ইতিহাসের চালিকাশক্তি হল তার উপাদান বা তথ্যসূত্র। ইতিহাসের মুখ্য বিষয় হল মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের বিবরণ। কিন্তু ইতিহাসকার নিজের মনগড়া কাহিনী দিয়ে সেই ক্রমবিকাশকে উপস্থাপন করতে পারেন না। ঐতিহাসিককে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য এক বা একাধিক তথ্য দ্বারা তাঁর বক্তব্যকে সমর্থিত বা প্রশমিত করতে হয়। এই তথ্য এবং তথ্যসূত্রকেই বলা হয় ইতিহাসের উপাদান বা প্রাণভোমরা। উপযুক্ত আকর তথ্য (Basic Source) দ্বারা সমর্থিত না-হলে অতীত সংক্রান্ত কোন মতামত বা সিদ্ধান্ত ইতিহাসচর্চারূপে গণ্য হয় না। এই কারণে প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনার কাজ বেশ কঠিন। কেবল প্রাচীন ভারত নয়, কমবেশী পৃথিবীর সব দেশ সম্পর্কেই এ-কথা সত্য। অথচ একাদশ শতকের বিশিষ্ট আরবী পণ্ডিত আলবেরুণী কেবল ভারতীয়দের ‘ইতিহাসবিমুখ’ বলে নিন্দা করেছেন। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ ভারতীয়দের ইতিহাসবিমুখতার দৃষ্টান্ত তুলে উপহাস করেছেন। কর্নেল টড্ (Tod)-এর মতে, ভারতীয়দের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজে উদাসীনতা হতাশাজনক। ফ্লীট (Fleet) একধাপ এগিয়ে লিখেছেন যে, প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যে ইতিহাসবোধের এতটাই অভাব ছিল যে, তারা বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস রচনা করতে ব্যর্থ ছিলেন। আবার ঐতিহাসিক কীথ (A. B. Keith)-এর অভিমত হল যে, খ্রিষ্টের জন্মের আগে ভারতে বড় আকারের কোন বিদেশী আক্রমণ ঘটেনি। তাই ভারতীয়দের মধ্যে এমন কোন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেনি, যা তাদের ইতিহাস রচনার কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম।

একথা সত্য যে, প্রয়োজনের তুলনায় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের তথ্যসূত্র অপ্রতুল। তথ্যের অভাবে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজও বেশ শক্ত। কিন্তু এ-কারণে প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতদের ইতিহাসবিমুখ বলা সঠিক নয়। বহু বিষয় যেগুলি তাঁদের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ও রক্ষণযোগ্য মনে হয়েছে সেগুলি তাঁরা অবশ্যই সংরক্ষণ করেছেন। তবে সন, তারিখ উল্লেখ সহ বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস রচনার অভিজ্ঞতা তখনও হয়নি, একথা সত্য। প্রাচীন রাজাদের সভাকবিরা রাজকীয় কীর্তিকাহিনী লিপিবদ্ধ করতেন। তাম্রশাসন বা প্রস্তর ফলকে রাজ্য জয়, শাসন বিধিসমূহ, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি উৎকীর্ণ করা হত। রাজা-রাজড়ার জীবনকাহিনী বা ধর্মপুরুষদের উপদেশাবলী লিপিবদ্ধ করে প্রচার করার রেওয়াজ ছিল। এগুলিকে আক্ষরিক অর্থে ‘ইতিহাস’ হয়ত বলা যাবে না, কিন্তু এই সকল রচনার মধ্য থেকে ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। ভারতে প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের শেষ দিকে দ্বাদশ শতকে রচিত কল্‌হন-এর ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থকে ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হয়। স্বভাবতই ঐ সময়কাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজ কিছুটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আনুসাঙ্গিক নানা সূত্র থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার কাজ চলছে। এই সকল ঐতিহাসিক উৎসকে আমরা দু’টি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি, যথা—অলিখিত উৎস ও লিখিত উৎস। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসকে যেমন— স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মৃৎপাত্র, ধ্বংসাবশেষ, লেখ, মুদ্রা ইত্যাদি অলিখিত উৎস বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া চিত্রকলা, সম্প্রতি ব্যবহৃত কার্বন-১৪ পদ্ধতিকেও অলিখিত উৎসের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। অন্যদিকে আছে নানা চরিত্রের লিখিত উৎস। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বহু ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য পাওয়া যায় যেগুলিকে সাবধানতার সাথে বিশ্লেষণ করে প্রাচীনকালের বহু তথ্য আহরণ করা সম্ভব। অনুরূপভাবে অতি প্রাচীন কাল থেকে নানারকম কিংবদন্তী, লোককথা, চারণনীতি, লোক মুখে যুগ যুগ ধরে প্রচারিত উপাখ্যান ইত্যাদিকে ‘মৌখিক ইতিহাস’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস:

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল নির্দিষ্ট কালানুক্রমের ভিত্তিতে লিখিত ইতিহাসমূলক গ্রন্থের অভাব। এই কারণে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য ইতিহাসকারকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর বেশী নির্ভর করতে হয়। বহু বিচিত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে সহায়তা করে। যেমন— উৎখনন থেকে প্রাপ্ত পুরাবস্তু, লেখ, মুদ্রা, কারিগরি ও শিল্পকর্ম ইত্যাদি।

ইতিহাসচর্চার কাজে পুরাবস্তু :

প্রাচীন ইতিহাসচর্চার কাজে প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত পুরাবস্তুর গুরুত্ব অপরিসীম। মানবসভ্যতার আদিতম পর্বে মানুষের অক্ষর জ্ঞান বা লিখন পদ্ধতি জানা ছিল না। স্বভাবতই আদিম পর্বের লিখিত ইতিহাস ছিল না। সেই প্রাগৈতিহাসিক পর্বের সমাজজীবন বা সভ্যতার ক্রমবিকাশ জানার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান হল পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী। বিচক্ষণ প্রত্নতাত্ত্বিক তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি থেকে প্রাচীন সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিশিষ্ট প্রত্নক্ষেত্রগুলি সনাক্ত করতে সক্ষম হন। অতঃপর ওপর-নিচে (Vertical) এবং পাশাপাশি (horizontal) উৎখননের সাহায্যে প্রাচীন সভ্যতার চরিত্র অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়। ওপর-নীচে খনন কার্য থেকে সভ্যতাটির সময় কাল ক্রমবিকাশের নানা পর্যায় ইত্যাদি নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়। আবার পাশাপাশি খনন কার্য চালিয়ে অনুরূপ সভ্যতার বিস্তৃতি, বসতবাড়ির বৈশিষ্ট্য, পথঘাট, জলনিকাশী বন্দোবস্ত ইত্যাদি জানা যায়। হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ের উৎখনন থেকেই অনুমিত হয় যে, সভ্যতাটির ক্রম-অবক্ষয় ঘটেছিল। আবার বর্তমান পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে রাজস্থান, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অংশে এই সভ্যতার অস্তিত্বের তথ্যও খননকাল থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। হরপ্পীয় সিলমোহর পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়াতে। এগুলিকে উভয় সভ্যতার বাণিজ্য সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রাকৃতি সিলমোহরগুলি ব্যক্তির নাম এবং বৃহদাকৃতি সিলমোহরগুলি বাণিজ্য পণ্যের নাম এবং গন্তব্যস্থলের নির্দেশিকা বলেও অনেকের অভিমত। হরপ্পীয় সিলমোহরে ধর্মভাবনার সূক্ষ্ম আভাষও পাওয়া যায়। তবে বাণিজ্যিক দলিল হিসেবে এদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

খননকার্য থেকে প্রাপ্ত ইমারতের আকৃতি থেকে সামাজিক স্তরভেদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উঁচু এলাকায় নির্মিত এবং বৃহদাকার অট্টালিকার পাশাপাশি দুই কক্ষ বিশিষ্ট ছোট ছোট গৃহের অস্তিত্ব হরপ্পীয় সমাজে ধনী ও মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষের সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। উৎখননে প্রাপ্ত অসংখ্য দেবী মাতৃকার মূর্তি থেকে সমাজে নারী উচ্চস্থান সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ থেকেই খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে হরপ্পার নগর সভ্যতা থেকে স্বতন্ত্র সভ্যতার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। এই প্রত্নবস্তুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র’ (Painted Gray Ware)। এখানে মাটির থালা, বাটি, ঘটি এবং চাল, গম জাতীয় ফসল আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত এই গ্রামীন সংস্কৃতির প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ইঁটের ব্যবহার ছিল না। ঝুপড়ি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত খুঁটির কাঠামো পাওয়া গেছে। আবার অত্রঞ্ঝিখেড়া অঞ্চলে বল্লম ও তীর জাতীয় লৌহ হাতিয়ার পাওয়া গেছে। ড. রামশরণ শর্মার মতে, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র ব্যবহারকারী মানুষ শিকার ও যুদ্ধ দ্বারা জীবন নির্বাহ করত। এখানে সামাজিক সাম্য ছিল বলেই ড. শর্মার অভিমত।

অনুরূপভাবে পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের নানাস্থানে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে মৃত্তিকা নির্মিত উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ পাত্র পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় এগুলিকে ‘উত্তরের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র (Northern Black Polished Ware সংক্ষেপে NBPW) বলা হয়। ড. শর্মা এটিকেই উত্তর ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের সূচনা বলে চিহ্নিত করেছেন। এর পাশাপাশি সাধারণমানের লাল ও কালো রঙের পাত্রও ব্যবহৃত হত। সম্ভবত উজ্জ্বল মৃৎপাত্র ধনী লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই পর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরায়ণের সূচনা হয় বলে অনুমান। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে ২০০ অব্দের মধ্যে কৌশাম্বী, বৈশাখি, চম্পা প্রভৃতি অঞ্চলে ইঁটের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়েছিল।