সূচনা: ভারতীয় সমাজে বর্ণ ও জাতিব্যবস্থার সূত্রপাত প্রথম কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। মূলত বৈদিক আর্য সমাজে বর্ণ বা জাতি প্রথার প্রচলন লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, ভারতে আগমনের পূর্বেও আর্য সমাজে এই ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল।

[1] বিতর্ক: আর্যরা ভারতে আসার পূর্বে তাদের সমাজে বর্ণ ও জাতিব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, আর্যদের ভারতে আগমনকালে। বৈদিক সমাজে বর্ণব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে আর্যরা ভারতের অভ্যন্তরে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসবাস শুরু করলে স্থানীয় কৃষকায় অনার্যদের থেকে নিজেদের পৃথক রাখার উদ্দেশ্যে আর্য সমাজে বর্ণব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে। অন্যদিকে অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “ভারতে বর্ণ বৈষম্যের সূচনা, ঋগৃবৈদিক যুগের পূর্বে, আর্য ইতিহাসের ইন্দো-ইরানীয় পর্বে হয়েছিল।”

[2] বর্ণপ্রথার সূচনা: বৈদিক আর্যরা বৈবাহিক সম্পর্ক, সামাজিক আচার-আচরণ প্রভৃতি বিষয়গুলি নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়। আর্য সমাজে বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ চালু হয় এবং পেশাগত ভিত্তিতে আর্যদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়। এইভাবে আর্য সমাজে বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটে। তবে বৈদিক যুগে বর্ণভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটলেও তখন জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।

[3] বর্ণভেদের কারণ: বৈদিক সমাজে বর্ণপ্রথা চালু হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল- [1] গৌরবর্গ ও দীর্ঘকায় আর্যরা ভারতের কুষ়বর্গ ও খ্বকায় অনার্যদের কাছ থেকে নিজেদের পৃথক করার উদ্দেশ্যে আর্য সমাজে বর্ণভেদের প্রয়ােজন অনুভব করে। ঐতিহাসিক র্যাপসন বলেছেন যে, আর্য সমাজে বর্গ শব্দটি ‘গায়ের রং’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্যদের গৌরবর্ণ ও অনার্যদের কৃয়বর্ণের পার্থক্য বজায় রাখতে আর্যরা তাদের সমাজে বর্ণভেদ প্রথা চালু করে। [2] অনার্যদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংঘর্ষের মাধ্যমে আর্যরা ভারতে বসতির প্রসার ঘটায়। ফলে দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা একজন আর্য পুরুষের পক্ষে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। এই জন্য সমাজে বিভিন্ন পেশা ও পেশার ভিত্তিতে বর্ণপ্রথার সূচনা হয়।

[4] চতুর্বর্ণ প্রথা: আর্যদের পেশার ভিত্তিতে বৈদিক সমাজে চারটি পৃথক বর্ণের সূচনা হয়। ঋগবেদের দশম মণ্ডলের পুরুষসুক্তের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে, আদি পুরুষ ব্রহ্মার মুখমণ্ডল থেকে ব্রাহ্মণ, বাহুদ্বয় থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদেশ থেকে বৈশ্য ও চরণযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। এইভাবে আর্য সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি পৃথক বর্ণের সৃষ্টির কথা জানা যায়। আর্যরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিনটি বর্ণে বিভক্ত হয় এবং অনার্যরা শূদ্র বলে পরিচিত হয়। উৎপত্তি অনুসারে ব্রাহ্মণদের স্থান সবার ওপরে এবং শূদ্রদের স্থান সবার নীচে ছিল।

[5] চতুর্বর্ণের পেশা: আর্যদের চতুর্বর্ণব্যবস্থায় প্রতিটি বর্পের জন্য পৃথক পৃথক পেশা সুনির্দিষ্ট করা হয়। [1] বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল যাগযজ্ঞ, পূজার্চনা ও অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করা, [2] ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিল দেশ রক্ষা করা, [3] বৈশ্যদের কাজ ছিল ব্যাবসা বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালন করা এবং [4] শূদ্রদের কাজ ছিল উপরােক্ত তিন শ্রেণির সেবা করা। ভূত্য, কায়িক শ্রমজীবী ও কৃষকরা ছিল শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত।

[6] ঋগবৈদিক যুগে জাতি প্রথা: পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজে মানুষ আরও নতুন নতুন পেশার সঙ্গে যুক্ত হলে পূর্বতন চতুর্বর্ণ প্রথায় নানা সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন মিশ্রবর্ণের সৃষ্টি হয়। এই সময় থেকে বর্ণপ্রথা ক্রমে জাতিপ্রথার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগেই আর্য সমাজে জাতিভেদ প্রথার সূচনা হয়। কেন-না, কোনাে বর্ণের সন্তান জন্মগতভাবে তার পূর্বপুরুষের বই গ্রহণ করত। এইভাবে চারটি বর্ণ ক্রমে চারটি জাতিতে পরিণত হয়।

[7] যজুর্বেদের যুগে জাতি প্রথা: ড. এ এল বাসাম মনে করেন যে, ঋগ্‌বৈদিক যুগের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য থাকলেও জাতিবৈষম্য ছিল না। তবে বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথার মধ্যে যােগসূত্র বর্তমান এবং জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবে বর্ণ প্রথার যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে পূর্ব ভারতে আর্য-বসতির প্রসার ঘটতে থাকলে সমাজে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তখনই, অর্থাৎ যজুর্বেদের যুগে সমাজে জাতি প্রথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন।

[8] জাতি প্রথার উপাদান: পন্ডিতগণ মনে করেন যে, ঋবৈদিক সমাজে পেশাগত ভিত্তিতে যে বর্ণ প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল, পরবর্তীকালে তা থেকেই জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটে। ঐতিহাসিক ড. ডি ডি কোশাম্বী মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগের পরবর্তীকালে আর্য সমাজের বিভিন্ন উপজাতি প্রথা ভেঙে পড়তে থাকে এবং তখনই জাতি প্রথার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

উপসংহার: উৎপত্তির পর থেকে ভারতের জাতিপ্রথায় নানা বিবর্তন ঘটে। বৈদিক যুগে চারটি বর্ণ চারটি জাতিতে পরিণত হয়। বৈদিক সমাজের বাইরে ‘ব্রাত্য ও ‘নিষাদ নামে দুটি জাতির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুজে জাতি প্রথা সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে এবং বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠে। মেগাস্থিনিস মৌর্যযুগে ভারতে সাতটি জাতির উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল—

  • [1] দার্শনিক,
  • [2] কৃষক,
  • [3] পশুপালক ও শিকারী,
  • [4] কারিগর ও শিল্পী,
  • [5] সৈনিক,
  • [6] গুপ্তচর বা পরিদর্শক,
  • [7] মন্ত্রণাদাতা। পরবর্তীকালে আরও নতুন নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে।