প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন যুগে কৃষির পাশাপাশি বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিভিন্ন কুটিরশিল্প, কারিগরি শিল্প প্রভৃতি। প্রধানত কৃষিপণ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রাচীনযুগে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল।
[1] হরপ্পা সভ্যতার যুগ: হরপ্পা সভ্যতার মানুষ মূলত পাথর, মাটি, তামা, সিসা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম করত।
[2] বৈদিক যুগ: ঋগবৈদিক যুগে সীমিত ক্ষেত্রে কিছু শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। বৈদিক সাহিত্যসম্ভারে কামার, কুমার, চর্মকার, ছুতাের, স্বর্ণশিল্পী, অস্ত্র নির্মাতা প্রভৃতি শিল্পী কারিগরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
[3] প্রাক-মৌর্য ও মৌর্যযুগ: প্রাক্-মৌর্য ও মৌর্যযুগে বয়ন শিল্প, গৃহস্থালির ছােটোখাটো জিনিস তৈরি, লৌহ ও অন্যান্য ধাতুর শিল্প প্রভৃতির বিকাশ ঘটে। পাটলিপুত্রের শিল্পজাত বস্তু তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্যে একটি পৃথক বাের্ড ছিল বলে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন।
[4] মৌর্য-পরবর্তী যুগ: মৌর্য-পরবর্তী কুষাণ ও সাতবাহন যুগে লৌহশিল্প, অলংকার শিল্প, কাষ্ঠশিল্প, দন্তশিল্প, দারুশিল্প প্রভৃতির অগ্রগতি ঘটে।
[5] গুপ্তযুগ: গুপ্তযুগেও শিল্পের পূর্বেকার ধারা অব্যাহত থাকে। এযুগে ধাতুশিল্প, মণি-মুক্তার শিল্প, অলংকার শিল্প, বয়ন শিল্প, চর্মশিল্প প্রভৃতির বিকাশ ঘটে। এযুগে শিল্পীদের গিল্ডগুলি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রাচীন ভারতে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতে বাণিজ্যের বিকাশের প্রধান কারণগুলি ছিল一
[1] কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি: প্রাচীন ভারতে কৃষি উৎপাদনে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। কৃষকদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন বাইরে রপ্তানি করে বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছিল।
[2] বৈদেশিক সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ: সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই মিশরীয়, সুমেরীয়, মেসােপটেমীয় ও অন্যান্য বৈদেশিক সভ্যতার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এর ফলে ভারতের পণ্য বিদেশে রপ্তানি এবং বিদেশের পণ্য ভারতে আমদানির ধারা প্রাচীনকালেই গড়ে ওঠে।
[3] রাজানুকূল্য: বাণিজ্য থেকে যথেষ্ট শুল্ক আসত বলে প্রাচীন যুগের রাজারা ব্যাবসাবাণিজ্যের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করতেন। পথে বণিক চৌকি বা বাণিজ্য পণ্যের চলাচলে সরকারি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত। যােগাযােগ ব্যবস্থারও উন্নতি করা হয়।
[4] নগরের বিকাশ: অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন ও আদিমধ্যযুগে ভারতে নগর ও বন্দরের বিকাশ ঘটে। ক্রমে এইসব বন্দরের বাণিজ্যিক ব্যস্ততা বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রা-অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটে। দক্ষিণ ভারতে ‘নগরগুলি অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
[5] গিল্ডের প্রতিষ্ঠা: প্রাচীন ও আদিমধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত গিল্ডগুলি শিল্প বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দান, পণ্য ও শ্রমিকের যথাযথ জোগান প্রভৃতির মাধ্যমে বাণিজ্যের ধারাবাহিক অগ্রগতি বজায় রেখেছিল।
[6] গ্রামীণ হাট ও মেলার আয়োজন: গ্রামীণ হাট ও মেলাগুলি প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের সহায়ক ছিল। এখানে স্থানীয় পণ্যসামগ্রী জড়াে করা হত এবং এখান থেকে ব্যবসায়ীরা তা বাইরে রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফা লাভ করত।
উপসংহার: প্রাচীন যুগে ভারতে শিল্প ও বহির্বাণিজ্যের সূত্র ধরে বহু বিদেশি এদেশে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভারতের জাতিভেদ-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে এদের ঠাই দেওয়া সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সমাজে এইসব বিদেশি এবং এদেশীয় নিপীড়িত নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে নৈকট্য বৃদ্ধি পায়।
Leave a comment