ইংরেজি ‘Hymn’ (হিম), শব্দের অর্থ বাংলায় ধরা হয় প্রার্থনা সংগীত বা স্তবগাথা ‘হিম’ বলতে বোঝায় দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে রচিত স্তবগাথা, সাধারণভাবে গাওয়ার জন্যই যা লেখা হত, তবে আবৃত্তির জন্য রচিত প্রার্থনা গীতিও একেবারে পাওয়া যায় না এমন নয়। দেবদেবীর উদ্দেশ্যে রচিত হলেও মানবিক অনুভূতি এইসব গানে একেবারে তাৎপর্যহীন নয়। পুরনো প্রার্থনা সংগীতে কবিরা ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিক জগৎ সম্বন্ধে তাঁদের ব্যক্তিগত উপলব্ধি যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমন তাঁদের গানে মর্ত্যধামের পার্থিব জীবনও তুচ্ছ হয়ে যায়নি।
প্রাচীন খণ্ড কবিতা হিসাবেই স্তবগাথাগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন খ্রিঃ পূঃ ১৪০০ সালে রচিত বৈদিক স্তবগাথা। সেই দেবগানের প্রার্থনা সংগীত থেকে আজকের শ্যামাসংগীতের প্রার্থনা ‘ব্রষ্মময়ী দেখা পাগল করে’ পর্যন্ত আপাত বিচ্ছিন্ন অথচ এক সুনিশ্চিত সাদৃস্য সূত্র অবলম্বন করে এক অভিন্ন ধারার মতো প্রবাহিত হয়ে আসছে। তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মিশেছে বহু বিভিন্ন ধারা-সুরদাসের ভজন, কবীরের ভজন, তুলসীদাসের ভজন, মীরার ভজন, রামদান-তুকারামের ভজন, অন্যদিকে আছে বৈশ্বব কবিদের প্রার্থনা। শাক্ত কবিদের ‘আকৃতি’ সমস্ত ধারা মিলে একটি প্রধান আধ্যাত্মিক ধারাকেই এমন পরিপুষ্ট করেছে যে আমরা একথা আজ জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাই বাউল গানে কোনো বিশেষ ধর্মের মরমীয়া সাধনের কথা বলা হয়েছে, সুখী সাধনতত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সাধন তত্ত্ব কিনা এবং ভাটিয়ালি গানে যে সুজন বন্ধুকে সম্বোধন করা হয় তিনি কোনো ধর্মমতের দেবতা, নাকি তিনি একান্তই প্রাণের দোসর, রবীন্দ্রনাথের ‘পাথজন সখা’ বা ‘পরাষ সখা বন্ধু’র মতই জীবনের নিয়ন্ত্রা এক পরম বান্ধব।
পাশ্চাত্য সাহিত্যে গ্রিক ‘হিম’ সবচেয়ে প্রাচীন বা তার বেশিরভাগ আজ বিস্মৃতির গর্ভে সমাহিত। যা আমরা স্মরণ রেখেছি তার মধ্যে পড়তে পারে বেশ কিছু স্টোয়িক স্তোত্র। ইহুদিদের প্রার্থনা সংগীতে ঈশ্বরের মাহাত্ম্যের চেয়ে নিজেদের লাঞ্ছনা এবং তা থেকে উত্তরণের প্রায়শই বেশি দেখা যায়। ‘ওল্ড টেস্টামেন্টের’ বহু গানেই তার প্রমাণ মেলে। গ্রিক এবং হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা সংগীতের অদ্ভুত এক সমন্বয় দেখা যায়; ইংরেজি ভাষায় রচিত খ্রিস্টাব্দ হিমো। বিভিন্ন গীর্জায় যেসব প্রার্থনা সংগীত গাওয়া হত বা হয় তার স্বরলিপি সমৃদ্ধ এক সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। প্রাচ্য সাহিত্যে ওমর খৈয়াম, হাফিজ প্রভৃতির মতো পাশ্চাত্য সাহিত্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনেক প্রার্থনা সংগীত লেখা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে—অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতকেও কুপার, হেবার, পামার-এর মতো ইংরাজ ও আমেরিকান কবি প্রার্থনা সংগীত লিখেছেন।
অবশ্য ঊনবিংশ শতকেই বা প্রান্তরেখা টানা কেন, ধর্ম সংগীত হওয়া সত্ত্বেও স্তোত্র গাথার ধারা এখনও অব্যাহত বলেই সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া হবে, কারণ তা না হলে ফ্রান্সিস টমসন বা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি গীতিমাল্য পর্বে গানগুলিকে আমরা আর কোন্ শ্রেণিতেই বা বিন্যস্ত করতে পারি।
Leave a comment