কল্লোল গোষ্ঠীর প্রথম সারির গল্প লেখকদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র বুদ্ধদেব, ও অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত। তারা গল্প লিখে প্রথম প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে। যখন মানুষের নৈতিক জীবন অধঃপতনের চরম সীমা অতিক্রম করেছে, এই সময়েই প্রেমেন্দ্র মিত্র কালো বাজার, দুর্ভিক্ষ আর্থিক শোষণের পাশাপাশি গল্প লিখেছেন মানুষের ভাঙাচোরা জীবনকে অবলম্বন করে। যে জীবনে আছে বাস্তবের নির্মম, বীভৎস রূপ গল্পের চরিত্রের বিকৃত মনের জটিল আর্বত। নায়কেরা নিম্নমধ্য জীবন পরিধির পরিক্রমায় প্রায়শ মেরুদণ্ডহীন-নেতিয়ে পড়া চরিত্র। যাদের আত্মপ্রবঞ্চনা জনিত অপরাধের জন্য অনুতাপ নেই, লজ্জা নেই, হীনতা বোধ নেই।

প্রেমেন্দ্র মিত্রে বেশ কয়েকটি গল্পে মহানগর, তেলেনাপোতা আবিষ্কার জনৈক কাপুরুষের কাহিনি একশ্রেণির নায়ক আমরা পাচ্ছি যাদের সবল পুরুষত্বের দাবি রাখতে পারেনি। তাদের চরিত্রে অভাব দৃঢ়তার, আত্মপ্রত্যয়ের, পৌরুষের, তাদের আছে দ্বিধা, দুর্বলতা, দ্বন্দ্ব, কোনো বিশ্বাস বা মূল্যবোধকে দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরতে পারবে না। তার অনিবার্য ফল প্রেমে দুর্বলতা, প্রত্যয় ও আস্থার অভাব। যাকে নিজের বলে ভাবতে পারে সেই প্রণয়িণীকে প্রবল দৃঢ়তায় ছিনিয়ে নিতে পারে না, কিংবা কথা দিয়ে কথা রাখে না। স্রোতের বিরুদ্ধে যাবার সাহসও তাদের নেই। লেখক শল্য চিকিৎসকের মতো উক্ত গল্পের চরিত্রে ব্যবচ্ছেদ করেছেন নিজ শৈলীর দক্ষতায়।

‘মহানগর’ তেমনই একটি গল্প যেখানে অমানবিকতা, জটিলতা ও তিত্তিতার পরিচয় আছে। একটি বালকের স্বপ্ন পূরণের উদ্ভাসিত চোখে ধরা দিয়েছে মহানাগরিক জীবনের পঙ্কিলতা। মহানগরের পথ অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মতো, আবার প্রশস্ত আলোকজ্জ্বল, ‘মানুষের অদম্য উৎসাহের মতো।

পোনাচারার নৌকায় উঠে কিশোর রতন এসেছে মহানগর উল্টোডাঙাতে তার হারানো দিদির খোঁজে। “মহানগর থেকে তার দিদিকে সে খুঁজে বার করবে, তার বিবাহিতা দিদি শ্বশুড়বাড়ি থেকে অপহৃতা তারই খোঁজে রতন এসেছে মহানগরে, শুনেছে দিদি আছে উল্টোডাঙাতে। শেষপর্যন্ত দিদিকে খুঁজে পায় ‘চপলা’ রূপে সে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু নিয়ে যেতে পারে না। কারণ একদিনের গৃহবধূ আজ বারবণিতা। সে আর ফিরিবে না। রতন ফিরে যাবার আগে চপলাকে বলে যায়—“বড়ো হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব দিদি”। মহানগরের ধূলিমাখা পথে বিষাক্ত বাষ্পের মাঝখানে সরল বালকের ব্যর্থতা এভাবেই ফুটে ওঠে।

পাশাপাশি যখন আমরা “তেলেনাপোতা আবিষ্কার” গল্পটিকে রাখি তখনই মহানগরের রতনের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগে। সন্দেহ হয় ওই সরল বালকের হৃদয়বৃত্তির মূল্য শেষপর্যন্ত অটুট থাকবে তো। ‘মহানগরী থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে তেলেনাপোতা যেখানে সহযাত্রীর বন্ধুর আত্মীয়-বাড়ি এক অট্টালিকার ভগ্নাবশেষে এসে মনে হবে—“জীবন্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে অতীতের কোনো কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতিলোকে এসে পড়েছেন, আর যেখানে উদ্ঘাটিত হবে বিষাদ মাধুর্যে পূর্ণ এক দৃশ্য। এক অন্ধ মৃত্যু পথ যাত্রিনীর বিশ্বাস : নিরঞ্জন নামে একটি ছেলে তার মেয়ে যামিনীকে বিয়ে করবে বলে আশ্বাস দিয়ে গেছে বুঝি বা সে-ই ফিরে এল। তখন মানবিকতার খাতিরে বা হঠাৎ আবেগে যামিনীর প্রতি নবজাত আকর্ষণে কলকাতার যুবক সেই বৃদ্ধাকে কথা দেয় সে যামিনীকে বিয়ে করবে তার কথার নড়চড় হবে না। তারপর কলকাতায় ফিরে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যামিনীকে ভুলে গিয়ে ভাবে তেলেনাপোতা বলে কোনো কিছু সত্যি নেই।

এই গল্পে পুরুষবেশী নিরঞ্জন যেমন বৃদ্ধাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি এই যুবকও তেমনি আর কোনো দিন ফিরবে না। যামিনীকে বিয়ে করার মানসিক উদারতা কিংবা পৌরুষ দেখাবে না। মধ্যবিত্তের চিত্ত সংঘাত আর দ্বান্দ্বিক সংকটে গল্পের এই নায়কেরা প্রায়শঃই হারিয়ে যায়। নিরঞ্জন যেমন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় যামিনীর উদ্বেগাকুল আহ্বান উপেক্ষা করে তেমনি কলকাতার। কৌতূহলী যুবকেরাও বিমুখ হয়ে যায় ক্ষণিকের আবিষ্কার নায়িকার আকর্ষণ।

‘মহানগর’ গল্পের রতন গ্রাম্য বালকসুলভ যে সারল্য নিয়ে মহানগরের রাজপথে দিদিকে অন্বেষণ করতে গেছে সেখানে তার বালকসুলভ আবেগ পরিণত বয়সের সেটা কি তার থাকবে ? তার দিদিকে ফিরিয়ে আনার কথা কি এতদিন সে জমিয়ে রাখবে ? নিরঞ্জনের মতো পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশে হারিয়ে যাবে না তো ? এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। নিরঞ্জন ক্ষণিকের আবেগের বশে কথা দিয়েছিল—কিন্তু কথা রাখার মতো দায় বা সাহস তার ছিল না।

জীবনের নানা সংকটের আবর্তকে সঠিকভাবে অনুধাবন না করে বালক রতন যে কথা তার দিদিকে দিয়েছে পূর্ণ বয়সের নৈতিক সংকট কালে হয়তো তার সে কথা মনে থাকবে না। হয়তো তার বাল্যের হৃদয়বৃত্তির মূল্যবোধহীন এক ভীরু মধ্যবিত্তের দ্বিধা মানসে পরিণত হবে। রতন হয়ে যাবে নিরঞ্জনের উত্তর পুরুষ। যারা আর্থিক নিরাপত্তা হীনতায় ক্লেদাক্ত জীবনের শরিক হয়ে মানবের মূল মহামন্ত্রধ্বনি থেকে বিচ্যুত হবে। যেমন “জনৈক কাপুরুষের কাহিনির” নায়কও কাপুরুষ। যারা লড়াই করতে অপরাগ সমস্যার সমাধানে অনিচ্ছুক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ‘বিনষ্টি এই সব রুগ্ন মনোভাব ও জটিল মানসিকতার পুরুষদের জন্মদাতা। যারা ঝুঁকির দায় এড়িয়ে নির্মোকের ভেতর নিজেদের সংগুপ্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। যারা চায় আর্থিক নিরাপত্তা যারা চায় দুর্লভ সুযোগ এবং সুযোগের পরম লগ্নে যারা দ্বিধাদীর্ণ।