পৃথিবীর সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলির সমসাময়িক ভারতের হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে এদেশে নগরজীবনের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তী বিভিন্ন যুগে ভারতে নগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। আবার মধ্যযুগের ইউরােপে নগরজীবনের প্রসার সেখানকার সমাজ ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নীচে ভারত ও ইউরোপের নগরায়ণের একটি তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
ভারতের বাণিজ্য
-
ভারতের নগরায়ণের ইতিহাস ইউরােপের তুলনায় বস্তু প্রাচীন। ভারতের সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার যুগে প্রথম পর্যায়ের, ষােড়শ মহাজনপদের যুগ থেকে প্রাকগুপ্তযুগে দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং সুলতানি যুগে তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ ঘটে।
-
ভারতে নগরায়ণের ফলে ব্যাবসাবাণিজ্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় নগরগুলি ব্যাবসাবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বাণিজ্য পণ্যের লেনদেন ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে নগরপুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
-
প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব কখনােই মধ্যযুগের ইউরােপের সামন্ততন্ত্রের মতা ব্যাপক ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতে নগরায়ণের ক্ষেত্রে সামন্তপ্রথার প্রত্যক্ষ কোনাে ভূমিকা ছিল না।
-
ভারতের নগরগুলি সামরিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ, সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন অভিজাত পরিবার ভারতের নগরগুলিতে বসবাস করত। তাই এখানে জীবনযাত্রার মান ইউরােপের নগরগুলির মতাে এতটা নিম্ন ছিল না। তবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কিছুটা ছিল।
-
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত নগরগুলির নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ ও সামরিক তৎপরতার বিশেষ প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত নগরগুলির ক্ষেত্রে এসবের প্রয়ােজন হত না। এখানকার স্থানীয় প্রশাসনই নগরের শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
ইউরােপের বাণিজ্য
-
ইউরােপে প্রাচীনযুগে নগরায়ণের গতি ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। ইউরােপে খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে সেখানে ব্যাপক মাত্রায় নগরায়ণ ঘটেছিল। এই সময়ে ইউরােপের নগরায়ণের প্রসারের ঘটনা নগর-বিপ্লব নামে পরিচিত।
-
ইউরােপের নগরায়ণ প্রক্রিয়াও সেখানকার ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। বণিকদের বাসস্থান, পণ্য লেনদেনের কেন্দ্র প্রভৃতি বিষয়ে নগরগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
-
মধ্যযুগের ইউরােপে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ম্যানর-ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছিল। পরে সেখানে সামন্তপ্রথার অবক্ষয় শুরু হলে সেখানে নগরায়ণের সুবিধা হয়েছিল।
-
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেখানকার সামন্তপ্রভু ও অন্যান্য স্তরের অভিজাতরা প্রধানত গ্রামেই বসবাস করত। ইউরােপের নগরগুলিতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা খুবই নিম্নমানের ছিল। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও ছিল খুবই তীব্র।
-
বহিরাগত বিভিন্ন বর্বর জাতির আক্রমণ ইউরোপের নগরগুলির শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটাত। বর্বর জাতিগুলির এই আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ইউরােপের বহু নগরে প্রাসাদ-দুর্গ, দুর্গপ্রাচীর, নগর-প্রাচীর, সেনানিবাস, আস্তাবল প্রভৃতি থাকত।
Leave a comment