রােমান সাম্রাজ্য এবং ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রাচীন বিশ্বের দুটি উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ছিল। উভয় সাম্রাজ্যেই জনসাধারপের একটি বিশাল অংশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। রােমান ও গুপ্তযুগের সমাজের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
রােমান সাম্রাজ্য
-
রােমান সমাজ ছিল শ্রেগিবিভক্ত। এই সমাজে জনগণ প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- (i) প্যাট্রিসিয়ান, (ii) প্লেবিয়ান এবং (iii) ক্রীতদাস।
-
রােমান সমাজব্যবস্থায় সর্বাধিক সুযােগসুবিধা ভােগ করত প্যাট্রিসিয়ানরা। তারা বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক ছিল এবং সরকারি উচ্চপদগুলি তারাই দখল করত। তারা সমাজে অভিজাত বলে গণ্য হত।
-
রােমান সমাজব্যবস্থায় প্লেবিয়ানরা ছিল সাধারণ দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, ব্যবসায়ী, সৈনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। প্যাট্রিসিয়ানদের মতা রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্লেবিয়ানদের ছিল না।
-
রােমান সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে নির্যাতিত, বঞ্চিত এবং সুযােগসুবিধাহীন শ্রেণি ছিল অগণিত ক্রীতদাস| ক্রীতদাসদের নিজেদের জীবন ছিল শােষণ ও অত্যাচারের ঘাের অন্ধকারে ঢাকা।
গুপ্ত সাম্রাজ্য
-
গুপ্তযুগেও ভারতীয় সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত। চতুর্বর্গ প্রথাবিশিষ্ট গুপ্তযুগের সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল।
-
প্রাচীন ভারতের গুপ্তযুগের সমাজে সর্বাধিক সুবিধাভােগী শ্রেণি ছিল ব্রাম্মণ সম্প্রদায়। তারা কোনাে কায়িক পরিশ্রম না করে যাগযজ্ঞ ও পূজার্চনা করে জীবিকা নির্বাহ করত৷ গুপ্ত সম্রাটরা ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করতেন।
-
গুপ্তযুগের সমাজে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ক্ষত্রিয়রা দেশশাসন করত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসেবে কাজ করত। বৈশ্যরা ব্যাবসাবাণিজ্য ও কৃষিকাজ করত।
-
গুপ্তযুগের সমাজব্যবস্থায় শূদ্ররা ছিল চরম নির্যাতিত শ্রেণি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করাই ছিল পূদ্রদের প্রধান কাজ। তারা প্রায় ক্রীতদাসের সমগােত্রীয় ছিল।
প্রাচীন রােমে নির্যাতিত শ্রেণি হিসেবে ক্রীতদাসদের অস্তিত্ব নিয়ে কোনাে সংশয় নেই। কিন্তু গুপ্তযুগে ভারতে হিসেবে দাসেদের অবস্থা রােমান ক্রীতদাসদের মতাে ছিল না। এই দুই সাম্রাজ্যের দাসপ্রথার মধ্যে একটি তুলনামূলক আলােচনা নির্যাতিত শ্রেণি করা হল一
রােমান সাম্রাজ্য
-
প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারীদের একটি বড়াে অংশ ছিল ক্রীতদাস। রােমানরা যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাসে পরিণত করত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে দেখা যায় যে, রাজধানী রােমের মােট জনসংখ্যার 40 শতাংশ এবং সমগ্র রােমান সাম্রাজ্যের 20 শতাংশই ছিল ক্রীতদাস। প্রকৃতপক্ষে, ক্রীতদাসদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই রােমান অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।
-
রােমে সব ধরনের স্বাধীনতাহীন ক্রীতদাসদের জীবন ছিল বিষময় যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ। তারা ছিল প্রভুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রভুরাতাদের প্রাত্যহিকগৃহস্থলির কাজকর্ম, কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট তৈরি, প্রাসাদ নির্মাণ ও অন্যান্য শ্রমসাধ্য কাজে ক্রীতদাসদের নিয়ােগ করত। যখন তখন তাদের ওপর তীব্র শারীরিক নির্যাতন করা হত। তারা যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য তাদের কোমরে ও পায়ে শেকল বেঁধে রাখা হত।
-
রােমান ক্রীতদাসরা ছিল চরম অত্যাচার ও অবহেলার শিকার। এজন্য ক্রীতদাসরা প্রায়শই বিদ্রোহ করত। সিসিলিতে ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং ১০৪8। খ্রিস্টপূর্বাব্দে দুটি দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। রােমে সবচেয়ে বড়াে দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে। প্রথমদিকে সাফল্য পেলেও দুবছরের মধ্যে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় এবং স্পার্টাকাসের মৃত্যু হয় বলে অনুমান করা হয়।
গুপ্ত সাম্রাজ্য
-
প্রাচীন রােমের মতাে প্রাচীন ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্যে ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপকতা লক্ষ করা যায় না। দাসদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেও গুপ্তযুগের অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি। রােমের দাসদের বিকল্প হিসেবে গুপ্তযুগে শূদ্রদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ক্রীতদাসের জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হত। শাস্ত্রকার মনু উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করাই এই শূদ্রদের কাজ।
-
গুপ্ত যুগে শূদ্রদের জীবন কখনােই রােমের ক্রীতদাসদের মতাে এতটা করুণ ছিল না। যাজ্ঞবন্ধ্যস্মৃতি-ত বলা হয়েছে যে, শৃদ্র কার অধীনে কাজ করবে, তা তার নিজস্ব ব্যাপার। জৈমিনি তার ‘পূর্ব মীমাংসা সূত্র’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কোনাে ব্যক্তি যজ্ঞে তার সর্বস্ব দান করলেও সে কখনােই তার অনুগত শূদ্রকে দান করার অধিকারী হবে না। মনু উল্লেখ করেছেন যে, শূদ্র কোনাে অপরাধ করলে তার প্রভু তাকে শুধু এমন শাস্তিই দেবে, যা প্রভু তার স্ত্রী বা ভাইকে দিতে পারে।
-
গুপ্তযুগের দাসরা পারিবারিক জীবন যাপন করার এবং নিজের উপার্জিত অর্থ ভােগ করার অধিকারী ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য লিখেছেন যে, জোর করে কারােকে দাসে পরিণত করা হলে তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া ছিল রাজার কর্তব্য। তা ছাড়া, দাস তার প্রভুর শর্ত পূরণ করে দিলে, প্রদেয় অর্থ পরিশােধ করলে বা প্রভুর কোনাে উপকার করলে সেই দাস মুক্তি পেতে পারত। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই গুপ্তযুগে দাস বিদ্রোহের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
Leave a comment