সূচনা: আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরে এক সুপ্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে উৎকর্ষতার বিচারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। সেই প্রাচীন কালেই শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মিশরীয় সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়।

[1] স্থাপত্য-ভাস্কর্য: স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। মিশরীয় স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল অসংখ্য পিরামিড। পিরামিডগুলি ছিল সুন্দর এবং আকারে সুবিশাল। দেবতা আমন-এর উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মিত মন্দির ও আবুসিম্বেল-এর মন্দির মিশরের অপর উল্লেখযােগ্য স্থাপত্যকীর্তি। এ ছাড়া স্ফিংস-এর মূর্তি, বিভিন্ন ফ্যারাও, ক্রীতদাস ও শ্রমিকদের মূর্তি মিশরীয় ভাস্কর্যের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

[2] চিত্রকলা: চিত্রশিল্পে প্রাচীন মিশরে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল| বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য অট্টালিকার দেয়ালে নানান ধরনের রঙিন ছবি আঁকা হত। এসব চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল রাজা, রাজপরিবার, কর্মরত কারিগর, কৃষক, উৎসবের নাচগান প্রভৃতি দৃশ্য। রাজার ছবি খুব বড়াে করে এবং উজ্জ্বল রঙে আঁকা হত। তবে সাধারণ মানুষ ও ক্রীতদাসদের ছবি আঁকা হত ছােটো করে এবং অনুজ্জ্বল রঙ দিয়ে।

[3] লিপি: প্রাচীন মিশরের মানুষ বিভিন্ন চিত্রযুক্ত অক্ষরের সাহায্যে নিজেদের মনের কথা লিখে রাখত। এই চিত্রলিপি হায়রােগ্লিফিক লিপি নামে পরিচিত। গ্রিক ভাষায় এর অর্থ হল পবিত্র লিপি। মিশরীয়রা এর নাম দেয় ‘দেবলিপি’। তারা এই লিপির সাহায্যে নলখাগড়ার কলম দিয়ে প্যাপিরাস গাছের পাতায় বা পাথরে লিখত। তারা এই লিপিতে চিঠিপত্র লেখা, বই লেখা, রাজস্ব আদায় ও ব্যাবসার হিসাব রাখা, বর্ষপঞ্জী তৈরি করা প্রভৃতি বিভিন্ন কাজ করত।

[4] শিক্ষা: প্রাচীন মিশরে বিনা অর্থে বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযােগ ছিল। যাদের লেখাপড়ার তা থাকত, কেবলমাত্র তারাই বিদ্যালয়ে আসতে পারত। তবে মিশরে মূলত উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যে বিদ্যাচর্চার প্রচলন ছিল। সাধারণ পরিবারের খুব কম সংখ্যক ছেলেরাই বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযােগ পেলেও, মেয়েরা বিদ্যাচ্চার সুযােগ পেত না। মিশরে পুরোহিতরা মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতেন। লিপিকাররা মিশরীয় সমাজে শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিতেন।

[5] সাহিত্যচর্চা: প্রাচীন মিশরে গদ্যসাহিত্য ও কাব্যচর্চার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। বিভিন্ন মন্দির ও পিরামিডের গায়ে খােদিত। লিপিগুলি মিশরীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। মিশরীয়দের ধর্মীয় সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ‘মৃতদের পুস্তক। সমাহিত মৃতদেহের পাশে রাখা এসব সাহিত্যে জাদুবিদ্যা, শ্লোক, প্রার্থনা, ওষুধপত্র প্রভৃতির আলােচনা থাকত। এ ছাড়া ইখনাটন- এর রাজকীয় স্তুতি’, ‘মেমফাইট ড্রামা’, অসংখ্য ছড়া, কবিতা, কাহিনি প্রভৃতি মিশরীয় সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ।

[6] বিজ্ঞানচর্চা: প্রাচীন মিশরে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতি ঘটেছিল।

  • গণিতশাস্ত্র: প্রাচীন মিশরেই পারটিগণিত ও জ্যোমিতির উদ্ভব ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেই দেশের মানুষ দশের গুণিতকে গণনার কাজ করত। তারা যোগ, বিয়ােগ ও ভাগ করার পদ্ধতি, দশমিকের ব্যবহার, ক্ষেত্রফল ও ঘনফল নির্ণয়ের পদ্ধতি প্রভৃতি জানত।

  • জ্যোতির্বিদ্যা: মিশরের জ্যোতিষীরাই সর্বপ্রথম ১ বছরকে ৩৬৫ দিনে, ১ মাসকে ৩০ দিনে এবং ১ দিনকে ২৪ ঘণ্টায় ভাগ করেছিলেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪,২৩৬ অব্দে মিশরে পৃথিবীর প্রথম সৌরপঞ্জিকা আবিষ্কৃত হয়।

  • চিকিৎসাবিদ্যা: মিশরীয়রা নাড়ির স্পন্দন ও হৃৎপিণ্ডের তাৎপর্য, গাছপালার ভেষজ গুণাগুণ প্রভৃতির কথা জানত এবং শল্যচিকিৎসায় ব্রোঞ্জের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত। তারা চক্ষু, দন্ত, পাকস্থলী ও অন্ত্রের চিকিৎসায় যে পারদর্শী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

[7] ধর্মীয় জীবন: মিশরীয়রা বহু দেবতার আরাধনা করত এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও জীবজন্তুর পুজো করত। প্রথমদিকে সূর্যদেবতা ‘রা ছিল তাদের প্রধান দেবতা। পরবর্তীকালে বাস্তুদেবতা আমন মিশরের প্রধান দেবতার আসন লাভ করেন। এ ছাড়া মিশরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দেবতা ছিলেন উর্বরতার দেবতা আসিরিস, পাপপুণ্য বিচারের দেবী আইসিস, আকাশের দেবতা হােরাস প্রমুখ। এ ছাড়া মিশরে কুমির, গােরু, শেয়াল প্রভৃতি পশু ও বিভিন্ন গাছপালার পুজো করা হত।

[8] মমি: প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, মৃত্যুতেই। জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। মৃত্যুর পরও এক জীবন থাকে এবং মৃতদেহের মধ্যেই তার আত্মা বেঁচে থাকে। তাই মিশরীয়রা জীবদ্দশায় তাদের কবরের স্থান, কবরের পদ্ধতি প্রভৃতির পরিকল্পনা করে যেত। কোনাে ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও সুগন্ধি দ্রব্য মাখিয়ে ও বেশ কয়েকটি স্তরে সাদা কাপড় জড়িয়ে মৃতদেহটিকে সংরক্ষণ করে রাখত। এভাবে সংরক্ষণ করা মৃতদেহটিকে মমি বলা হত।

উপসংহার: প্রাচীন মিশরের উৎকৃষ্ট শিল্প-সংস্কৃতি‌ পরবর্তীকালে প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই সব দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে রােমে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে উৎকর্ষতা লক্ষ করা যায় তা অনেকাংশেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কাছে ঋণী বলে অনেকে মনে করেন।