প্রেষণা একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক শক্তি। এটি শিখনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে-কোনাে শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে প্রেষণার উপর। প্রেষণা হল যে-কোনাে অন্তর্নিহিত উপাদান বা শর্ত যার প্রবণতা হল কর্মদক্ষতার সূচনা করা এবং তা দীর্ঘস্থায়ী করা। ক্রো বলেন, প্রেষণা হল এমন এক শক্তি যা শিখনের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তােলে এবং এই কারণে প্রেষণাকে শিখনের মূল শক্তি বলা হয়।

(১) চাহিদানির্ভর প্রক্রিয়া : বিশেষ চাহিদাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ বস্তুর চাহিদা বা অভাববােধ হল প্রেষণা সৃষ্টির মূল উৎস।

(২) আচরণের গতিপথ নির্ধারক : প্রেষণা আচরণের গতিপথ নির্দেশ করে। প্রেষণা আচরণের জন্য শক্তি, সামর্থ্য, দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে যা শিখনের জন্য একান্তভাবে প্রয়ােজনীয়।

(৩) অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়া : প্রেষণা হল একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়া। দেহের অভ্যন্তরীণ কারণে প্রেষণা সৃষ্টি হয়, যার ফলে ব্যক্তির আচরণের উদ্দেশ্যমুখী পরিবর্তন ঘটে।

(৪) লক্ষ্যমুখী প্রক্রিয়া : প্রেষণাকে আশ্রয় করে শিক্ষার্থী তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছােতে সমর্থ হয়। অর্থাৎ প্রেষণার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল লক্ষ্যবস্তু প্রাপ্তি। প্রত্যেক প্রেষণা শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য সম্পর্কে সজাগ করে।

(৫) ধারাবাহিক প্রক্রিয়া : প্রেষণা একটি ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ এটি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। ব্যক্তির একটি প্রেষণা পূরণ হলে পরমুহূর্তে অপর একটি প্রেষণার সৃষ্টি হয়।

(৬) ভারসাম্য রক্ষা : প্রেষণা ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিজীবনে যে দৈহিক বা মানসিক পরিবর্তন ঘটে, চাহিদা পরিতৃপ্তির মাধ্যমে, তার ভারসাম্য ফিরে আসে। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনের অস্থিরতা দূর করার জন্য প্রেষণার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

(৭) নির্বাচনধর্মী প্রক্রিয়া : প্রেষণা একটি নির্বাচনধর্মী মানসিক প্রক্রিয়া। নির্দিষ্ট বস্তুকে কেন্দ্র করে প্রেষণা জাগ্রত হয়। যেমন- গৃহহীন ব্যক্তি আশ্রয়ের অন্বেষণ করে।

(৮) মানসিক শক্তির সমন্বিত রূপ : প্রেষণার সঙ্গে কতকগুলি মানসিক শক্তি যুক্ত থাকে, সেগুলি হল— চাহিদা, তাড়না, আগ্রহ, পুরস্কার ইত্যাদি।

(৯) কর্মের মাননান্নয়ন : প্রেষণা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীকে কর্মে নিয়ােজিত করে না, কর্মের মানােন্নয়ন ঘটায়।

(১০)আগ্রহবর্ধক : সবশেষে বলা যায়, প্রেষণা শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আগ্রহ সৃষ্টি করতে এবং আগ্রহ বজায় রাখতে সাহায্য করে।


প্রেষণার প্রকারভেদ

(১) জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় প্রেষণা: ব্যক্তির জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় চাহিদাকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় প্রেষণার সৃষ্টি হয়, তাকে জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় প্রেষণা বলে। জল, আলাে, বাতাস, খাদ্য, মাতৃত্ব, যৌনতা ইত্যাদি জৈবিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে এই জাতীয় প্রেষণা জাগ্রত হয়। বাঁচার তাগিদে এই প্রেষণার পরিতৃপ্তির দরকার। জৈবিক প্রেষণার পরিতৃপ্তি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় রাখে, দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখে।

(২) ব্যক্তিগত প্রেষণা: ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে কেন্দ্র করে যে ধরনের প্রেষণা কার্যকরী হয় তাকে ব্যক্তিগত প্রেষণা বলে। অর্থাৎ ব্যক্তির আত্মসচেতনাতার সঙ্গে যুক্ত প্রেষণাগুলিকে ব্যক্তিগত প্রেষণা বলে। মানুষের আত্মসচেতনতাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় মানসিক চাহিদা (Psychological need) এবং এই চাহিদাগুলাের সঙ্গে যুক্ত প্রেষণা হল ব্যক্তিগত প্রেষণা।

মনােবিদ ম্যাসলাে (Maslow)-র মতে, মানসিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির মধ্যে আত্মশ্রদ্ধার প্রেষণার (Need for Self-esteem) উন্মেষ ঘটে। এই প্রেষণা ব্যক্তিকে তার আত্মমর্যাদা রক্ষার অনুকুলে আচরণ করতে উদ্যত করে।

উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিগত প্রেষণা যা সকলের মধ্যে দেখা যায় সেগুলি হল— আগ্রহ, মনােভাব, মূল্যবােধ, আত্মসচেতনতা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। শিশুদের আত্মসচেতনতা ব্যক্তিগত প্রেষণা জাগ্রত করে। বাবা, মা এবং অন্যান্য গুরুজন ব্যক্তিদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার বিস্তৃতি ঘটে। তার ফলে প্রেষণা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রভাবিত হয়।

(৩) সামাজিক প্রেষণা: ব্যাক্তিদের সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সুস্থ সামাজিক জীবনযাপনের জন্য নিরাপত্তা, ভালােবাসা, আত্মপ্রতিষ্ঠা, খ্যাতির স্পৃহা প্রভৃতি সামাজিক চাহিদাগুলিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে ধরনের প্রেষণা কার্যকরী হয়, তাকে সামাজিক প্রেষণা বলে। সামাজিক প্রেষণা সামাজিক পরিবেশে অর্জিত হয় এবং ব্যক্তির সামাজিক বিকাশে সাহায্য করে। অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার প্রভাবে সামাজিক প্রেষণা বিকশিত হয়। শিশুর জীবনে এইসকল সামাজিক প্রেষণা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এইসকল সামাজিক প্রেষণা সামাজিক পরিণমনের সূচক।


উপরে আলােচিত এই তিন ধরনের প্রেষণা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যে-কোনাে পরিস্থিতিতে এই তিন ধরনের চাহিদা একসঙ্গে কাজ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এইসকল প্রেষণার গুরুত্ব আমাদের মনে রেখে উন্নয়ন ঘটাতে হবে।