অথবা, প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদের ভূমিকা আলোচনা কর

উত্তর: ভূমিকা : চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলক গান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। চর্যাপদগুলোর রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে নির্ণীত না হলেও নানা আলোচনা হতে বিশেষজ্ঞগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাতে জানা যায় যে, এগুলো দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। ঐতিহাসিক মতে, এ সময়ের মধ্যে বঙ্গদেশে পাল রাজাদের পতন ও সেন রাজাদের রাজত্বকাল। এসময় চর্যাপদকর্তাগণ নিজ নিজ অবস্থায় নিজেদের ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৎকালীন সমাজের বাস্তব জীবনযাত্রার যেসব রূপকল্প ব্যবহার করেছেন তা বিস্ময়ের বটে।

চর্যাপদ আবিষ্কার: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ গ্রন্থাগার থেকে ১৯০৭ সালে সাহিত্যের কতকগুলো পদ আবিষ্কার করেন এবং তার নাম দেওয়া হয় ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। তবে আধুনিক পণ্ডিতগণের অনুমান যে, পুথিটির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’ এবং এর সংস্কৃত টীকার নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।’ চর্যায় প্রাপ্ত পুথিতে একান্নটি গান ছিল এবং চব্বিশ জন পদকর্তার পরিচয় পাওয়া যায়। চর্যাপদের সঠিক রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতেরা একমত হতে পারেননি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চর্যাপদের কাল ধরেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে চর্যাপদের রচনা কাল, মনে করেন।

চর্যাপদ রচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীন যুগ বলতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হিসাব করা হলে এই সময়ে আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পাল ও সেন রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। পাল রাজবংশের রাজত্বকাল ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময় সাংস্কৃতিক জগতে যথেষ্ট উন্নতি হয়। সেন বংশ ১১৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়- বিজয় সেন, বল্লাল সেন এবং লক্ষ্মণ সেন- এর মধ্য দিয়ে রাজত্বকালের পতন ঘটে। এই পতনের পিছনে মূলত ধর্মীয় কারণই বিশেষভাবে দায়ী। ধর্মীয় বিশেষকে আশ্রয় করেই বাংলা ভাষায় অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হতে থাকে। এই সময় ব্রাহ্মণ্য সাধনা আচার-সর্বস্বতায় পরিণত হয়। ভগবানের পরেই ব্রাহ্মণেরা সমাজে স্থান করে নেয়- যাদের কাছে নিম্নবর্ণের লোকেরা অস্পৃশ্য। সাহিত্যের ভাষা বলতে তখন সংস্কৃত ভাষাকেই বুঝাত। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন আত্মগোপন করে টিকে ছিল এসময়। এই ধর্মীয় বিভাজনের পাশাপাশি সেই সময় সমাজের শ্রেণিস্তরও বিন্যস্ত হয়। শাসক এবং শোষিত এই দুই শ্রেণিতে সমাজ-ব্যবস্থা স্পষ্টতই বিভক্ত হয়ে পড়ে।

সত্যব্রত দে চর্যাপদের ঐতিহাসিক পটভূমি নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, “এ-সময়ের মধ্যে বঙ্গদেশে পাল রাজাদের পতন ও সেন রাজাদের রাজত্বকাল। ধর্মের দিক হইতে পাল-কম্বজ- সেন-বর্মণ রাজাদের বিশ্বাসের পার্থক্য ছিল, কিন্তু সামাজিক দিকে অন্তত একটি বিষয়ে ইহা সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একটি বিশেষ ব্যবস্থাকে স্থায়ী করিয়া গিয়াছেন- তাহা বাংলার বর্ণবিন্যাসের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বর্ণের প্রতিষ্ঠা ও হাড়ি ডোম শবর প্রভৃতি অন্ত্যজ জাতিগুলির সামাজিক অবনত অবস্থায় পতন।”

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাগীতিকার স্থান ও গুরুত্ব নির্ধারণ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চর্যাপদ’ শুধু উল্লেখযোগ্য প্রাচীন নিদর্শন হিসেবেই নয়, চর্যাপদের রয়েছে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক; গুরুত্ব বিচারে এগুলো হচ্ছে- ক. ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব,

খ. ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব,

গ. তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরার বিষয়ে গুরুত্ব,

ঘ. নান্দনিক গুরুত্ব,

ঙ. সাহিত্যে প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে চর্যাপদের গুরুত্ব।

চর্যাপদের ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব: চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলেও এর-ভাষা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মের নির্বাণতত্ত্ব-মহাসুখের স্বরূপ ও তা লাভের পন্থা চর্যাপদে কখনো প্রহেলিকা ভাষায়, কখনো দার্শনিক ভাষায়, কখনো যোগসাধনের পরিভাষায়, কখনোবা তান্ত্রিক কায়াসাধনের গূঢ় সঙ্কেতের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। আর এই বক্তব্য প্রকাশের জন্য তখনকার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষার সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চর্যাপদে বাংলা, শৌরসেনী, অপভ্রংশ প্রাচীন হিন্দি, মৈথিলী, উড়িয়া ও অসমিয়া শব্দের বাহ্য ও আংশিক ব্যবহার লক্ষ করেই কেউ কেউ চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে উল্লেখ্য- উড়িষ্যা, বিহার, আসাম, নানামযজ প্রকাশ করেছেন নিজয়েজ ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদান হিসেবোংলাদেশে বিবেচিত এবং ভাষা সাহিত্যের পাঠ্য হিসেবে সূচিভুক্ত। চর্যাপদকর্তাগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে সকলের ভাষা একরূপ হতে পারে না; প্রাচীনত্বের জন্য গৌড় অপভ্রংশের প্রভাবও এতে রয়ে গেছে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আর্যদেবের ভাষা উড়িয়া, শান্তিপার ভাষা মৈথিলি এবং কাহ্নপা, সরহপা, ভুসুকুপার ভাষা প্রাচীন বাংলা বঙ্গকামরূপী বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও ছন্দের ভিত্তিতে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, চর্যার পদসংকলনটি আদিমতম বাংলা ভাষায় রচিত। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর গানগুলো হেঁয়ালি ধরনের সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এ প্রহেলিকাময় পদগুলো প্রতীক ও রূপকাশ্রিত। পদগুলোর বাইরের অর্থ অনেকটা সরল ও বোধগম্য হলেও সেগুলোর আড়ালে রয়েছে ধর্মীয় নানা আধ্যাত্মিক অর্থ। সে অর্থ বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য। চর্যার গভীরতর অর্থের নেপথ্যে বিরাজিত সাধন তত্ত্বের রূপকার্থই প্রধান। সন্ধ্যার মতো আলো- আঁধারের অস্পষ্টতায় রহস্যময় বা হেঁয়ালিপূর্ণ বলে এগুলোকে বলা হয় ‘সন্ধ্যাভাষা’ বা আলো-আঁধারী ভাষা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মৈথিলী, অপভ্রংশ ভাষা-ভাষী অঞ্চলের সমাজ- সংস্কৃতি এবং জীবন-জীবিকার রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ বাংলাভাষী মানুষের জীবনচিত্র এবং ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্যের সাথে। চর্যার ভাষা অসমিয়া কিংবা হিন্দি বা অপভ্রংশ নয়- কারণ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্ববর্তী স্তর অপভ্রংশ। অন্যান্য ভাষার কিছু লক্ষ্মণ চর্যাগীতিকায় বিদ্যমান থাকলেও- সে কারণে তাকে ঐ ভাষাগোষ্ঠীর বলে দাবি করা যৌক্তিক নয়- এটাই যৌক্তিক যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা।

ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব: বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বকথা চর্যাপদে বিধৃত হয়েছে। চর্যাপদগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। এগুলোতে বৌদ্ধমতের বিভিন্ন সাধনপদ্ধতির কথা আছে। চর্যাপদের কতকগুলো বিষয় সোজাসুজি আধ্যাত্মিক। তাতে জন্ম-মৃত্যু, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখের দোলা থেকে মুক্তি লাভের এবং সহজ অবস্থায় রূপ মহাসুখ-নিবাসে পৌঁছার ঠিকানা আছে। পদকর্তাদের ভাষায়-

“তীণি ভূষণ মই বাহিঅ হেলে।

হউ সুতেলী মহাসুহ লীলে ।” [১৮ নং চর্য]

প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে ধর্মীয় চেতনা ও সামাজিক চিত্রের সমন্বয় ঘটেছে। সাহিত্যে জীবনের প্রতিফলন বরাবরই স্পষ্ট। যুগে যুগে জীবনাদর্শের পরিবর্তনের ছাপ ফুটে উঠে সাহিত্যে। সে পরিবর্তনের চিহ্ন নিয়ে সাহিত্য যুগে যুগে নতুন বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয়।

তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরার বিষয়ে গুরুত্ব: ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। সামাজিক বৈষম্য ও পক্ষপাত, উচ্চবর্ণের মধ্যে নানা প্রকার অন্যায় ও ব্যভিচার, নৈতিক অধঃপতনের চিত্র, অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনচিত্র ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এটি ছিল চর্যাপদ রচনার যুগে সামাজিক অবস্থার স্বরূপ। চর্যাপদে যে সমাজের চিত্র পাওয়া যায় তা একান্তভাবে বাংলা- বাঙালির নয়- সমগ্র পূর্ব ভারতের। চর্যাপদের যাদের চিত্র পাওয়া যায় তারা ধর্মক্ষেত্রে বৌদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবহেলিত বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। চর্যাপদের ভাষা, বস্তুবাচক শব্দ, উপমান-উপমিত পদ, পেশা, নদী, নৌকা, সাঁকো, ঘাট, পাটনী, মূষিক, তুলো, সোনা-রুপা, মদ, অবৈধ প্রেমকাহিনি, প্রতিবেশ, তৈজসপত্র, ঘরবাড়ি, ব্যবহারসামগ্রী প্রভৃতি সবটাই নিঃস্ব নির্জিত মানুষের বাস্তব জীবন-জীবিকা ও সমাজ থেকে গৃহীত। সমাজের নিচুস্তরের মানুষের কথা চর্যাপদে প্রতিফলিত হয়েছে। শবর মেয়েরা খোঁপায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জরের মালা পরতো। সে- সমাজ তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল- ডাকিনী, যোগিনী, কুহকিনী- এমনকি কামরূপ কাম্যাখ্যার নামও উপস্থাপিত হয়েছে চর্যাপদে। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বাস করতো গ্রামের প্রান্তে, পর্বত গাত্রে কিংবা টিলায়। ২৮ নং চর্যায় বলা হয়েছে এভাবে-

“উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী। মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী ॥” কোনো কোনো সমালোচক দেখাতে চেয়েছেন, “শ্রেণিদ্বন্দু, ধনী ও গরিবের সংঘর্ষ, উচ্চ জাতি ও নিম্ন জাতির বিরোধ ইত্যাদিই চর্যাপদের মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণা এবং এ শোষণ-শাসন, অন্যায়-অবিচার ক্রোধ, জিঘাংসা, বিক্ষোভ এসব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আদি বাংলা জনমানবের দিগ্দর্শনই চর্যাপদে প্রচ্ছন্ন।”

চর্যাগীতিগুলোর মধ্যে যে সমাজচিত্র ও বাস্তব জীবনযাত্রার আভাস ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাতে একদিকে সমাজের এ ভেদ- বিভেদ এবং বৈষম্যের চিত্র। অন্যদিকে দুঃখপূর্ণ দরিদ্র জীবনযাত্রার কখনো পূর্ণাঙ্গ কখনো বা খণ্ড বিচ্ছিন্ন উপাদান লক্ষ করা যায়। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অশান্তির চিত্র চর্যায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন-

“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥

বেঙ্গ সংসার বড়হিল জাঅ।

দুহিলু দুধু কি বেল্টে সামায় ॥”

চর্যাপদ যে সমাজচিত্রের ছবি প্রতিফলিত হয়েছ তা এক সময় মানুষের সামাজিক অবস্থানকেই প্রকাশ করে। চর্যাপদে যে জীবনধারায় চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে- তাতে উচ্চ জীবনধারার পরিচয় নেই। অধিকাংশ পদে অন্ত্যজশ্রেণির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধুর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘অসমিয়া, মগধ, উড়িষ্যা, বাংলা, কামরূপ- এসব অঞ্চলের বিস্তৃত পটভূমিকায় চর্যাপদের জীবনচিত্র অঙ্কিত হলে- চর্যাপদে নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং বাঙালির চিত্রই প্রতিনিধিত্ব করে।

নান্দনিক গুরুত্ব: বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের একটি নান্দনিক গুরুত্ব রয়েছে। আধ্যাত্মিকতার আড়ালে পদকর্তাগণ সেখানে মানবজীবনকেই আশ্রয় করেছেন এবং সাহিত্যকে পদবাচ্য করে তুলেছেন। চর্যাপদগুলোর প্রকাশ ভঙ্গিতে পরিমিতি বোধ আছে। এই পরিমিতি প্রকাশ ভঙ্গি শ্রেষ্ঠ শিল্পীরই লক্ষণ। চর্যাকারগণ মিতভাষণের মাধ্যমে অতি চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ জিনিসের ছবি তুলে ধরেছেন। যেমন-

“ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী।

দু’আন্তে চিখিল মাঝ ন থাহী।” [৫ নং চর্যাপদ]

প্রেম ও বেদনার চিত্র: চর্যাপদে প্রেম-বেদনা ও রসের কথা আছে, নীরস ধর্মতত্ত্বগুলোকে রসমণ্ডিত করে তোলার জন্য চর্যাকারগণ কাব্যকে আদি রসাত্মক করে তুলেছেন। তাই বহু চর্যাতে শৃঙ্গার রসাত্মক রূপক লক্ষ করা যায়। যেমন-

দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।

রাতি ভইলে কামরু জাই ।” [২নং চর্যাপদ]

চর্যাপদের ছন্দে সংস্কৃত পুজরুটিকা ছন্দের প্রভাব রয়েছে- তাছাড়া চর্যার ছন্দ মূলত মাত্রাপ্রধান ছন্দ। পুজরুটিকা ছন্দের প্রতি চরণে ষোল মাত্রার চরণে চার পর্ব। প্রতি পর্বে চার মাত্রা আবার শৌরসেনী প্রকৃত প্রভাবিত মাত্রা প্রধান পাদাকুলক ছন্দের সাথেও চর্যায় ছন্দের মিল রয়েছে। পরবর্তীকালে এগুলো অবলম্বন করেই বাংলা ছন্দের একাবলী, পয়ার ত্রিপদী ছাড়াও জয়দেবের গীতিগোবিন্দ কাব্যেও চর্যাপদের ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়। চর্যাপদ থেকে উদাহরণ-

ক. কমল কুলিশ ঘান্টি/ করহু বিআলী= ৮+৬

খ. তরঙ্গেতে হলিনাত/ খুর ন দীসই= ৮+৬

গ. অবণা পবণে কাহ্ন/ বিমণা ভইলা= ৮+৬

চর্যাপদে ভাষার ক্ষেত্রে অর্থালংকার ও শব্দালংকারের সুষম প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। চর্যার অলংকার ও অনুপ্রাসের ব্যবহার আমরা যত্রতত্র দেখতে পাই। অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী বিচার করলে দেখতে পাই এর রূপরস কাব্যময়। শাস্ত্রানুযায়ী অলংকার দুই শ্রেণির- ক. শব্দ অলংকার ও খ. অর্থালংকার। শব্দালংকারের মধ্যে চর্যাপদে সর্বাধিক অনুপ্রাস অলংকারের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। চর্যাপদে এর অভাব নেই। যেমন-

“ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা।

মণ পবণ বেণি করও কশালা।

চর্যায় বহু ধাঁধা ও প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ আছে। প্রবাদ প্রবচন ও ধাঁধায় চর্যার সাহিত্যিক মূল্য অসীম।

ক. ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’ [৬ নং চর্যা ]

খ. ‘দুহিলা দুধু কি বেল্টে সামাই।’ [৩৩ নং চর্যা]

চর্যাকারগণ উপমা রূপক সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের অতিপরিচিত পরিবেশ ও সাধারণ জীবন থেকে। নদী, নৌকা, তীর ও সাঁকু, ঘাট, পাটনী, সোনা, রুপা, কুটির, থালা-বাসন, গাছ, ফুল, তুলা এসব দ্রব্য চর্যাগীতিতে উপমা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।

চঞ্চল চীএ পইঠা কাল ।” [১ নং চর্যা]

চর্যাগীতিকারগণ সংস্কৃত কাব্যের রীতিতে পদ রচনা করেননি। তাঁদের সহজ সরল প্রচেষ্টা ও প্রকাশের ভঙ্গিতে নতুন ছন্দ জন্মলাভ করেছে। যুগযুগান্তরের সীমা পার হয়ে সে ছন্দ সুর আজও বাংলার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে। ভাবের কেতাবী বন্ধনকে ভেঙে কবিরা তাকে লোকায়িত করে তুলেছেন।

সাহিত্যে প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে চর্যাপদের গুরুত্ব: চর্যাগীতিকারগণ সংস্কৃত কাব্যের রীতিতে পদ রচনা করেননি। তাঁদের সহজ সরল প্রচেষ্টা ও প্রকাশের ভঙ্গিতে নতুন ছন্দ জন্মলাভ করেছে। যুগযুগান্তরের সীমা পার হয়ে সে ছন্দ ও সুর আজও বাংলার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে। ভাবের কেতাবী বন্ধনকে ভেঙে কবিরা তাকে লোকায়িত করে তুলেছেন। তাই জয়দেবকে সংস্কৃত রীতিনীতি বর্জন করে সম্পূর্ণ অভিনব কাব্য করতে এবং অলৌকিক বিষয়বস্তু অবলম্বন করে সম্পূর্ণ লৌকিক মনোভাব ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

চর্যার গানে বিভিন্ন প্রকার রাগের উল্লেখ রয়েছে। আমরা দ্বাদশ শতাব্দীতে ‘গীতি গোবিন্দ’ ভণিতার প্রয়োগ দেখি। তার পূর্বে কোনো কবি ভণিতার প্রয়োগ করেননি। তাছাড়া চর্যাপদের ন্যায় গীতি গোবিন্দের প্রত্যেক শ্লোকে মিল রয়েছে। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে ভণিতা ও রীতিতে জয়দেব তাঁর পূর্ববর্তী চর্যাপদ হতে পেয়েছিলেন। ‘গীতি গোবিন্দই’ বৈষ্ণব পদাবলির আদি উৎস। আবার বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ জয়দেবের কয়েকটি পদের অনুবাদ রয়েছে। তাছাড়া চণ্ডীদাসের কাব্যে প্রত্যেক পদের শীর্ষে রাগের উল্লেখ আছে এবং প্রত্যেক পদের শেষে ভণিতা আছে।

চর্যাপদ যে বৈষ্ণব পদাবলির আদি উৎস তা ও লক্ষ করা যেতে পারে চর্যাপদগুলোর গানে। আর এ গানের ধারা বৈষ্ণব পদাবলি হতে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পর্যন্ত চলে গেছে। চর্যাপদগুলো রূপকের আবরণে কেন্দ্র করে রচিত। আর এ গীতিকাগুলো ভণিতাযুক্ত। পরবর্তীকালে শুধু বৈষ্ণব পদাবলিই নয়, সমসাময়িক সমগ্র বাংলা কাব্যে চরণের শেষে অনুপ্রাস ও পদের শেষে ভণিতা ব্যবহৃত হয়েছে। তদুপরি ভাব, ভাষা, গান প্রভৃতি দিক থেকে পদাবলির সাথে চর্যাপদের নিবিড় সংযোগ রয়েছে।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, চর্যাপদে বৌদ্ধদের সাধনতত্ত্বের মর্মকথা বা তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণের যে প্রণালি বর্ণিত হয়েছে তা আবহমান বাংলার বা বাঙালির সামগ্রিক ও সামষ্টিক এবং সাংসারিক জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে। যে সাহিত্যে সমাজের সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠে তার সাহিত্যিক মূল্য প্রশ্নাতীত। তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এছাড়া চর্যাপদের সকল সাহিত্যের লক্ষণ বর্তমান, তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। এসব পদগুচ্ছে তৎকালীন সাধারণ (সময়ে সময়ে হীন অন্ত্যজ) বাঙালির প্রতিদিনের ধূলিমলিন জীবনচিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার টুকরো টুকরো রেখাচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন এবং আদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” একটি স্মরণীয় গ্রন্থ। এটি আবিষ্কৃত না হলে আদি যুগের বাংলাভাষা অজ্ঞাতই থেকে যেত। সুতরাং এর যেমন রয়েছে সাহিত্যিক মূল্য তেমন রয়েছে সামাজিক মূল্য আবার তেমনি রয়েছে ভাষাগত মূল্য। অর্থাৎ চর্যাপদই বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন ও প্রথম গ্রন্থ। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ একটি বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত।