প্রথাগত শিক্ষা কাঠামাের প্রথম স্তর হল ‘প্রাথমিক শিক্ষা’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাংবিধানিক নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষার কিছু অগ্রগতি হলেও আজও তা বহু সমস্যায় জর্জরিত এবং ত্রূটিপূর্ণ।
(১) আর্থিক সমস্যা: পৃথিবীর বিভিন্ন প্রগতিশীল দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি আর্থিক বরাদ্দ প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক কম।
(২) সামাজিক সমস্যা: বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কারণে সাক্ষরতা ও গণশিক্ষার আলাে আজও আমাদের দেশের সব মানুষের কাছে পৌছেয়নি।
(৩) পরিকাঠামো ও পদ্ধতিগত সমস্যা: শিক্ষার পরিকাঠামাে ও পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণেও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
(৪) অপচয় ও অনুত্তীর্ণতা: আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে অপচয় এবং অনুত্তীর্ণতা সব থেকে বড়াে বাধা। বিভিন্ন কারণে এই অপচয় ও অনুত্তীর্ণতার সমস্যা দেখা দেয়।
(৫) প্রবল জনসংখ্যার চাপ: আমাদের দেশের অত্যধিক জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামাের জোগান অপ্রতুল—যা প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
(৬) শিশুশ্রমিক আইনের ব্যর্থতা: সমাজের এক বড়াে অংশের দরিদ্র মানুষ তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানাের থেকে কোনাে কাজে যুক্ত করে দেওয়াটাই বেশি অর্থকরী বলে মনে করে।
(৭) অন্যান্য সমস্যা: বিভিন্ন সময়ে দেশের নানাপ্রান্তে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের মধ্যে উপযুক্ত সচেতনতার অভাব, অনিয়মিত ও নিম্নমানের মিড-ডে মিল ইত্যাদি কারণ আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ক্রুটিপূর্ণ করে তুলেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলি দূর করার জন্য নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করা প্রয়ােজন一
(১) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি: প্রতি এক বর্গকিলােমিটারের মধ্যে কমপক্ষে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করতে হবে।
(২) অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরােপুরি অবৈতনিক, সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(৩) বাস্তবোচিত পাঠক্রম: বাস্তবজীবনের দিকে লক্ষ রেখে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং পাঠক্রম স্থির করা উচিত।
(৪) আর্থিক ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি: প্রাথমিক শিক্ষাখাতে উপযুক্ত পরিমাণ সরকারি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৫) বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব ছাত্রছাত্রী ভরতি হবে তাদের প্রত্যেককে বিনামূল্যে বইখাতা ও অন্যান্য শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ দিতে হবে।
(৬) মি-ডে মিলের ব্যবস্থা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর জন্য নিয়মিতভাবে এবং উন্নতমানের মধ্যাহ্নভােজের (মিড-ডে মিল) ব্যবস্থা করতে হবে।
(৭) স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসা: নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৮) জাতীয় নীতি: দেশের সর্বত্র একটি সাধারণ নিয়ম মেনে ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রাদেশিক সংকীর্ণতার গণ্ডি এড়িয়ে শিক্ষার প্রসার সম্ভব হয়।
(৯) পরিকাঠামোগত সংস্কার: জীর্ণ বিদ্যালয়গৃহগুলির সংস্কার করে আলাে বাতাসযুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয়গৃহের ব্যবস্থা করতে হবে।
(১০) আকর্ষণীয় পাঠক্রম: প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে এবং বিভিন্ন প্রকার সহপাঠক্রমিক কাজের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
(১১) পরিদর্শনের ব্যবস্থা: সরকারি তরফে নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(১২) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক: প্রাথমিক শিক্ষায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষকতার কাজে নিয়ােগ করতে হবে।
জাতীয় উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে একে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
Leave a comment