সূচনা: প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর মর্যাদার উন্নতি বা অবনতি যাই ঘটুক না কেন, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগে ভারতীয় নারীর শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি মােটামুটিভাবে অব্যাহত ছিল। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের ভারতের নারীশিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
[1] ঋগবৈদিক যুগ: ঋগ্বৈদিক যুগে নারীশিক্ষারও যথেষ্ট সুযােগ ছিল। ধর্মচর্চা, চরিত্রগঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রভৃতি ছিল এই যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্য। এযুগে মমতা, ঘােষা, লােপামুদ্রা, বিশ্ববারা, বিশাখা প্রমুখ বিদুষী নারীর কথা জানা যায়। এযুগের নারীরা বেদের অনেক স্তোত্রও রচনা করেছিলেন।
[2] পরবর্তী বৈদিকযুগ: সামগ্রিকভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও নারীশিক্ষা ভালােভাবেই চালু ছিল। এযুগে কোনাে কোনাে নারী উচ্চশিক্ষায় অগ্রণী ছিলেন। এযুগের যে সকল নারী বিবাহের আগে পর্যন্ত বিদ্যাচর্চা করতেন, তাদের সদ্যোদ্বাহা এবং যারা আজীবন অবিবাহিত থেকে ধর্ম ও দর্শন। চর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন, তাঁদের ‘ব্রহ্মবাদিনী বলা হত। এ যুগের বিখ্যাত বিদুষী নারী ছিলেন গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ।
[3] মহাকাব্য ও প্রতিবাদী ধর্মের যুগ: মহাকাব্যের যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও এযুগের বহু নারী বিদ্যাচর্চা করতেন। মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পণ্ডিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এযুগের অনেক নারী সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করতেন। বিনয়পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের অক্ষরজ্ঞান অর্জনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এযুগের নারীরা সংস্কৃত কাব্য ও নাটকও রচনা করেছেন। ভিক্ষুণীদের রচিত সংগীত ‘থেরীগাথা গ্রন্থে সংকলিত আছে। চন্দনা, জয়ন্তী প্রমুখ ছিলেন এযুগের উচ্চশিক্ষিতা নারী।
[4] মৌর্যযুগ: মৌর্যযুগে শিক্ষিত নারীরা রাজকার্যেও অংশ নিতেন। সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্যে এমন বহু নারীর উল্লেখ আছে যারা লিখতে, পড়তে ও সংগীত রচনা করতে পারতেন। কোনাে কোনাে নারী চিত্রশিল্পেও দক্ষ ছিলেন।
[5] মৌর্য-পরবর্তী যুগ: মৌর্য-পরবর্তী যুগে অনেক মহিলা উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন। পাণিনি বলেছেন যে, এই সময় নারীরা বেদ অধ্যয়ন করতেন। কাত্যায়ণ তাঁর কার্তিক গ্রন্থে অধ্যাপিকা বােঝাতে উপাধ্যায়া বা ‘উপাধ্যায়ী” শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই সময়ে অনেক অভিজাত মহিলা বৈদিক স্তোত্র, সংস্কৃত কাব্য ও নাটক রচনা করতেন।
[6] গুপ্তযুগ: বিভিন্ন সাহিত্য থেকে গুপ্তযুগের নারীরা, ইতিহাস ও কাব্যচর্চা করত বলে সমকালীন সাহিত্য থেকে জানা যায়। শাসম্ত্রজ্ঞান এযুগের নারীর বােধবুদ্ধিকে তীক্ষ করত বলে ব্যাৎসায়ন উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, আদর্শ পত্নীকে সুশিক্ষিতা হতে হবে এবং তাঁকে সাংসারিক আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে। গুপ্তযুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার মতাে কাশ্মীর, উড়িষ্যা ও অন্ত্রের নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতেন। অবশ্য এযুগে সাধারণ দরিদ্র নারীদের শিক্ষার সুযােগ বিশেষ ছিল না।
[7] হর্ষবর্ধনের আমল: হর্ষবর্ধনের আমলে চিত্রকলা, নৃত্য, সংগীত প্রভৃতি শিক্ষার প্রচলন ছিল। হর্ষবর্ধনের ভগ্নি রাজ্যশ্রী নিয়মিত সংগীত, নৃত্য ও অন্যান্য কলার চর্চা করতেন বলে বানভট্ট উল্লেখ করেছেন। নারীরা সাধারণত পিতৃগৃহেই শিক্ষালাভ করত।
উপসংহার: ঋগবৈদিক যুগে নারীরা যে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তা পরবর্তী বিভিন্ন যুগে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। নারীসমাজে শিক্ষাগ্রহণের ধারা অব্যহত থাকলেও মর্যাদায় তারা পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেনি। তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ নারীরা বিশেষত দরিদ্র ঘরের নারীরা শিক্ষাগ্রহণের সুযােগ থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছিল।
Leave a comment