অধিকারকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলােপের কথা বলে মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারকে অস্বীকার করেছেন। অথচ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যক্তিত্ব ও সহজাত প্রবৃত্তির বিকাশে সহায়ক।
(৫) ব্যক্তি রাষ্ট্রের দাস নয়ঃ বর্তমানকালে সর্বাত্মকবাদে ব্যক্তিকে যেভাবে রাষ্ট্রের দাসে পরিণত করা হয়, প্লেটোর রিপাবলিকে তা করা হয়নি। প্লেটোর রিপাবলিকে কোনাে সময়ই ব্যক্তি উপলক্ষ্যে পরিণত হয় না। কিন্তু ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না।
পরিশেষঃ উল্লেখিত সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও বলা চলে প্লেটো সর্বাত্মকবারেই নামান্তর ছিলেন। তার আলােচনায় সর্বাত্মকবাদের প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বলা চলে যে, মূলত প্লেটোর এ ধরনের কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তিনি তৎকালীন গ্রীসের রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এ মতবাদকে সমর্থন করেছেন।
Leave a comment