প্রশ্নঃ “প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনসভা নির্বাহী বিভাগের সিলমোহরে পরিণত হয়েছে।”— উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আধুনিককালে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস এবং শাসন বিভাগের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ কী? আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে ব্যক্তির কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে। আর সরকার হলো রাষ্ট্রের রূপক। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সমষ্টিগত রূপকে সরকার বলা হয়। সরকারের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ।

আইনসভা নির্বাহী বিভাগের সিলমোহরে পরিণত হয়েছেঃ কে. সি. হুয়ারের মতে, “বর্তমান শতাব্দীতে যদি আইনসভাগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সমীক্ষণ চালানো যায়, তাহলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সকল দেশে এর ক্ষমতার অবসান ঘটেছে।” বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে সাথে শাসন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রাধান্য স্থান পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আইনসভা স্বাধীনভাবে তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং আইনসভা শাসন বিভাগের সিলমোহরে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে আইনসভাসমূহের ক্ষমতা হ্রাসের কারণ সম্পর্কে লর্ড ব্রাইস আলোচনা করেছেন। বর্তমান সময়ে আইন পরিষদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা হ্রাসের কারণ ও শাসন বিভাগের সিলমোহরে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নিম্নে আলোকপাত করা হলোঃ

১. জরুরি অবস্থা মোকাবিলাঃ আইন বিভাগে সকল সময় অধিবেশন থাকে না এবং জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য শাসন বিভাগের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে দিন দিন যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার যে জটিল আকার ধারণা করছে এগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শাসন বিভাগের ভূমিকার শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করা যায় না। ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইনঃ অর্পিত ক্ষমতা বলে আইন প্রণয়নহেতু এর ক্ষমতা হ্রাস পায়। আইনসভা রাষ্ট্রের কার্যাবলি ব্যাপক ও বিস্তৃত হওয়ায় এবং সময়ের স্বল্পতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য শুধু আইনের কাঠামো প্রণয়ন করে। কিন্তু বাস্তব রূপ দেয় শাসন বিভাগ। ফলে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস এবং শাসন বিভাগের শক্তি বৃদ্ধি পায়৷

৩. সদস্যদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতাঃ আইন প্রণয়নে সদস্যগণ যে অভিজ্ঞতা রাখেন তার চেয়েও অনেক বেশি যোগ্যতা থাকে মন্ত্রীবর্গের। জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি নির্বাচনে যেতে চায় না সে কারণে সংসদে সাধারণ ব্যক্তির সমাগম ঘটে। ফলে আইনসভার গুণগত যোগ্যতা থাকে না, থাকে না জনগণের আস্থা। স্বাভাবিকভাবেই তাই আইন বিভাগের প্রাধান্যের পরিবর্তে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতাঃ দলীয় নেতারা আইনসভায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করায় সাধারণ সদস্যদের কোন ভূমিকাই লক্ষ্য করা যায় না। তারা স্বাধীন বিবেচনামতো কাজ করার কোন সুযোগই পায় না। কাজেই শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ পায়।

৫. নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নঃ মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগই নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করে। এ কারণে জনগণ আইনসভার পরিবর্তে নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের উপর অধিক আস্থাশীল হয়ে পড়ে। ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় এবং আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

৬. সরকারের কার্যাবলির ব্যাপক প্রসারঃ বর্তমানে গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কার্যাবলি এতই প্রসারিত হয়েছে যে, বাধ্য হয়ে শাসন বিভাগকে নানাবিধ কার্য সম্পাদন করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হচ্ছে। তাছাড়া এসব কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। আর শাসন বিভাগই এ নেতৃত্বদানে দক্ষ। ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।

৭. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্বঃ আগে সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ সাধনের অন্যতম মাধ্যম ছিল আইনসভা। কিন্তু বর্তমান সময়ে চাপসৃষ্টিকরী গোষ্ঠী ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যাবলি সম্পর্কে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে আইনসভার প্রাধান্য হ্রাস পায়।

৮. সদস্যদের স্বার্থপরতাঃ আইনসভার ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাসের অন্যতম কারণ হলো আইনসভার সদস্যদের স্বার্থপর মনোবৃত্তি। তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উঠে পড়ে লাগে।

৯. গণসংযোগের অভাবঃ বর্তমান গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে শাসন বিভাগকেই নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ করতে হয়। শাসন বিভাগ জনগণের নানাবিধ প্রয়োজনের সাথে পরিচিত হয়। ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনগণের সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয় এবং এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

১০. যোগ্য নেতৃত্বঃ রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব আবশ্যক। আইনসভার সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের সদস্যরা অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাই শাসন বিভাগই উপযুক্ত নেতৃত্বের অধিকারী।

১১. সম্মান ও পদমর্যাদাঃ আইন পরিষদের সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের সদস্যরা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। তাই তারা আইন পরিষদের সদস্যদের তুলনায় অধিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন।

১২. বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। ফলে শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

১৩. যুদ্ধবিগ্রহ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিঃ যুদ্ধবিগ্রহ ও আন্তর্জাতিক সংকট মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে শাসন বিভাগ জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়।

১৪. সরকারি কাজের প্রসারঃ বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কাজের পরিধি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে কিছু কিছু কাজের দায়িত্ব শাসন বিভাগের উপর এসে পড়ে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, শাসন বিভাগের মাধ্যমেই মূলত সরকারের কার্যাবলি সম্পাদিত হয়ে থাকে। আইনসভা কেবল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে থাকে, বিভাগ আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারসহ বহুবিধ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। ফলে প্রায় প্রতিটি দেশের আইনসভা শাসন বিভাগের সিলমোহরে পরিণত হয়েছে।