অচলায়তন নামক কুসংস্কার ও শুষ্ক শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি আয়তনের আচার্য অদীনপুণ্য গুরুকে উদ্দেশ করে এই প্রার্থনা করেছেন।

এতদিন ধরে আচার্য সমস্ত পুথিগত বিদ্যা ও কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তাঁর অচলায়তনে। গুরু আচার্যকে আদর্শ শিক্ষাভার অর্পণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আদর্শ ছেড়ে পুথিকে আশ্রয় করেছেন। গুরুর আগমন বার্তায় আজ তার ভ্রান্তি ভেঙেছে। তাই তিনি নিজের তৈরি সংস্কারের বেড়া ভেঙে সুভদ্রকে প্রায়শ্চিত্তের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চান। কিন্তু তাঁর হঠাৎ এমন মতিভ্রম দেখে উপাধ্যায়, উপাচার্য প্রমুখ এতটাই বিস্মিত যে কেউ তাকে আর আচার্য বলে মানতেই রাজি নন। এই অবহেলা আচার্য মাথা পেতে নিয়েছেন এবং বলেছেন যে এতদিন পর্যন্ত যত অপরাধ ঘটেছে সব তাঁরই জন্য। তাই প্রায়শ্চিত্ত তাঁরই প্রাপ্য। কারণ তিনি গুরুর আদেশকে তুচ্ছ করে পুথি নিয়ে পড়েছিলেন আর তাই প্রকৃত জীবনের শিক্ষাই তার বাকি রয়ে গেছে। আশ্রমের তরুণ প্রাণগুলি তাঁর কাছে অমৃতের দীক্ষা চাইলেও তিনি কেবল জরাজীর্ণ সংস্কারের বােঝাই চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের ঘাড়ে। তার আচার্যকালের মধ্যেই মানবতার এরকম চূড়ান্ত অপমান ঘটায় অদীনপুণ্য গুরুকে আহ্বান করেছেন, যিনি মানুষকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে প্রাণকে তথা মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলেই তার একান্ত বিশ্বাস। তাই তিনি গুরুর উদ্দেশে এই প্রার্থনা জানিয়েছেন।

‘গুরু’ নাটকে ছােটো বালক সুভদ্র কৌতুহলী হয়ে উত্তর দিকের তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের জানলাটা এক মুহূর্তের জন্য খুলে ফেললেও অচলায়তনের সংস্কারের ভয় তার সরল মনে এমনভাবে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে যে সে, নিজেই তার এই শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে অগ্রসর হয়েছে। আচার্য ও পঞ্চকের শত বারণ সত্ত্বেও সে পিছু হটেনি। এই প্রসঙ্গেই আচার্য অদীনপুণ্য এই উক্তিটি করেছেন।

আচার্য বলেছেন সুভদ্রকে তার কাছ থেকে বল প্রয়ােগ করে ছিনিয়ে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানাে হলেও তিনি ব্যথিত হতেন না। কিন্তু হাজার বছরের নিষ্ঠুর সংস্কারের কালাে হাতের মুষ্টি ছােটো শিশুমনকেও এমন কঠিনভাবে চেপে ধরে যে তার মনে পাঁচ আঙুলের গভীর দাগ বসে যায়। তাই আচার্য অদীনপুণ্যের নিষেধ সত্ত্বেও সে প্রায়শ্চিত্ত করতে অগ্রসর হয়। এমনকি, আচার্য তার সঙ্গে প্রায়শ্চিত্তের সময় যেতে চাইলেও সুভদ্র রাজি হয় না। সুভদ্রের এই প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হয়ে আচার্য ভেবেছেন যে, সম্ভবত, মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই অচলায়তনের সংস্কার গর্ভস্থ ভ্রূণের মধ্যে ক্রিয়া করতে শুরু করে।

এর সবচেয়ে বড়াে প্রমাণ মেলে সুভদ্রের স্বেচ্ছায় মহাতামস ব্রত করতে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে। এতে বােঝা যায় সংস্কারের বিশ্বাস তার মনকে ঘিরে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘গুরু’ নাটকে তৃতীয় যূনক এই কথাটি পঞ্চক সম্বন্ধে বলেছে।

‘ভূত’ বলতে নিয়মের গারদে বন্দি থাকা অচলায়তনের বহু জরাজীর্ণ বিশ্বাস, সংস্কার ও কু-প্রথার কথা বলা হয়েছে।

সংস্কার-ঘেরা অচলায়তনের শাস্ত্রীয় বেড়াজাল ও বিধিনিষেধের মধ্যে ছােটো থেকে বড়াে হওয়ার জন্য অচলায়তনের মুক্ত প্রাণের প্রতীক পঞ্চক কিন্তু সম্পূর্ণরূপে প্রথামুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। যুবকদের মুক্ত জীবনাচরণের প্রতি তার লােভ থাকলেও মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সংস্কার তাকে পরিপূর্ণরূপে যূনকদের সঙ্গে মিশতে বাধা দেয়। শূনকদের মুক্তমন ও প্রকৃতি পঞ্চকের ভালাে লাগে, তাই সে বারবার আশ্রম থেকে বেড়িয়ে আসে তাদের কাছে। কিন্তু নিশ্চিন্তে বিনা দ্বিধায় তাদের সঙ্গে মিশতে পারে না। যতই সে গান গেয়ে নেচে বেড়াক না কেন, অচলায়তনে বাস করার জন্য প্রতিদিনের শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মনীতি তার মনেও কোথায় যেন অজান্তে এর প্রভাব ফেলে। তাই শূনকদের কাজের সঙ্গে সে তাদের কাজের পার্থক্য খুঁজে পায়। তাই সে মন খুলে যূনকদের কাছে টেনে নিতে পারে না। কিন্তু যূনকদের এমন কাজে কোনাে বাধা নেই। তারা আনন্দের সঙ্গে সব কাজ সমাধা করে। তাই পঞ্চককেও তারা সহজেই আপন করতে পারে। কিন্তু পঞ্চকের এমন ভাবান্তর দেখে স্বভাবতই তারা বিস্মিত হয়ে এইরকম উক্তি করেছে।

মহাপঞ্চকের সঙ্গে আচার্য অদীনপুণ্যের বিরােধের সূচনা গুরুর আগমনের পটভূমিকায়। আচার্য হওয়া সত্ত্বেও অদীনপুণ্যের মনে সংশয় “..হয়তাে অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে। বলেই তিনি আসছেন।” অহােরাত্র একেবারে নিয়মে বাধা” অচলায়তনে তিনি যে শান্তি খুঁজে পান তা ‘নিশ্চল শান্তি’। আত্ম উপলদ্ধির এই পথ ধরেই একদিন অদীনপুণ্য শাস্ত্রের শাসন আর শাস্ত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসেন। মহাপককে হতচকিত করে দিয়ে তিনি বলেছেন যে, উত্তর দিকের জানলা খােলার জন্য সুভদ্রর কোনাে প্রায়শ্চিত্ত করার দরকার নেই, ‘যদি কোনাে অপরাধ ঘটে সে আমার।‘ সুভদ্রকে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন যে সে কোনাে অপরাধ করেনি, যারা বিনা অপরাধে মুখ বিকৃত করে তাকে হাজার হাজার বছরের ভয় দেখাচ্ছে পাপ করছে তারাই। অচলায়তনের উদ্দেশ্যে মহাপঞকের স্পষ্ট বিদ্রুপ ধ্বনিত হয় এবং মহাপঞ্ক এই ঘটনাকে চিহ্নিত করেন সুভদ্রকে বাঁচাতে গিয়ে সনাতন ধর্মের বিনাশ বলে। তার কাছে এ হল আচার্যের বুদ্ধিবিকার’ এবং এ জন্য মহাপঞ্চক স্পষ্ট ঘােষণা করেন—“এ অবস্থায় ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না। এভাবেই আপাতভাবে সুভদ্রের উত্তর দিকের জানলা খােলাকে কেন্দ্র করে অদীনপুণ্যের সঙ্গে মহাপঞকের বিরােধ বাধলেও এ আসলে মহাপঞ্চকের অন্ধত্বের সঙ্গে অদীনপুণ্যের আত্মজাগরণের দ্বন্দ্ব।

স্থবিরপত্তনের রাজা মন্থরগুপ্ত অদীনপুণ্যকে অচলায়তনের প্রান্তে দর্ভকপল্লিতে নির্বাসন দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে অচলায়তন আপাতভাবে শিক্ষায়তন হলেও শাস্ত্র, আচার-বিচার আর সংস্কারে নিমজ্জিত সেই আয়তন শেষ অবধি অচলায়তনেই পরিণত হয়। এই অচলায়তনে পাথরকে সত্য বলে মানা হয়, পাথরে ঘাস জন্মানাে হয় নিন্দিত। কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহ, ভরদ্বাজ মিশ্রের প্রয়ােগ প্রজ্ঞপ্তি আর জ্বলনানন্তের আধিকর্মিক বর্ষায়ণে অচলায়তন পথের সন্ধান খোঁজে। আচার্য এর ব্যাখ্যায় বলেছেন— “এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায়…”। মুক্ত জীবনের বার্তাবাহক পককে তাই অচলায়তনে ‘দুর্লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়। বালক সুভদ্র কৌতূহলের বশে আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে দিলে তাকে ভয়ংকর পাপ হিসেবে বিবেচনা করে সকলেই তাকে প্রায়শ্চিত্ত করানাের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে। উপাধ্যায় যখন বলেন “তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের।” -তখন মানবতার ওপরে শাস্ত্রকে স্থাপন করা হয়। আর শিক্ষালয়ের অচলায়তনে পরিণত হওয়াও নিশ্চিত হয়ে যায়।

দাদাঠাকুরের নেতৃত্বে সেখানে শূনকেরা লড়াই করতে এসেছিল। আপাতভাবে চণ্ডকের হত্যা এবং দশজন শূনককে কালঝন্টি দেবীর কাছে বলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য শােধ নেওয়া তাদের উদ্দেশ্য হলেও, আসলে তারা এসেছিল। অচলায়তনের পাপের প্রাচীরকে ধুলােয় মিশিয়ে দিতে।

“তােমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ।”- এই কথার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের।”- এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“…নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও।”- মন্তব্যটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“তােমাদের হাতে দিয়ে আমার যে শান্তি আরম্ভ হল তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে।” -মন্তব্যটির মাধ্যমে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর মুষ্টি অতটুকু শিশুর মনকেও চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে।” – বক্তা এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে কী বলতে চেয়েছেন?

“পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষেবুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।” -বক্তার এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তােদের বুকে করে পাগলের মতাে নাচব…”— এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“তাকে বাঁধছি মনে করে যতগুলাে পাক দিয়েছি সব পাক কেবল নিজের চার দিকেই জড়িয়েছি।”— মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“তুমি যে আমার সঙ্গে লড়াই করবে— সেই লড়াই আমার গুরুর অভ্যর্থনা।”—বক্তা এই কথার মধ্যে দিয়ে কী বােঝাতে চেয়েছেন?

‘গুরু’ নাটকে ‘গুরু’-র ভূমিকাটি বিশ্লেষণ করাে।

একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে ‘অচলায়তন’ হয়ে ওঠে?

‘পাথরগুলাে সব পাগল হয়ে যাবে…’ —পাথরগুলাে পাগল হয়ে যাবে কেন?

‘গুরু’ নাটকে পঞ্চক চরিত্রটি আলােচনা করাে।

অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে পড়লে ছাত্রদের মধ্যে এর কী প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল?

“অচলায়তনে তাঁকে কোথাও ধরবে না” -কাকে কেন অচলায়তনের কোথাও ধরবে না?

অচলায়তনের বালক সম্প্রদায়ের কী বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে?

“এই তাে আমার গুরুর বেশ” -গুরুর কোন বেশের কথা বলেছে?

“শিলা জলে ভাসে”—কে, কোন্ প্রসঙ্গে কেন এ কথা বলেছেন?

“ভুল করেছিলুম জেনেও সে ভুল ভাঙতে পারিনি।” কে কাকে কোন্ ভুলের কথা বলেছে? ভুল ভাঙেনি কেন?

“ওরা ওদের দেবতাকে কাঁদাচ্ছে” -কারা কেন তাদের দেবতাকে কাদাচ্ছে?

পঞ্চক শূনকদের কাছ থেকে কোন্ গানের মন্ত্র পেয়েছে? অচলায়তনের মন্ত্রের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়?

দাদাঠাকুর পঞ্চককে তার দলে নিতে চাননি কেন আলােচনা করাে।

“একটু উৎপাত হলে যে বাঁচি”—কে বলেছে? কোন উৎপাত? সে উৎপাত চায় কেন?

“আমাদের রাজার বিজয়রথ তার উপর দিয়ে চলবে” -প্রসঙ্গটির ব্যাখ্যা দাও।

যূনকরা চাষ করে কেন? তাদের গানে এই চাষের আনন্দ কীভাবে ফুটে উঠেছে?

“ভাই তােরা সব কাজই করতে পাস” -কে, কাকে, কেন এ প্রশ্ন করেছে?

“ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ”—কার সম্পর্কে কেন এমন কথা বলা হয়েছে?