প্রশ্নঃ প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর। জীবন কী জড়ের জটিল রূপ? আলােচনা কর।

অথবা, প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। জীবন কী জড়ের জটিল রূপ? ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ মানব জীবনে চিন্তার বিভিন্ন শাখায় প্রাণ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এর বিভিন্ন মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। এ সকল মতবাদের মধ্যে প্রাণের উৎপত্তি ও স্বরূপ সম্পর্কে যে কয়টি মতবাদ প্রচলিত তাদের মধ্যে প্রাণবাদ ও যন্ত্রবাদ অন্যতম। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত এই দুই মতবাদ পরস্পর বিপরীত ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। প্রাণবাদ অনুসারে প্রাণশক্তি, জড়শক্তি থেকে পৃথক এবং এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। অন্যদিকে যন্ত্রবাদ অনুসারে প্রাণ জড়ের জটিলতম রূপমাত্র। জীবদেহ একটি জটিল যন্ত্রমাত্র। প্রাণ ও জড়ের মধ্যে মৌলিক কোনাে পার্থক্য নেই।

প্রাণবাদঃ প্রাণবাদ হলাে এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদ মনে করে যে এ জীবন বা প্রাণ কোনাে প্রাণহীন জড় থেকে আগত বা উৎপন্ন নয়। প্রাণের উৎপত্তি একটি অজড়ীয় শক্তি থেকে। প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ অনিবার্যভাবে জড় দেহকে আশ্রয় করে থাকলেও এটি স্বরূপগত জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রাণীর মধ্যে যে কর্মচঞ্চলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয় তা জড়ের মধ্যে নেই। কাজেই জড়শক্তির প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন গুণবিশিষ্ট প্রাণী বা জীবকে নিছক ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তারা বলেন, শরীরের ভেতরে প্রাণশক্তি নামক এক বিশেষ শক্তি বিদ্যমান, যা জড়াতিরিক্ত। এ শক্তি থেকেই প্রাণের উৎপত্তি।

যন্ত্রবাদঃ যন্ত্রবাদ অনুসারে প্রাণ ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন সালফার, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি ভৌত-রাসায়নিক উপাদান জীবকোষ গঠন করে এবং কালক্রমে ভৌত রাসায়নিক শক্তির প্রক্রিয়ার ফলে জীবদেহের উৎপত্তি হয় এবং প্রাণশক্তি লাভ করে। যন্ত্রবাদীদের মতে, জড় ও জীবের মধ্যে প্রকৃতিগত কোনাে পার্থক্য নেই। তবে জীবন জড়পদার্থের চেয়ে অধিকতর সূক্ষ্ম ও জটিল। যন্ত্রবাদীরা ভৌত রাসায়নিক শক্তি ব্যতীত অন্য কোনাে রকম রহস্যজনক প্রাণশক্তির উপস্থিতি স্বীকার করেন না।

যন্ত্রবাদীদের মতে, জড়পদার্থের মত জীবদেহও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। কাজেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রাণের ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব, এখানে কোনাে অতিপ্রাকৃত রহস্যজনক শক্তির প্রয়ােজন নেই। তারা আরাে বলেন, দৈহিক শক্তির বৃদ্ধির ফলে প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার দৈহিক ক্ষয়ের ফলে প্রাণশক্তিও হ্রাস পায়। এর ওপর ভিত্তি করেই যন্ত্রবাদীরা সিদ্ধান্ত নেন যে, জড় থেকে প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তি।

প্রাণবাদ ও যন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ প্রাণবাদ ও যন্ত্রবাদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সেগুলাে উল্লেখ করা হলাে-

(১) যন্ত্রবাদ হলাে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত একটি জড়বাদী ব্যাখ্যা। অন্যদিকে প্রাণবাদ হলাে প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি আধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা।

(২) যন্ত্রবাদ অনুসারে জড় ও প্রাণ অভিন্ন এবং প্রাণ জড়ের জটিলতম রূপমাত্র। অন্যদিকে প্রাণবাদ অনুসারে জড় ও প্রাণ ভিন্ন দুটি জিনিস। এদের মধ্যে মৌলিক গুণগত পার্থক্য রয়েছে।

(৪) যন্ত্রবাদ প্রাণের অস্তিত্বের পেছনে কোনাে আধ্যত্মিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে প্রাণবাদ প্রাণের উৎপত্তির ক্ষেত্রে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের ভূমিকা স্বীকার করে।

(৫) যন্ত্রবাদ প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা সংক্রান্ত একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। অন্যদিকে প্রাণবাদ একটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

(৬) যন্ত্রবাদ অনুসারে কোনাে রহস্যময় প্রাণশক্তির অস্তিত্ব জীবদেহের নেই। কিন্তু প্রাণবাদ জীবদেহে জড়াতিরিক্ত প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।

(৭) যন্ত্রবাদ জড়বাদী দর্শনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অন্যদিকে প্রাণবাদ ভাববাদের সাথে সংগতিপূর্ণ।

(৮) যন্ত্রবাদ অনুসারে জড় থেকে প্রাণের উৎপত্তি। অন্যদিকে প্রাণবাদ অনুসারে প্রাণ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি জড় থেকে নয়।

(৯) যন্ত্রবাদীদের মতে, জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তা পরিমাণগত। অপরপক্ষে প্রাণবাদীদের মতে জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তা গুণগত।

জীবন কী জড়ের জটিলতম রূপঃ জীবন জড়ের জটিলতম রূপ কী না? প্রশ্নটির উদ্ভব ঘটেছে যন্ত্রবাদীদের জীবন বা প্রাণের ব্যাখ্যা প্রদানের থেকে। আর এ প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিতে গিয়েই মূলত যন্ত্রবাদ প্রকাশ পেয়েছে। কারণ এমতবাদ অনুসারে জড় থেকেই প্রাণের উদ্ভব। প্রাণশক্তির উৎপত্তি জড় থেকেই হয়েছে। জড়ই প্রাণের আদি উপাদান। প্রাণশক্তি জড় থেকে পৃথক কোনাে শক্তি নয় বরং প্রাণশক্তি জড়েরই জটিলতম রূপমাত্র। আর জীবদেহ হলাে জটিল যন্ত্রবিশেষ। জড় ও প্রাণের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। এদের মধ্যে যে কিঞ্চিত পার্থক্য তা পরিমানগত। জড় ও গতির যৌগিক ক্রিয়ার ফলে সমস্ত জীবের উদ্ভব। তারা বলেন, জীবদেহ জটিল কিছু নয় এবং জীবন ও জড়ের জটিলতম রূপ নয়। তাদের মতে জড়শক্তি থেকে প্রাণশক্তি সম্পূর্ণ পৃথক এবং এদের মধ্যে মৌলিক গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। জীবের এমন কতকগুলাে মৌলিক বৈশিষ্ট্য যেমন- আত্মসংরক্ষণ, আত্মােন্নন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রজনন ইত্যাদি রয়েছে যেগুলাে যন্ত্রের মধ্যে নেই। এজন্যই জীবদেহের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রযােজ্য নয়। জীবনের এসব বৈশিষ্টের কারণেই প্রাণের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়। প্রাণ হলাে জীবদেহের চালিকাশক্তি। প্রাণশক্তির ক্রিয়ার ফলেই জীবনের এসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, প্রাণের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় প্রাণবাদ ও যন্ত্রবাদ পরস্পর বিপরীত দুটি মতবাদ। যন্ত্রবাদ যেখানে প্রাণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জীবকে জটিল যন্ত্রে পরিণত করেছে। প্রাণবাদ সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মােন্নয়ন, প্রজনন ইত্যাদি ক্ষমতা দেখিয়ে জীবকে জড় থেকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে একথা দিবালােকের ন্যয় পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, প্রাণের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় যন্ত্রবাদের তুলনায় প্রাণবাদ অধিকতর গ্রহণযােগ্য।