প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে প্রত্নতাত্ত্বিক নানা উপাদানের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল লেখমালা। স্থায়ী কোন বস্তু যেমন পাথর, ধাতবখণ্ড, পোড়ামাটি, কাষ্ঠখণ্ড ইত্যাদির ওপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় লিখিত তথ্যসূত্রকে লেখ বা লেখমালা বলা হয়। পাথর ও তামার ওপর উৎকীর্ণ লেখই সংখ্যায় বেশী। সিলমোহরের ওপর উৎকীর্ণ ক্ষুদ্র লেখগুলিই সম্ভবত ভারতের প্রাচীনতম লেখর নিদর্শন। ইতিহাসের সূত্র হিসেবে প্রাথমিকভাবে দু’ধরনের লেখমালার উল্লেখ করা যায়—দেশীয় ও বিদেশীয়। ভারতীয় উপমহাদেশের নানাস্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য লেখমালাকে প্রথম ভাগের মধ্যে ফেলা হয়। অন্যদিকে বিদেশের ভূখণ্ডে প্রাপ্ত কিন্তু ভারতবর্ষ সংক্রান্ত তথ্য উৎকীর্ণ আছে এমন লেখগুলিকে বিদেশীয় লেখ বলা হয়। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ মনে করেন যে, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রাচীন ভারতের অবদান অসীম। কিন্তু ঐ যুগের কালানুক্রমিক কোন লিখিত ইতিহাস নেই। তাই সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আমাদের অলিখিত উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। নিঃসন্দেহে এই কাজে সবচেয়ে বেশী সহায়ক হয় লেখমালা। লেখমালার বিবরণ সমসাময়িক এবং স্বতঃস্ফুর্ত। স্থায়ী বস্তুর ওপর (পাথর, ধাতু ইত্যাদি) এগুলি খোদাই থাকার কারণে ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যায় না। অবশ্য বহু লেখতে সন, তারিখের উল্লেখ নেই। তবে পুরালেখ বিদ্যা (প্যালিওগ্রাফি)র সাহায্যে নির্দিষ্ট লিপির সময়কাল নির্ধারণ করে উক্ত লেখ বা লেখমালার আনুমানিক সময়কাল নির্দিষ্ট করা সম্ভব। ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে লেখমালার বক্তব্য তৎকালীন লিখিত পুঁথি বা গ্রন্থের তুলনায় অধিক নির্ভরযোগ্য। কারণ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য বা কাব্যের রচয়িতারা কালানুক্রম অনুসরণের তাগিদ অনুভব করেননি। বহু ক্ষেত্রেই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাধন্য লেখকরা স্বাধীন বা নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশ করতে অপারক ছিলেন। তাঁদের রচনায় আতিশয্য, আবেগ এবং প্রক্ষিপ্তকরণের সম্ভাবনা প্রবল ছিল। স্বভাবতই যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রাচীন সাহিত্যকর্মগুলি নির্ভরযোগ্য নয়। তবে কোনভাবেই লেখমালা ও সাহিত্যকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী -বলা যাবে না। বরং এদের পরস্পরের সম্পূরক বলাই ভাল। লিখিত বিবরণের তথ্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সহযোগে দৃঢ় হতে পারে। বিপরীত দিক থেকেও এটি সত্য। বৈদিক সাহিত্যকে সাহিত্য থেকে ইতিহাসে উত্তীর্ণ করতে গেলে তা প্রত্নতত্ত্বের সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের বহু তথ্য শুধুমাত্র লেখমালার সূত্রেই পাওয়া গেছে। সমুদ্রগুপ্তের সামরিক কর্মসূচী সমসাময়িক কোন সাহিত্যে উল্লেখ নেই। কেবল এলাহাবাদ লেখ থেকেই সেই বিবরণ পাওয়া যায়। একইভাবে চোলরাজ রাজেন্দ্র চোলের সামুদ্রিক অভিযানের বিবরণ লেখমালা থেকেই জানা যায়। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও মনে করা হত যে, রাজকীয় গুপ্তবংশের শাসন স্কন্দগুপ্তের পরেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ‘এরান লেখ’, ১৯১৯-এ ‘দামোদরপুর লেখ’ এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দাতে প্রাপ্ত প্রত্নলেখর সাহায্যে বুধগুপ্তকে গুপ্ত রাজবংশের উত্তরাধিকারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য যে, লিখিত বিবরণীতে এই রাজার নামোল্লেখ পাওয়া যায় না।
ভারতে লিপি উৎকীর্ণ করার প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত এখনো পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে। তবে হরপ্পা সভ্যতায় ব্যবহৃত লিপির পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয় নি। পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এমন লেখমালার মধ্যে প্রাচীনতম হল মৌর্য সম্রাট অশোকের লেখ। এগুলির অধিকাংশই ব্রাহ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ। তবে সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় খরোষ্ঠী লিপির প্রয়োগ দেখা যায়। খুব সামান্য লেখতে অশোক আরমাইকা ও গ্রিক লিপিও ব্যবহার করেছেন। যে সকল স্তম্ভের ওপর অশোক লিপি উৎকীর্ণ করেছেন সেগুলি সবই বেলে পাথরে নির্মিত। মির্জাপুর জেলার অন্তর্গত চুনার থেকে এগুলিকে বহন করে দেশের নানা প্রান্তে প্রোথিত করা হয়েছে। সাধারণভাবে তাঁর লেখগুলির অবস্থান ব্যস্ত বাণিজ্যপথের ওপর দেখা যায়। সম্ভবত অধিক সংখ্যক পথচারীর গোচরে আনার জন্য এই সকল এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্য এবং বিশেষ করে অশোকের শাসনকালের ইতিহাসচর্চার জন্য এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। এই সকল রাজকীয় লেখ ‘রাজাজ্ঞা’ রূপেই প্রচারিত হয়েছে। এখানে তিনি সরাসরি নিজের নামোল্লেখ করেননি। উত্তমপুরুষে বিবৃত এই সকল লেখর প্রচারক জনৈক “দেবানাম্পিয়স্ পিয়দর্শী’। এই উপাধিকারী রাজা ও অশোক যে অভিন্নব্যক্তি তার প্রমাণ পাওয়া যায় মাম্ফি গৌণ গিরি শাসনে যেখানে ভঙ্গুর অবস্থায় ‘দেবানামপিয়স্ অশোকম্’ শব্দবন্ধটি আছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান, অশোকের কলিঙ্গ বিজয়, অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ নীতি, মৌর্যযুগে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনরীতি ইত্যাদি বোঝার জন্য অশোকের লেখগুলির গুরত্ব অপরিহার্য। অশোকের ধর্মীয় লেখগুলি থেকে প্রজাদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনে সম্রাটের আন্তরিক প্রয়াসের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর লেখগুলিতে পিতা-মাতা, ভ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রমুখকে সম্মান প্রদর্শন এবং দাস তথা ভৃত্যদের প্রতি সদয় ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিশ্বাসীদের মধ্যে সহনশীল সম্পর্ক রক্ষার কাজে মৌর্য সম্রাটের আন্তরিকতার বিষয়টি কেবল লেখমালা থেকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
মৌর্য্যোত্তর পর্বে লেখ উৎকীর্ণ করার ধারা অব্যাহত ছিল। এই সময়ের অধিকাংশ লেখর ভাষা প্রাকৃত। মৌর্য্যোত্তর ও গুপ্তযুগের লেখগুলিকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, (১) বেসরকারী বা ব্যক্তিগত লেখ এবং (২) সরকারী বা রাজকীয় লেখ। ব্যক্তিগত লেখগুলির অধিকাংশই দানপত্র। সাঁচী, ভারহূত (মধ্যভারত), মথুরা (গঙ্গা-যমুনা দোয়াব), কার্লে, নাসিক (দাক্ষিণাত্য), তক্ষশিলা (উঃ পঃ সীমান্ত) প্রভৃতি অঞ্চলে বহু দানলেখ পাওয়া গেছে। রাজকীয় দানলেখর সংখ্যা খুবই কম। যেমন বিখ্যাত সাঁচীস্তূপের চতুস্পার্শে যে পাথরের বেষ্টনী আছে তাতে ছয় শতাধিক দানের দলিল আছে, যার মধ্যে রাজকীয় দানলেখ মাত্র তিনটি এবং দানকৃত অর্থের পরিমানও নগণ্য। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উদ্দেশ্যে অধিকাংশ দানলেখ সম্পাদিত হয়েছে। এগুলি থেকে দাতার নাম, দান গ্রহীতার বর্ণনা, দানসামগ্রীর প্রকৃতি ও পরিমাণ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কিছু ব্যক্তিগত লেখতে দানগ্রহীতা হিসেবে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের নামোল্লেখ আছে। এ-থেকে অনুমিত হয় যে, সংসার ত্যাগ করে স্ত্রীলোকদের বৌদ্ধসংঘে যোগদানের ঘটনা ঘটত। আবার দাতা হিসেবেও বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের নাম পাওয়া যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের নামে দান করার মত পর্যাপ্ত সম্পদ এই ধরনের ভিক্ষুণীদের হাতে থাকত।
মৌর্য্যোত্তর লেখ থেকে সে-কালে শিল্প, বাণিজ্য ও কারিগরী বৃত্তির ক্রমপ্রসারের বিবরণ জানা যায়। লেখমালার আলোকে ‘গিল্ড’ (guild) জাতীয় শ্রেণী, সংঘ, গণ ইত্যাদি সংগঠনের আর্থ-সামাজিক কাজকর্ম সম্পর্কে জানা যায়। কারিগরী উৎপাদন এবং তাকে বাজারজাত করার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের কাজে ‘শ্রেণী’ জাতীয় সংগঠনগুলির ভূমিকার বিবরণ লেখমালা থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব। নাসিক, মথুরা ইত্যাদি লেখমালার অবদান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। প্রাচীন ভারতে মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা, শ্রেণী সংগঠনগুলির ব্যাঙ্কিং (Banking) কার্যকলাপ লেখমালা থেকেই জানা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নিরন্তর স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনাগমনের ফলে বর্ণব্যবস্থার বন্ধন যে শিথিল হয়েছিল, এমন ধারণার প্রামাণ্য স্বীকৃতি লেখমালার সাক্ষ্য থেকে পাওয়া যায়।
মৌর্য্যোত্তর যুগে রাজাদের প্রশংসামণ্ডিত একধরনের লেখমালা পাওয়া যায়। কাব্যিক ছন্দে মূলত সভাকবিদের রচিত এইসব লেখকে ‘প্রশস্তি’ বলে অভিহিত করা হয়। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা প্রশস্তি সম্ভবত এই ধরনের প্রাচীনতম রচনা। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে প্রাকৃত ভাষায় রচিত এই প্রশস্তি বর্তমান ভুবনেশ্বরের কাছে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, খারবেলের কীর্তিকাহিনী এই লেখমালা ব্যতিত অন্য কোন সূত্রে পাওয়া যায়নি। খারবেলের ব্যক্তি-চরিত্র, শাসক হিসেবে কৃতিত্ব ইত্যাদি সবকিছুই এতে স্থান পেয়েছে। কলিঙ্গরাজ যে যথেষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি এবং প্রজাদরদী ছিলেন, এ তথ্য হাতিগুম্ফা লেখতেই জানা যায়। অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ আর একটি প্রশস্তিমূলক লেখ হল মহারাষ্ট্রের নাসিকে প্রাপ্ত সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্মীর মাতা গৌতমীবলশ্রী প্রচারিত ‘নাসিক প্রশস্তি’। এই লেখ থেকে রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির রাজত্বকালের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ড. রামশরণ শর্মার মতে, সাতবাহনদের লেখ থেকে তৎকালীন সমাজে মাতৃসত্ত্বার প্রাবল্য, বর্ণব্যবস্থা ও স্ত্রী জাতির মর্যাদার তথ্যাদিও পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত (১৫০ খ্রিস্টাব্দ) শক-ক্ষত্রপ (রাজা) রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় প্রশস্তি ‘টিকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রশস্তিমূলক লেখর প্রাচীনতম দৃষ্টাস্ত বলা হয়। গুপ্তযুগে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশস্তিমূলক লেখটি হোল সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিয়েন বিরচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি। এটি ‘হরিযেন প্রশস্তি’ নামেও পরিচিত। সমুদ্রগুপ্তের বহু সামরিক কর্মসূচীর এটিই একমাত্র তথ্যসূত্র। সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ এবং বিজিত রাজ্যগুলির সাথে গুপ্তরাজার সম্পর্কের তথ্যাদিও এই লেখ থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম শতকে জৈনকবি রবিকীর্তি ‘আইহোল প্রশস্তি’ উৎকীর্ণ করেন। কাব্যছন্দে রচিত এই লেখ থেকে চালুক্যবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি দ্বিতীয় পুলকেশীর জীবনী ও রাজনৈতিক কার্যাবলী জানা যায়। অনুরূপভাবে প্রতিহার রাজা ভোজ এর ‘গোয়ালিয়র প্রশস্তি’ সেন রাজা বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’ ইত্যাদি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের অমূল্য উপাদানরূপে বিবেচিত হয়।
সাতবাহন রাজাদের আমল থেকে নতুন একধরনের রাজকীয় লেখর সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি মূলত তাম্রফলকের ওপর উৎকীর্ণ ভূসম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিল। রাজকীয় অনুজ্ঞা হিসেবে প্রচারিত এই সকল ভূমিদান বিষয়ক লেখ ‘তাম্রশাসন’ বা ‘তাম্রপট্ট’ নামেও অভিহিত হয়। তাম্রশাসনগুলির ভূমিকায় দানপ্রদানকারী রাজা ও তাঁর পূর্বপুরুষদের বিবিধ রাজনৈতিক কীর্তি কাহিনীর প্রশস্তি উৎকীর্ণ করা আছে। তাম্রশাসনের মূল অংশে দানগ্রহীতার পরিচয়, দান প্রদানের উদ্দেশ্য, প্রদত্ত ভূমিখণ্ডের সীমানা ইত্যাদি লিপিবদ্ধ ছিল। এই লেখগুলিতে সেই সকল করের উল্লেখ আছে, যা রাজা প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করতেন এবং দান হিসেবে যে সকল কর আদায় ও ভোগের অধিকার প্রাপককে দেওয়া হল। পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকের ভূমি ব্যবস্থা ও কৃষি সম্পর্কের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভূমি দান বিষয়ক লেখগুলির গুরুত্ব অসীম।
স্থান ও কাল ইতিহাসের দুটি চোখ বলে বিবেচিত হয়। লেখমালা থেকেই স্থান নির্দেশ ও কালানুক্রমের নির্ভরযোগ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লেখমালার সাহায্যেই প্রাচীন লুম্বিনী গ্রাম, কপিলাবস্তু, কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী, কর্ণসুবর্ণ প্রভৃতি জনপদের বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান জানা সম্ভব হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের অদূরে রক্তমৃত্তিকায় প্রাপ্ত বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে অনুমান করা যায় যে, শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠেই এই বৌদ্ধবিহারটি অবস্থিত ছিল। অনেক লেখতে সময়কাল উৎকীর্ণ দেখা যায়। যেগুলিতে তা নেই, তাদের বিষয়বস্তু বা লিপির বিকাশক্রম ও রূপান্তর অনুধাবন করে লেখর কাল নির্ধারণ সম্ভব। লেখর সাক্ষ্য থেকেই ‘শকাব্দ’ (সূচনা ৭৮ খ্রিস্টাব্দ) ও “বিক্রমাব্দ” (সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দ) নামক বহু ব্যবহৃত দুটি অব্দের উল্লেখ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট শাসকদের শাসনকাল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ৩১৯/৩২০ খ্রিস্টাব্দে ‘গুপ্তাব্দ’-এর প্রবর্তন থেকে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের নেতৃত্বে গুপ্তবংশের স্বাধীন শাসনের সূচনা বিষয়ে সময়কালের নির্ভরযোগ্য ধারণা পাওয়া যায়।
ইতিহাসের পুনর্গঠনের কাজে লেখমালার উপযোগিতা যথেষ্ট হলেও, এই সাক্ষ্য গ্রহণের আগে সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যিক। ইতিহাসের আকরসূত্র হিসেবে লেখমালারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রশস্তিগুলিতে পৃষ্ঠপোষকের প্রতি আতিশয্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। লেখতে ব্যবহৃত লিপিগুলি বহুক্ষেত্রেই অজানা এবং দুষ্পাঠ্য। ফলে তাদের পাঠোদ্ধারের যথার্থতা সম্পর্কে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। কালানুক্রম বিবর্জিত লেখগুলির কালনির্ণয়ের ক্ষেত্রেও মতভেদ থাকতে পারে। প্রশস্তি রচয়িতা অনেকসময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দীর্ঘতর ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পূর্বপরিচয়ের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ছাড়াই রাজবংশকে সূর্য বা চন্দ্রবংশ থেকে উদ্ভূত বলে দাবী করা হয়েছে। লেখমালার বিষয়বস্তু ও চরিত্র সার্বজনীন নয়। এগুলিতে রাজ্যের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। লেখর কেন্দ্রে থাকেন মূলত শাসক, অভিজাত বা সমাজের উচ্চস্তরের মানুষেরা। তাই সমাজের নিম্নস্তরের এবং গ্রামীন জনসমাজের ইতিবৃত্ত লেখর সাক্ষ্যে অনুপস্থিত।
Leave a comment