প্রশ্নঃ প্রাণ বা জীবনবিষয়ক মতবাদ যন্ত্রবাদ- মূল্যায়ন কর।

অথবা, প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ সমালােচনসহ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ দর্শন জগতের মৌলিক সমস্যার যৌক্তিক সমাধান দেবার চেষ্টা করে। প্রাণবাদ দর্শনের একটি অন্যতম সমস্যা। প্রাণের আবির্ভাব সম্পর্কে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্ববিদসহ প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিই এর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যার কারণে প্রাণবাদ, যন্ত্রবাদ, উন্মেষবাদ বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নে প্রাণবাদী মতবাদের দার্শনিকগণ যন্ত্রবাদ সম্পর্কে যেসকল ত্রুটি ও মতবাদ তুলে ধরেছেন তা ব্যাখ্যা করা হলাে-

প্রাচীন যুগে প্রাণবাদঃ গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে প্রাণবাদের আভাস পাওয়া যায়। তিনি প্রাণশক্তিকে জীবের সাংগঠনিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেন। এই সাংগঠনিক শক্তিই তার ভাষায় জীবনশক্তি।

মধ্যযুগের প্রাণবাদঃ এরিস্টলের চিন্তাধারার প্রভাব মধ্যযুগেও লক্ষণীয়। মধ্যযুগে এটি বিশ্বাস করা হত যে, প্রাণের উৎস জড় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই উৎসকে আধ্যাত্মিক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতি বলে মনে করা হত।

আধুনিককালের প্রাণবাদঃ আধুনিককালেও প্রাণবাদ জীববিজ্ঞানী ও শরীরতত্ত্ববিদদের সমর্থন লাভ করেছে। জার্মান জীববিজ্ঞানী হ্যান্স ড্রিস প্রাণবাদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশন করেন। তিনি পরীক্ষণমূলক প্রমাণের সাহায্যে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, প্রাণকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করা সম্ভর নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, প্রাণবাদ হলাে এমন একটি মতবাদ যেটা প্রাণকে একটি মৌলিক শক্তিরূপে গণ্য করে, যার অবস্থান জড়দেহে।

প্রাণবাদের ক্রটিসমূহঃ প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে প্রাণবাদের কতগুলাে ত্রুটি বিদ্যমান। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে-

(১) প্রাণ জড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়ঃ প্রাণ জড় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং একেবারেই জড় থেকে বিচ্ছিন্ন এ কথা ঠিক নয়। জড়ের সাথে প্রাণের এক ধরনের সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। জড়ের সাথে সম্পর্কিত হয়েই প্রাণ বিদ্যমান। জড়ের সাথে প্রাণের এ সম্পর্কটি প্রাণবাদে উপেক্ষিত হয়েছে।

(২) প্রাণবাদ যৌক্তিক নয়ঃ প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ একটি মৌলিক শক্তিরূপে জড়দেহে অবস্থান করে কিন্তু শক্তি হিসেবে কীভাবে প্রাণশক্তি জড়দেহে অস্তিত্বশীল, তা প্রাণবাদীরা যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করেননি।

(৩) প্রাণবাদ প্রমাণিত নয়ঃ জড় দেহে দার্শনিকগণ প্রাণশক্তিকে জড়শক্তির অতিরিক্ত এক স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত পরীক্ষণের সাহায্যে জীবদেহে ভৌত রাসায়নিক শক্তি ছাড়া অন্য কোনাে প্রাণশক্তির অস্তিত্বের কথা জানা সম্ভব হয়নি।

যন্ত্রবাদঃ প্রাণশক্তির স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে যন্ত্রবাদী দার্শনিকরা জীবদেহকে যন্ত্রবাদের সাথে তুলনা করেন। তারা মনে করেন প্রাণহীন জড় থেকেই প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। ভৌতিক ও রাসায়নিক শক্তির সমন্বয়ে জীবদেহ গঠিত। প্রাণ বা জীবন জড়শক্তি থেকে পৃথক কোন অসাধারণ বা রহস্যময় কোনাে পদার্থ নয়। যন্ত্রবাদীদের মতে, জীবদেহের সাথে যন্ত্রের যদি কোনাে পার্থক্য থাকে তাহলে সেই পার্থক্য গুণের নয় জটিলতার। যন্ত্রের তুলনায় জীবদেহ জটিল, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে পরিমাণগত; গুণগত নয়।

যন্ত্রবাদীরা জীবদেহের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, জীবদেহের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায়। ভৌতিক ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে জীবকোষ সৃষ্টি। এ জীবকোষ বহু কোষে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বহু জীবকোষ একত্রে সন্নিবিষ্ট হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৃষ্টি করে। আবার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একত্রে মিলিত হয়ে জীবদেহের সৃষ্টি হয়। সুতরাং জীবদেহের উৎপত্তির মূলে আছে ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনাে ঈশ্বরের স্বীকার করার প্রয়ােজন নেই।

যন্ত্রবাদীরা জীবদেহে কোনাে প্রাণশক্তির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। তারা প্রাণশক্তিকে জড়শক্তিরই একটি ভিন্নরূপ বলে মনে করেন। তাদের মতে, ভৌতিক ও রাসায়নিক শক্তির সাহায্যে প্রাণের উৎপত্তিসহ বিশ্বের সবকিছুকে ব্যাখ্যা করা যায়। কাজেই প্রাণের উৎপত্তি হচ্ছে জড় থেকে এবং জড়শক্তির ক্রিয়াই হচ্ছে প্রাণ। প্রাচীন কালের দার্শনিক ডেমােক্রিটাস থেকে শুরু করে স্পেনসার, হাক্সলি, নিউটন প্রমুখ দার্শনিক এবং আধুনিককালের অনেক দার্শনিক যন্ত্রবাদকে সমর্থন করেন।

যন্ত্রবাদীরা তাদের এ মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন সন্দেহ ও সমালােচনার সম্মুখীন হওয়ার কারণে তারা এ সম্পর্কে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। যেমন-

প্রাণ রহস্যময় নয়ঃ অনেক দার্শনিক মনে করেন, জীবন বা প্রাণ একটি রহস্যময় ঘটনা। তবে যন্ত্রবাদীরা এটা স্বীকার করেন না। তারা বলেন, জীবন রহস্যময় নয়। প্রাণের বাহ্য প্রক্রিয়া থেকে প্রাণকে পৃথক ও স্বতন্ত্র বলে চিন্তা করা একটা কুসংস্কারের ফল। তারা বলেন, জৈবিক প্রক্রিয়াকে কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করাই হবে যথার্থ ব্যাখ্যা।

প্রাণের যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যার অগ্রগতিঃ যান্ত্রিক পদ্ধতির অগ্রগতির ফলে এখন জীবদেহের ওপর উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়া অঙ্গের ও মাংসপেশির বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়গুলাে এ পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যায়। যন্ত্রবাদীরা আশা করেন যে, অদূর ভবিষ্যতে সকল জৈবিক প্রক্রিয়াকেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে।

যান্ত্রিক ব্যাখ্যাই হলাে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ইত্যাদি বিজ্ঞান কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে এদের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে। তাই বর্তমান যুগে জীববিদ্যাকেও প্রাণের আলােচনায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করা হবে।

যান্ত্রিক ব্যাখ্যাই যথার্থ ব্যাখ্যাঃ যন্ত্রবাদীদের মতে যান্ত্রিক ব্যাখ্যার ফলে প্রাণ আমাদের নিকট সহজবােধ্য হয়। ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলােকে পরীক্ষাগারে ব্যাখ্যা করা যায়। কাজেই প্রাণকে ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে রূপান্তরিত করা হলে প্রাণের ব্যাখ্যা সহজবােধ্য হবে।

যন্ত্রবাদের সমালােচনাঃ যন্ত্রবাদীদের মতবাদ জড়বাদের স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। জড় ও প্রাণ এক বা অভিন্ন হতে পারে না, কেননা জড় ও প্রাণের মধ্যে মৌলিক ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে। ভৌতিক ও রাসায়নিক পদার্থের দ্বারা জীবকোষ গঠিত-যন্ত্রবাদীদের এ মতবাদ সন্তোষজনক নয়, কেননা প্রাণসংযুক্ত জীবকোষে এমন কতগুলাে গুণ দেখা যায়, যার উদ্ভব ভৌতিক ও রাসায়নিক পদার্থ থেকে হতে পারে না। যান্ত্রিক ব্যাখ্যা সব ক্ষেত্রে চলে না। যান্ত্রিক ব্যাখ্য সব ক্ষেত্রে চলে না। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যায় যান্ত্রিক ব্যাখ্যা চলতে পারে, কেননা এসব বিজ্ঞান জড়পদার্থ নিয়েও আলােচনা করে। কিন্তু প্রাণের এমন কতগুলাে বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলাের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য জীববিদ্যার সবক্ষেত্রে যান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রয়ােগ করা চলে না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যন্ত্রবাদ বা জড়বাদ আধুনিক দর্শনের একটি অন্যতম বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি এ যন্ত্রবাদ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক চলে আসছে। অনেক দার্শনিক যন্ত্রবাদের সাফাই গেয়েছেন। আবার অনেক দার্শনিক যন্ত্রবাদের কড়া সমালােচনাও করেছেন। তবে বিশ্লেষণী দার্শনিকদের মতে, জড়বাদী চিন্তাধারা জগৎকে চিন্তা করার গভীরতা আরাে বাড়িয়ে দিয়েছে।