প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে মুদ্রা:

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের নির্ভরযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে মুদ্রার বিশেষ গুরুত্ব আছে। নির্দিষ্ট ওজন ও মূল্যমান বিশিষ্ট একটি ধাতব খণ্ড যখন বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়, তখন তা মুদ্রা নামে পরিগণিত হয়। মুদ্রার গাত্রে উৎকীর্ণ সন, তারিখ, প্রবর্তনকারীর নাম, পাত্রে অঙ্কিত বিভিন্ন প্রতীক, মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান, মুদ্রার ধাতু মূল্য ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে প্রাচীন যুগের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া সম্ভব। তবে ভারতে মুদ্রা ব্যবস্থার উদ্ভব, বিকাশ এবং ধাতুব্যবহারের রীতি ইত্যাদি বিষয়গুলি খুব স্পষ্ট নয়।

হরপ্পীয় সভ্যতায় ছোট ছোট সিলমোহরগুলিকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হত বলে মনে করা হয়। তবে হরপ্পায় নগর সভ্যতার অস্তিত্ব থাকলেও, ধাতব মুদ্রার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারতে ধাতবখণ্ডকে মূল্যমানের একক হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টিকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগে স্থির করা যায় না। ঋগ্বৈদিক যুগে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গোরু। তৎকালীন পশুচারণ অর্থনীতির প্রেক্ষিতে গোরু’র বাজারমূল্য এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বাধিক, কিন্তু ছোট ছোট পশু বিনিময় এবং দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গোরু আদৌ উপযোগী ছিল না। সে কারণে পরবর্তী বৈদিক যুগে ‘নিঙ্ক’, ‘শতমান’ নামক ধাতব খণ্ডের মাধ্যমে বিনিময় শুরু হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। বস্তুত ‘নিষ্ক’ শব্দটিকে বহুকাল পরে স্বর্ণমুদ্রার সমার্থক বলে গৃহীত হলেও, পরবর্তী বৈদিকযুগে ঐ অর্থ বোঝাত কিনা সন্দেহ আছে। ড. রামশরণ শর্মার মতে, অভিজাত ব্যক্তিরা সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার দ্যোতক হিসেবে সেকালে ‘নিষ্ক’, ‘শতমান’ প্রভৃতি স্বর্ণনির্মিত উপকরণ ব্যবহার করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে এর মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় হত কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ দীর্ঘ খননকার্য চালিয়েও উত্তরের কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ মৃৎপাত্রের (NBPW) পূর্বেকার কোনও মুদ্রা এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। একথা স্বীকৃত যে, ‘অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা’ (Punch marked Coin) এবং উত্তরের কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ মৃৎপাত্র সমসাময়িক।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘কৃয়ল’ (১.৮ গ্রেন) নামক তৌলরীতির উল্লেখ আছে। একশোটি ‘কৃষুল’-এর সমান ছিল ‘শতমান’ (অর্থাৎ ১.৮ × ১০০ = ১৮০ গ্রেন-এর তৌলরীতি)। এই তৌলরীতি অনুযায়ী পরবর্তীকালে ধাতবমুদ্রা নির্মাণের কাজ শুরু হতে দেখা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায় প্রাচীনতম ভারতীয় মুদ্রাভাণ্ডার পাওয়া গেছে তক্ষশিলা ও কাবুলের নিকটবর্তী ‘চমা-ই-হুজুরী’ থেকে। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন যে, এই মুদ্রাভাণ্ডারের প্রাচীনত্বকে খ্রিষ্টপূর্ব শতকের আগে স্থাপন করা সম্ভব নয়। প্রাচীনতম এই সকল ধাতুমুদ্রা (স্বর্ণ নয়) মূলত রৌপ্য নির্মিত এবং চতুষ্কোণ ও গোলাকার উভয় আকৃতিবিশিষ্ট ছিল। বৌদ্ধসাহিত্যে উল্লেখিত ‘কাহাপন’ বা ‘কার্যাপন’-এর সাথে এগুলিকে সনাক্ত করা যায়। এইসকল মুদ্রায় কেবল কিছু প্রতীক ব্যবহার করা হত। এগুলিতে প্রবর্তকের নাম বা তারিখ উল্লেখ ছিল না। ফলে এগুলি কে এবং কবে প্রচলন করেছেন, তা জানা সম্ভব নয়। মুদ্রাতাত্ত্বিকরা এগুলিকেই ‘অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা’ (Punch marked Coin) নামে অভিহিত করেছেন। মৌর্য্যরাজাদের আমলে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রার প্রচার দেখা যায়। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা ছাড়িয়ে দাক্ষিণাত্য, পশ্চিমভারতসহ দেশের নানা অঞ্চলে অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা ছড়িয়ে পড়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের গোড়ায় ব্যাকট্রীয় গ্রীক (বাহ্লিক) রাজাদের আমলেই ভারতে সর্বপ্রথম রাজার নাম ও প্রতিকৃতি সম্বলিত মুদ্রা পাওয়া যায়। এগুলির অধিকাংশই ছিল রূপা ও তামা নির্মিত। সোনার মুদ্রা পাওয়া গেলেও তার ব্যাখ্যা অতি নগণ্য। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুষান রাজা বিম কদফিসেস্-এর আমলে ভারতে স্বর্ণমুদ্রার আবির্ভাব ঘটে। এই মুদ্রার একপিঠে শাসকের প্রতিকৃতি, নাম ও উপাধি খোদিত থাকত। উল্টোপিঠে (reverse) থাকত আরাধ্য দেব-দেবীর মূর্তি। লক্ষণীয় যে, প্রায় সমসাময়িক হলেও কুষান রাজারা রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেন নি। সম্ভবত রৌপ্য খনিগুলির উপর কুষানদের অধিকার ছিল না। মধ্য এশিয়া, ককেশাস্ পর্বত, রোমান সাম্রাজ্য এবং ভারতের স্বর্ণখনি থেকে কুষানরা এই ধাতু সংগ্রহ করে মুদ্রা প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। কুষানরা বহু রোমান স্বর্ণমুদ্রাকে নিজেদের স্বর্ণমুদ্রায় পুনর্নির্মাণ করেছিল। উত্তরভারতে প্রাপ্ত রোমান স্বর্ণমুদ্রার ওপরে কুষানদের ছাপ দেখা যায়। অবশ্য সরাসরি স্বর্ণখণ্ড থেকেও বহু কুষান মুদ্রা তৈরী হয়েছিল। গুপ্তবংশের শাসনকালের প্রথম পর্বে স্বর্ণমুদ্রার আধিক্য দেখা যায়। সম্ভবত বাণিজ্যের মাধ্যমে গুপ্তরাজারা পূর্ব রোম সাম্রাজ্য, চিন দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করতেন। দক্ষিণভারতের স্বর্ণখনিগুলির ওপরেও গুপ্তদের কর্তৃত্ব ছিল। তবে কুষানদের স্বর্ণমুদ্রার সাথে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রার পার্থক্য ছিল। কুষানদের তুলনায় গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রায় যাদের পরিমাণ ছিল বেশী। দিনে দিনে খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং গুপ্তশাসনের শেষ পর্বে স্বর্ণমুদ্রার দৈন্য সাম্রাজ্যের সার্বিক দৈন্যের দিক নির্দেশ করে।

গুপ্ত পরবর্তী প্রায় চার শতকব্যাপী ভারতে স্বর্ণমুদ্রার সীমিত প্রচলন দেখা যায়। এই সময়কালে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে পাল ও রাষ্ট্রকূট বংশ রাজত্ব করেছিল। কিন্তু তাদের দ্বারা প্রচলিত কোন স্বর্ণমুদ্রার অস্তিত্ব অদ্যাবধি প্রমাণিত হয়নি। অন্যদিকে প্রতিহার বংশীয় রাজারা স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করলেও, তার সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং সেগুলি নবম শতকের পরবর্তীকালের। একাদশ-দ্বাদশ শতকে আবার সোনা ও রূপার মুদ্রার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। তুর্কি শাসকদের পাশাপাশি রাজপুত রাজ্যগুলিতে স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। তবে কুষান বা গুপ্তযুগের মুদ্রার তুলনায় এগুলি ছিল ক্ষুদ্রাকার, অর্থাৎ অল্প ধাতুতে বেশী মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল।

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে মুদ্রা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত থেকে প্রতীয়মান হয়। ভারতের আদিপর্বের মুদ্রাগুলিতে শাসক বা প্রবর্তকের নাম খোদাই করা হত না। ফলে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তাদের অবদান অনেকাংশে অনুমান নির্ভর। কিন্তু ব্যাকট্রীয় গ্রীকদের মুদ্রায় সেই অভাব ছিল না। তাই এগুলি যথার্থই ইতিহাসের দু’টি চোখের কাজ করতে পারে। মৌর্য্য-পরবর্তী ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে যে গ্রীক রাজাদের শাসন কায়েম হয়েছিল সে কথা কেবল মুদ্রার সাক্ষ্য থেকেই দেওয়া সম্ভব। লেখমালা থেকে ভারতে গ্রীক শাসনের আভাস পাওয়া যায় না। মুদ্রার সাহায্যেই উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রথম গ্রীক শাসক হিসেবে ডিমিট্রাসকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। রাজা মিনান্দারের মুদ্রার বৈচিত্র এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রাপ্তি থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও ক্ষমতার বিষয় অনুধাবন করা যায়। কেবল মুদ্রার সাহায্যেই আটত্রিশজন ব্যাকট্রীয় গ্রীকরাজা এবং দু’জন রানীর নাম জানা যায়। লেখমালা থেকে মাত্র দু’জনের এবং সাহিত্য থেকে সাতজনের নাম জানা যায়। মুদ্রার সাহায্যে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে যে হেলিওক্লেশ ছিলেন শেষ ভারতীয় গ্রীক রাজা এবং তারপরেই গ্রীক শাসন অবসিত হয়। অনুরূপভাবে মুদ্রার সাক্ষ্য থেকেই শক-পহ্লব বংশের পঞ্চাশজন শাসকের একটি কালানুক্রমিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব। এদের মুদ্রাগুলিতে রাজার নাম, তারিখ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রাজার পিতার নাম ও তাঁর অভিধাও বর্ণনা করা আছে। নাসিকের নিকটস্থ জোগালথেম্বীতে প্রাপ্ত মুদ্রাভাণ্ডার থেকে শক-সাতবাহন সংঘর্ষের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। শক-সাতবাহনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং একটি পর্বে সাতবাহনদের সাফল্যের কাহিনী গৌতমীপুত্রের লেখ থেকেও পাওয়া গেছে। কিন্তু জোগালথেম্বীতে প্রাপ্ত শক-ক্ষত্রপ নহপানের মুদ্রা এই ঘটনাটিকে সুনিশ্চিত করেছে। এখানে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলিতে নহপানের নামের ওপর গৌতমীপুত্র সাতকর্মীর নাম, নকশা ও প্রতীক পুনর্মুদ্রিত আছে। এটি নিঃসন্দেহে নহপানের বিরুদ্ধে গৌতমীপুত্রের সামরিক সাফল্যের সাক্ষ্য দেয়।

গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাপর্বে লিচ্ছবীদের মৈত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কুমারদেবী এবং প্রথম চন্দ্রগুপ্তের যৌথমুদ্রা সম্ভবত সেই ইঙ্গিত দেয়। মুদ্রা ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে এ বিষয়ে জানা যায় না। এখান থেকেই এমন সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না যে, তাঁরা যৌথভাবে শাসন চালনা করতেন। তবে এ-বিষয়ে নিশ্চিত বলা যায় না। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পশ্চিম ভারত থেকে শকদের উচ্ছেদ করেছিলেন। এই সত্যটি মুদ্রা ছাড়া অন্য কোন সূত্রে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কিছু মুদ্রায় রাজাকে সিংহ শিকারী হিসাবে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। পশ্চিম ভারতের গুজরাট অঞ্চলে সিংহের প্রবল অস্তিত্ব ছিল। স্বভাবতই এই মুদ্রা থেকে গুজরাট অঞ্চলে গুপ্তবংশের কর্তৃত্বের ধারণা পাওয়া যায়। ৩৯৭ খ্রিস্টাব্দের পর পশ্চিম ভারতে কোন শক মুদ্রা পাওয়া যায়নি। এটি শক শাসনের পতনের ইঙ্গিত দেয়।

অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনেও মুদ্রার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ড. রামশরণ শর্মা মনে করেন যে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার কাজে মুদ্রার সাক্ষ্যকে যথেষ্টভাবে প্রয়োগ অদ্যাবধি হয়নি। সাধারণভাবে দেখলে মুদ্রার ব্যাপক উপস্থিতি দেশের বাণিজ্য অর্থনীতির বিকাশের ইঙ্গিত দেয়। আবার মুদ্রার অনুপস্থিতি অর্থনৈতিক স্থবিরতার (বদ্ধ অর্থনীতি) আভাস দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে ভারতে প্রথম মুদ্রার অস্তিত্ব পাওয়া গেলে, ইতিহাসগতভাবে তখন উত্তরভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের বিষয়টি বোঝা সম্ভব হয়। কুষানদের আমলে সমৃদ্ধ ভারত-রোম বাণিজ্য চলত। এই বাণিজ্য সূত্রে রোম থেকে ভারতে সোনা আমদানি সম্ভব হত এবং কুষানদের পক্ষে উন্নত স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন সহজ হয়েছিল। সাতবাহনরাও এই সুবিধা ভোগ করতেন। যতদিন ভারত-রোম বাণিজ্য অব্যাহত ছিল, ততদিন ভারতে স্বর্ণমুদ্রার যোগানে সমস্যা হয়নি। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা গুপ্ত শাসনকালে ভারত-চীন বাণিজ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, চীন ভারত থেকে সূতিবস্ত্র, শর্করা (চিনি), চন্দন কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত এবং বিনিময়ে ভারতে স্বর্ণের যোগান দিত। কিন্তু সপ্তম শতকে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এইসকল পণ্য আমদানি কমিয়ে দিলে ভারতে সোনার ঘাটতি প্রকট হয়। স্কন্দগুপ্তের আমল পর্যন্ত ভারতীয় স্বর্ণমুদ্রার ওজন বেড়েছিল (১২৪-১৪৪), কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালে মুদ্রায় সোনার পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকে এবং খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। নিঃসন্দেহে এই অবস্থা অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার ইঙ্গিত দেয়। পরবর্তীকালে পাল বা রাষ্ট্রকূট রাজারা কোন স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করতেই পারেন নি।

প্রাচীনকালে ধর্মভাবনা এবং শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কাজেও মুদ্রা সহায়ক হতে পারে। মুদ্রার মুখ্য দিকে রাজার প্রতিকৃতি ও রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রচার করা হত। গৌণদিকে উৎকীর্ণ থাকত দেবদেবীর মূর্তি। এর থেকে সমকালীন ধর্মভাবনার আভাস পাওয়া যায়। মুদ্রায় উৎকীর্ণ রাজার প্রতিকৃতি এবং দেবদেবীর মূর্তির কাঠামো, পোষাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্করণ থেকে সে কালের শিল্পধারা ও সমাজজীবনের ছবি পাওয়া সম্ভব। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় তাঁর বীণা বাদনরত মূর্তি থেকেই সম্রাটের সংগীতপ্রীতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। ব্যাকট্রীয় গ্রীকমুদ্রায় খোদিত মনুষ্য মূর্তিগুলিকে প্রাচীন শিল্পভাবনার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলা যায়। শক্-পহ্লবদের মুদ্রায় এই উন্নত শিল্পকর্ম অনুপস্থিত। পরবর্তীকালে কুযানদের স্বর্ণমুদ্রায় আবার উন্নত শিল্প নমুনা দেখা যায়। গুপ্তরাজারা এই বিদেশীয় শৈলীকে আত্মস্থ করে মুদ্রা নির্মাণ শিল্পের ভারতীয়করণ ঘটান। অধ্যাপক পি. এল. গুপ্ত মনে করেন যে, গুপ্তযুগের মুদ্রা কুষানদের মুদ্রার থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল। গুপ্তদের স্বর্ণমুদ্রার মৌলিকত্ব অন্য মুদ্রায় অনুপস্থিত।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে শিল্পকর্ম :

ভারতে সৃজনশীল শিল্পচর্চার ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। আদিমযুগে গুহাবাসী, অরণ্যচারী মানুষেরাও সজ্ঞানে বা অজান্তে কেবল নক্শার মাধ্যমে যে শিল্পচর্চা করতেন, তার প্রমাণ আমরা মেহেরগড় সভ্যতার আমলে প্রত্যক্ষ করি। স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা—এই তিনধারার প্রাচীন শিল্পচর্চার নিদর্শন ব্যাখ্যা করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন দ্বারা প্রাচীন যুগের যে সকল ইমারতের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মাচারের সাথে যুক্ত। লৌকিক স্থাপত্যের নিদর্শন খুবই কম। ভাস্কর্য হিসেবে পাওয়া গেছে প্রচুর পাথর ও ধাতুনির্মিত এবং পোড়ামাটির মূর্তি। পোড়ামাটির মৃৎপাত্র এবং অলংকারাদিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এইসকল শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করে প্রাচীন ভারতের ধর্মভাবনা, শিল্পবোধ ইত্যাদির ধারণা পাওয়া সম্ভব।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নিদর্শন ব্যাখ্যা করে হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো, লোথাল ইত্যাদি হরপ্পীয় সংস্কৃতির সাথে যুক্ত প্রাচীনতম ভারতীয় সভ্যতাগুলির নানা তথ্য পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চন্দ্রকেতুগড় এবং বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস লেখার নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে। সারনাথ-বিহার এবং তক্ষশীলায় ভীরমাউণ্ড, সিরকাপ ও সিরমুখ প্রভৃতি নগর আবিষ্কারের ফলে আর্য সংস্কৃতির নতুন নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে অত্রঞ্ঝিখেড়ায় প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু থেকে জানা গেছে যে, ঐ অঞ্চলের মানুষ লৌহ ধাতুর সাথে পরিচিত ছিলেন। হস্তিনাপুর ও কৌশাম্বীর প্রাচীন সভ্যতার স্থাপত্য-ভাস্কর্য নিদর্শন থেকেও লৌহসংস্কৃতির সাথে তাদের পরিচয়ের তথ্য জানা যায়। লৌকিক স্থাপত্য হিসেবে হরপ্পা-সভ্যতার শস্যাগারগুলি এবং পাটলিপুত্রে মৌর্যদের রাজপ্রাসাদের অবশেষ আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় স্থাপত্যের দিক্ থেকে বৌদ্ধস্তূপ, বিহার বা চৈত্যগুলির আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। মন্দির ও দেবালয়ের আকৃতি ও নির্মাণশৈলী বিশ্লেষর করে জানা যায় যে, খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের আগে ভারতে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়নি। একই সঙ্গে মন্দির শিল্পে তিনটি আঞ্চলিক রীতি, নাগর, দ্রাবিড় ও বেসর প্রভৃতির ক্রমবিকাশ ও বৈশিষ্ট্যের ধারণাও স্থাপত্যের আবিষ্কার থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। সুপ্রাচীন পোড়ামাটির মূর্তির আবিষ্কার প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ভারতে ভাস্কর্যচর্চার ইঙ্গিত দেয়। গান্ধার, অমরাবতী ইত্যাদি স্থানের বুদ্ধমূর্তিগুলির নির্মাণশৈলী সমকালীন ধর্মভাবনা এবং ভাস্কর্য শিল্পের বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে।

প্রাচীন চিত্রকলার নিদর্শন খুব বেশী নেই। নিম্ন প্রস্তর যুগীয় চিত্রকলায় বেশীরভাগ জ্যামিতিক ধারায় করা। মানুষ বা জন্তুজানোয়ারের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে কয়েকটি লাইন টেনে বা ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ ইত্যাদির নক্সা’র মাধ্যমে। মধ্যপ্রদেশের ভীমবৈধকার এই চিত্রধারার গতিশীলতা সম্পর্কে পণ্ডিতদের সংশয় নেই। নৃত্য বা শিকারের দৃশ্যের চিত্রাঙ্কনও খুব সজীব ও গতিশীল। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রচর্চার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ অজন্তার গুহাচিত্রে পাওয়া যায়। এছাড়া চোল আমলের কোনও কোনও মন্দিরের অভ্যন্তরেও চিত্রকলাচর্চার কিছু অবশেষ পাওয়া গেছে। ধর্মীয় পুঁথি ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্র দ্বারা শোভিত করা হত। পালযুগে বাংলা ও বিহারে এই জাতীয় পুঁথি চিত্রনের রেওয়াজ ছিল।