‘মহানগর’ গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গভীর দার্শনিক উপলব্ধি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে, আলোচনা করো।

প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত শ্রেষ্ঠ গল্পসম্ভারের মধ্যে অন্যতম হল ‘মহানগর’। নাগরিক জীবনের জটিলতা, হৃদয়হীনতা অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্য সাহিত্যেও বারংবার ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথমা’র ‘নগর-প্রার্থনা’ কবিতায় ‘লৌহ-কাষ্ঠ’, লোভ আর চক্রান্তে কলুষিত ‘পতিতা’-রূপী মহানগরকে কালিমামুক্ত করার জন্য তিনি ‘সৌম্যশুচি কুমার সন্ন্যাসী’-কে আহ্বান করেছিলেন। ‘এই শহরে’ কবিতায় কবি আক্ষেপ করেছিলেন—’যাদের তুমি চিনতে, তারাও/হারিয়ে যাবে/এই শহরে’। আলোচ্য ‘মহানগর’ গল্পেও আছে এই হারিয়ে যাওয়ার কথা। এ-গল্পের বিষয়বস্তু রতন নামে এক বালকের মহানগরে হারিয়ে-যাওয়া দিদিকে খুঁজে বের করবার কাহিনি। বালকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেখানো হলেও ‘মহানগর’ আসলে নাগরিক জীবনের জটিলতার গল্প। উপরন্তু মহানগর বিষয়ে অভিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবন-সম্পর্কিত গভীর দার্শনিকতা অভিব্যক্ত হয়েছে এ-গল্পে।

আলোচ্য গল্পের মূল অবলম্বন এক বালকের বিষাদকরুণ জীবন-অভিজ্ঞতা। এই বালক তার দিদিকে হারিয়েছে, গ্রামের এই সরল প্রাণবস্তু নারীকে অবস্থা বিপাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে কলকাতার কানাগলিতে এই উপলব্ধিটি ধীরে ধীরে অর্জন করবে রতন নামের বালকটি। কিন্তু বালকের পক্ষে এই গভীর দার্শনিক উপলব্ধিকে প্রথমেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে লেখক স্বয়ং এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একটা কাব্যিক বিবরণের সহায়তায় তিনি ধীরে ধীরে বিষণ্ণ পরিস্থিতি রচনা করে পাঠকের মনকে প্রস্তুত করেছেন। গল্পের সূচনায় তিনি মহানগরের পরিচয়-দান করতে গিয়ে অনবদ্য উপমার ব্যবহার করেছেন—’যে মহানগর ছড়িয়ে আছে আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো, আবার যে-মহানগর উঠেছে মিনারে মন্দিরচূড়ায়, আর অভ্রভেদী প্রাসাদ-শিখরে তারাদের দিকে প্রার্থনার মতো মানবাত্মার”। লেখক মহানগরের পথে তাঁর সঙ্গে পাঠককে আসতে বলে সেই পথের বর্ণনার ক্ষেত্রে পুনরায় আশ্রয় নিয়েছেন কাব্যিক উপমার—’যে-পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, যে-পথ অন্ধকার, মানুষের মনের অরণ্যের মতো, আর যে-পথ প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল, মানুষের বুদ্ধি, মানুষের উৎসাহের মতো’। এই উপমাশ্রয়ী বর্ণনা দেওয়ার পরেই লেখক মন্তব্য করেছেন—’এ-মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত—ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত।’ কাব্যিক উপমামণ্ডিত বাক্যগঠনের পরে সঙ্গীতের প্রসঙ্গ উত্থাপন গল্পের এই অংশে লিরিক কবিতার আমেজ এনে দিয়েছে। গল্পাংশটি নিজেই যেন একটি স্বতন্ত্র লিরিক কবিতা হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে মহানগর সম্বন্ধে লেখকের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।

মহানগরকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে আলোচ্য গল্পে লেখকের কবিসত্তা উপলব্ধি করেছে যে, কঠিন ধাতু ও ইটের ফ্রেমে লক্ষজীবনের সুতো নিয়ে মহানগর বিশাল সূচিচিত্র নির্মাণ করে চলেছে। সেই চিত্রে কখনো কখনো সুতোর সঙ্গে সুতো জড়িয়ে যাচ্ছে, সেই যাচ্ছে হারিয়ে। লেখকের মনে হয়েছে, মহানগর যেন এক মহাকাব্য, তার কাহিনী সমুদ্রের অসংখ্য ঢেউ। তিনি সেই সমুদ্রের দু-একটি ঢেউ-এর গল্প বলতে পারেন। মহানগর কলকাতার এই কাব্যিক পরিচয় দেওয়ার পরেই লেখক এ গল্পের নায়ক বালক রতনকে স্থাপন করেছেন মহানগরের পটভূমিতে। জোয়ারের টানে ভেসে চলা নৌকোর হাল ধরে ভোর রাতে মুকুন্দ বসেছিল, রতন একসময় তার বাবার কাছে গিয়ে বনল। বাদলা রাতে আকাশে তারা ছিল না। নদী তখন মহানগরের নাগাল পেয়েছে। দুধারে জাহাজ আর স্টিমার, গাধাবোট আর বড়-বড় কারখানার সব জেটি। রতন অন্ধকারে তাদের স্পষ্ট করে দেখতে পায় না, কালো জলের এপার থেকে ওপারে তাদের গায়ে কেবল সে অসংখ্য আলোর ফোঁটা দেখতে পায়। তার কল্পনাপ্রবণ শিশুমনে ধারণা হয় মেঘলা আকাশ ছেড়ে তারাগুলিই তো নেমেছে নদীর ওপর’। রতনের এই আশ্চর্য কল্পনা আসলে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের রোম্যান্টিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।

মহানগরে নতুন দিন জেগে ওঠার সূচনালগ্নে স্বপ্নমুগ্ধ রতন নৌকোর ছইয়ের ভেতরে থাকতে পারেনি। গল্পের এই স্থানে লেখক কাব্যিক ভঙ্গিতে বলছেন যে, রতন সেই মুহূর্তে দু-চোখ দিয়ে পান করেছে আলো-ছেটানো এই নগরের অন্ধকার। এখানে রতন কর্তৃক নগরের অন্ধকার পান করার প্রসঙ্গটি গল্পের করুণ পরিণতির দিকে যেন অঙ্গুলি সংকেত করে। এই ছোট্ট বাক্যাংশটি লেখকের কাব্যধর্মী ব্যঞ্জনার এক চমৎকার উদাহরণ। গল্প রচনা করতে করতে এই স্থানে এসে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র পুনরায় যেন রতনের বর্ণনা প্রসঙ্গে সংহত হীরকখণ্ডের মতো স্বতন্ত্র একখানি লিরিক কবিতা সৃষ্টি করলেন যা এই গদ্য রচনাকে অসামান্য রসোজ্জ্বল করে তুলল।

নৌকোয় বসে থাকা রতনের চোখের সামনে অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এল, তখন মহানগরের নদীর বুকে ভোর হওয়ার বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ কাব্যিক মূর্ছনায় অভিব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, সম্পূর্ণ ভোর হওয়ার আগে প্রকৃতির পটের ওপরে যেন হালকা অথবা ঘন রঙের এলোমেলো ছোপ লাগানো ছিল, যা তখনও নির্দিষ্ট রূপ নেয়নি। নীহারিকার মতো আকারহীন সেই অস্পষ্ট ধোঁয়াটে তরলতা থেকে রতনের চোখের ওপরেই কে যেন সবেমাত্র নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে তুলেছে। আকাশের গায়ে কালো খানিকটা তুলির পোঁচ দেখতে দেখতে প্রকাণ্ড একটা জাহাজ হয়ে উঠল, তার জটিল মাস্তুলগুলি ছোটখাটো অরণ্যের মতো মেঘলা আকাশে উঠেছে, তার নোঙরের শিকল জলের ভেতর নেমেছে বিশাল অজগরের মতো। রতনদের নৌকো সেই দানবের ভ্রুকুটির তলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে ছোট শোলার খেলনার মতো পার হয়ে যায়। একটি জেটির চারধারে ভিড় করে থাকা গাধা-বোটের জটলাকে দূর থেকে দেখে মনে হয়, ওগুলো যেন কোনো বিশাল জলচরের শাবক—মায়ের কোল ঘেঁষে তাল পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কল-কারখানার বিশাল সব দেহ নদীর দু-পারে জেগে উঠল। জলের ওপর তারা তাদের লোহার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঁধানো পাড় থেকে বড় বড় ক্রেন উঠেছে গলা বাড়িয়ে। ভয়ে-বিস্ময়ে ব্যাকুলতায় অভিভূত হয়ে রতন তার জীবনে প্রথম মহানগরের এই রূপ দেখল।

রতনদের নৌকো পোনাঘাটে এসে পৌঁছনোর পর তার বাবার কথামতো রতন কদমগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। গল্পের এই স্থানে এসে দার্শনিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিসত্তা জন্ম দেয় একটা সংক্ষিপ্ত প্রতীকী বিবরণের—’কদমগাছ থেকে অসংখ্য ফোটা ফুল ঝরে পড়েছে মাটিতে। কাদায় মানুষের পায়ের চাপে রেণুগুলো থেঁতলে নোংরা হয়ে গেছে। পোনা-চারার হাটে কদমফুলের কদর নেই।’ আপাতভাবে দেখলে উদ্ধৃত বাক্য ক’টিকে সাধারণ বর্ণনা বলে মনে হয়। কিন্তু গল্পের সামগ্রিক পাঠে রতনের দিদি চপলার জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির সঙ্গে এটিকে মিলিয়ে দেখলে এর ব্যঞ্ছিত অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহানগরের বিকিকিনির হাটে হস্তান্তরিত হয়েছিল ফুলের মতন এক গ্রাম্যবধূ। হৃদয়হীন মানুষের পাশবিক পীড়নে সেই সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক গ্রাম্যবধূ চপলার জীবন পদপিষ্ট কদমের রেণুর মতন থেঁতলে নোংরা হয়ে গেছে। এভাবে আলোচ্য গল্পাংশে কদমফুলের সঙ্গে নারী চরিত্রের তুলনা লিরিক কবিতার আস্বাদ বহন করে আনে। এরপর বালক রতনের শহরে তার দিদির উল্টোডিঙি নামক স্থানে থাকবার কথা শুনতে পাওয়ার প্রসঙ্গে লেখক মন্তব্য করেন—’বাতাসে কথা ভেসে আসে, বিনিদ্র ভালোবাসা কান পেতে থাকে, শুনতে পায়। শিশুমনের নির্মল ভালোবাসাকে এভাবে মানবায়িত করে প্রকাশের মধ্য দিয়ে জীবন-সম্বন্ধে গভীর দার্শনিক বোধসম্পন্ন প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসামান্য সংবেদী কবিমনের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়।

মহানগরের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে আবদ্ধ দিদি চপলাকে বড় হয়ে সেই স্থান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ রতন যখন সবল ভঙ্গিতে গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন লেখক আলোচ্য গল্পের উপসংহার টানেন কাব্যিক উপমাযুক্ত বাক্য দিয়ে—‘মহানগরের ওপর সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতির মতো গাঢ়। চপলার করুণ পরিণতি এবং রতনের বিদায় যখন পাঠকহৃদয়কে দীর্ঘশ্বাসে ভারী করে তোলে, তখন তার সেই বিষণ্ণ চেতনার ওপরেও যেন গাঢ় সন্ধ্যা নেমে আসে। এভাবে ‘মহানগর’ গল্পের নানান স্থানে কাব্যিক বিবরণ-প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মহানগর তথা মানবজীবন-সম্পর্কে গভীর দার্শনিক চিন্তার নিদর্শন আমরা পাই। আপন কবিসত্তাকে অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যের সঙ্গে সমন্বিত করে তিনি এই ছোটগল্পটি রচনা করেছেন এবং তাতে যে একটা লিরিক কবিতার অপূর্ব আমেজ মিশ্রিত হয়ে রয়েছে, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যায়।