পরবর্তী বৈদিক যুগে যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমটি শেষ করা হত তার নাম সমাবর্তন।
আদিম যুগকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— পুরাতন প্রস্তর যুগ, মধ্য প্রস্তরযুগ এবং নব্য প্রস্তর যুগ।
প্রাচীন যুগের শিক্ষার পর্বগুলি হল- আদি বৈদিক শিক্ষা, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা, মহাকাব্যের যুগের শিক্ষা এবং বৌদ্ধ শিক্ষা।
আধুনিক যুগের শিক্ষাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা এবং স্বাধীন ভারতের শিক্ষা।
উপনয়ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
বেদের চারটি ভাগ হল—ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব।
ব্রাহ্মগ্য শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষারম্ভের অনুষ্ঠানকে বলা হত উপনয়ন। উপনয়নের অর্থ হল, শিক্ষার জন্য শিষ্যকে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া।
ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীদের আট বছর বয়সে, ক্ষত্রিয় শিক্ষার্থীদের এগারাে বছর বয়সে এবং বৈশ্য শিক্ষার্থীদের বারাে বছর বয়সে উপনয়ন হত।
রাবিদ্যার লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিকে ভৗবজগতের জন্য প্রস্তুত করা। অপরাবিদ্যার লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিকে বাস্তব জগতের জন্য প্রস্তুত করা।
চতুরাশ্রম বলতে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস জীবনের এই চারটি অধ্যায়কে বােঝায়।
চতুর্বেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ ও ওই শ্রেণির সব বিদ্যাই অপরাবিদ্যা।
যে জ্ঞানের সাহায্যে পরমপুরুষকে লাভ করা যায়, তাই পরাবিদ্যা।
চারটি বেদ (ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব), ছয়টি অঙ্গ (শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ এবং কল্প), এ ছাড়াও পুরাপ, ব্রয়বিদ্যা, ইতিহাস, নক্ষত্রবিদ্যা, জীববিদ্যা ইত্যাদি পরাবিদ্যার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অপরাবিদ্যার পাঠক্রমে রাজনীতি, অস্ত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, দণ্ডনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা, ধাতুশিল্প, পশুপালন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় কোনাে বিশেষ কারণে শিক্ষার্থীর পাঠ বন্ধ থাকলে তাকে বলা হত নৈমিত্তিক অধ্যায়। নিয়মিত পাঠ বন্ধ থাকলে তাকে বলা হত নিত্য অনধ্যায়।
বিদ্যা স্নাতক—যে সমস্ত ব্রত পালন করেনি কিন্তু সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করেছে, তাকে বিদ্যা স্নাতক বলে।।
ব্রত স্নাতক—যে সমস্ত ব্রত পালন করেছে কিন্তু সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করেনি, তাকে ব্রত স্নাতক বলে।
বিদ্যাব্রত স্নাতক যে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন ও ব্রত পালন উভয়ই করেছে, তাকে বিদ্যাব্রত স্নাতক বলে।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপাধি বিতরণের সময় গুরু শিষ্যকে যে উপদেশগুলি দিতেন সেগুলি হল মাতৃদেবােভব (মাতাকে দেবী মনে করবে), পিতৃদেবােভব (পিতাকে দেবতা মনে করবে), আচার্যদেবােভব (আচার্যকে দেবতা মনে করবে), অতিথিদেবােভব (অতিথিকে দেবতা মনে করবে)। এ ছাড়া তিনি শিষ্যকে চরিত্রবান হওয়ার, লজ্ঞানের সদ্ব্যবহার করার, প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়ার এবং কাউকে কষ্ট না দেওয়ার উপদেশও দিতেন।
আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রহ্মস্থান বলতে পড়াশােনার স্থান, অগ্নিস্থান বলতে পূজা-অর্চনার স্থান, মহেন্দ্রস্থান বলতে যুদ্ধবিদ্যার স্থান, সােমস্থান বলতে উদ্ভিদবিদ্যার স্থান এবং গরুড়স্থান বলতে পরিবহণের স্থানকে বােঝাত।
বৈদিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থার দুটি বৈশিষ্ট্য- গুরুকুল: শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে পড়াশােনা করত। তাকেই গুরুকুল বলা হয়। উপনয়ন ও ব্রহমচর্যাশ্রম: উপনয়নের পর শিষ্যরা ব্রহ্মচারী হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম নিত।
বৈদিক ব্রাহ্মণিক যুগে ‘চতুরাশ্রম ব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য স্তরটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল ছিল৷
ব্রাহ্মপ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আত্মােপলদ্ধি ও আধ্যাত্মিক বিকাশ।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাহ্মগ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরা শিক্ষার সুযােগলাভ করত।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের বারাে বছর ধরে শিক্ষালাভ করতে হত।
বৈদিক যুগে শিক্ষালয়গুলি গুরুগৃহ, টোল ও পাঠশালা নামে পরিচিত ছিল।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি হিসেবে গুরুগৃহের বিভিন্ন প্রকার পারিবারিক কাজ করতে হত। যেমন পূজার ফুল সংগ্রহ, রান্নার জন্য কাঠ বা জ্বালানি সংগ্রহ ইত্যাদি।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুরা শিক্ষার্থীদের মৌখিক পাঠদান করতেন। এ ছাড়া কিছু বৃত্তিগত শিক্ষাও দিতেন।
বৈদিক যুগে মহিলা শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার সাথে নৃত্য, সংগীত ও বিভিন্ন প্রকার শিল্পকলাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত।
উপনিষদ শব্দের অর্থ হল—ব্রহ্মবিদ্যা।
বৈদিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অধীত বিদ্যার মূল্যায়ন করা হত প্রয়ােগমূলক ব্যবস্থার দ্বারা।
বৈদিক যুগের ব্রাহ্মণরা নিজেদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করতেন।
পুরুগৃহে থাকা কালে শিষ্যকে যেসব দায়িত্বপালন করতে হত, সেগুলি হল— গুরুর সেবা করা, গুরুগৃহ পরিষ্কার করা, গাে-পালন করা, পূজার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা ও গুরুর পরিবারের জন্য ভিক্ষা করা ইত্যাদি।
বৈদিক শিক্ষায় ব্রাহ্মণদের বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, নক্ষত্রবিদ্যা, ব্ৰথবিদ্যা, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।
বৈদিক শিক্ষায় ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি, দণ্ডনীতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হত।
বৈদিক শিক্ষায় বৈশ্যদের পশুপালন, কৃষিবিদ্যা, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হত।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতাে গুরু শিষ্যকে পুত্রের মতাে স্নেহ করতেন, শাসন করতেন, শিষ্য গুরুকে পিতার মতাে শ্রদ্ধা ও সমীহ করত।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুর কথাই ছিল শেষ কথা। গুরুর বিরুদ্ধাচরণ করা বা কোনাে বিষয়ে প্রতিবাদ করার অবকাশ ছিল না।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় আলােচনা, বিতর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিকাশ ঘটানাে হত।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় ব্রাহ্মণরা আট বছর বয়সে গুরুগৃহে শিক্ষা শুরু করত।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় ক্ষত্রিয়রা এগারাে বছর বয়সে গুরুগৃহে শিক্ষা শুরু করত।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় বৈশ্যরা বারাে বছর বয়সে গুরুগৃহে শিক্ষা শুরু করত।
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির নিকটবর্তী অঞ্চলে।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার তিনটি পর্যায় হল- ভিক্নুর শিক্ষা, গৃহীর শিক্ষা এবং গণশিক্ষা।
বৌদ্ধ শিক্ষার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হল— নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, বিক্রমশীলা মহাবিহার এবং তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শুরু হত, তাকে প্রব্রজ্যা বলে| প্রব্রজ্যার মাধ্যমে যে শিক্ষার্থীরা সংঘে প্রবেশ করত তাদের বলা হত শ্রমণ।
বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মপ্য শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি সাদৃশ্য হল উভয় শিক্ষাই ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
বৌদ্ধ শিক্ষা ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার মধ্যে একটি বৈসাদৃশ্য হল ব্রাহ্মপ্য শিক্ষা ছিল গুরুকুলকেন্দ্রিক, বৌদ্ধ শিক্ষা ছিল বিহার বা সংঘকেন্দ্রিক।
বৌদ্ধযুগের একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম হল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়/তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়/বিক্রমশীলা মহাবিহার।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার লক্ষ্য ছিল নির্বাণ ও সমস্ত জাগতিক দুঃখের অবসান।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য হল—এখানে শিক্ষার্থীদের বাইশ বছর ধরে শিক্ষালাভ করতে হত।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালয়গুলি বিহার ও মঠ নামে পরিচিত ছিল।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি হিসেবে নিয়মিত শরীরচর্চা এবং বিনােদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করত।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মৌখিক কথাবার্তার দ্বারা ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে পাঠদান করা হত।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের অধীত জ্ঞান তথা শিক্ষাগত যােগ্যতার মূল্যায়ন করা হত একদল শিক্ষকের দ্বারা মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার ভিত্তিতে ধর্মবর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষকেই পঠনপাঠনের সুযােগ দেওয়া হত। এই কারণে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বজনীন শিক্ষা বলা হয়।
পরিনির্বাণ হল বৌদ্ধ শিক্ষার চরম লক্ষ্য। দুঃখ জর্জরিত সমাজজীবনের বন্ধন থেকে চিরকালের জন্য মুক্তিলাভই হত পরিনির্বাণ।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রব্রজ্যা নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শুরু হত। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে শিক্ষার্থীরা সংঘে প্রবেশ করত, তাদের বলা হত শ্রমণ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি গ্রন্থাগারের নাম ছিল রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি চিন, তিব্বত, কোরিয়া, জাভা, সুমাত্রা, সিংহল, যবদ্বীপ প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিক্রমশীলা মহাবিহার বা বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিখ্যাত অধ্যাপক হলেন—অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, অভয়কর গুপ্ত, জ্ঞানপদ, প্রভাকরমতি প্রমুখ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতনামা অধ্যাপক হলেন শীলভদ্র, নাগার্জুন, ধর্মপাল, চন্দ্রপাল, গুপমতী প্রমুখরা।
চারটি আর্যসত্য হল- মানুষের জীবনে দুঃখ রয়েছে, মানুষের জীবনে দুঃখের কারণ রয়েছে, মানুষের দুঃখ নিবারণের উপায় রয়েছে, দুঃখ নিবারণের জন্য সঠিক পথের প্রয়ােজন।
Leave a comment