প্রাক্-ঐতিহাসিক কাল থেকেই ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসে দেবতা রূপে পশুপতি বা শিবের কল্পনা দেখা যায়। বৈষ্ণবধর্মের মত শৈবধর্মও একেশ্বরবাদী এবং প্রধানত ভক্তিবাদকে ভিত্তি করেই এই ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। ভারতের সমাজচেতনা ও রাষ্ট্রচেতনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শৈবধর্মও জনপ্রিয়তা ও দৃঢ় ভিত্তিলাভ করেছে। বৌদ্ধ বা বৈঘ্নবধর্মের মতই শৈবধর্মও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে দ্রুত প্রসার ও প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পেরেছে।
ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “এই অনুমান অসঙ্গত নয় যে, শক্তিসাধনার মত শৈব সাধনারও সূত্রপাত প্রাক্-বৈদিক যুগে এবং বেদোত্তর ভারতের ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি-সাধনার মত শৈব-সাধনাও অবিচ্ছিন্নভাবে টিকে আছে।’১ হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোতে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে এইরূপ অনুমান অসঙ্গত নয়। মহেঞ্জোদরোয় প্রাপ্ত একটি সীলে তিন মুখ ও দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট এবং যোগাসনে উপবিষ্ট একটি মূর্তি অঙ্কিত আছে। মূর্তিটির বক্ষদেশে কয়েকটি মালা আছে এবং উভয় পার্শ্বে হস্তী, ব্যাঘ্র, গণ্ডার ও মহিষ—এই চারটি প্রাণী অঙ্কিত আছে। এই মূর্তিটিকে ঐতিহাসিক স্যার জন মার্শাল পশুপতি শিবের আদি প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন। হরপ্পায় প্রাপ্ত আর একটি সীলে যোগাসনে উপবিষ্ট এবং নানা প্রাণী পরিবেষ্টিত একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সীলটির উল্টোপিঠে বৃষমূর্তি ও ত্রিশূলধ্বজ অঙ্কিত আছে। দ্বিতীয় সীলটিকে প্রথম সীলটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায়। মূর্তিটি উপবেশনভঙ্গী, বৃষের অবস্থান এবং ত্রিশূলধ্বজ আধুনিক শিব-কল্পনার সাথে অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে বহু ঐতিহাসিক জন মার্শালের বক্তব্যের সাথে একমত হয়ে হরপ্পা-সংস্কৃতিতে শিবের উপাসনার কথা সমর্থন করেছেন।
হরপ্পায় খননকার্য থেকে অসংখ্য লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি পাওয়া গেছে। মার্শাল প্রমুখ মনে করেন লিঙ্গপূজার সাথে শিব-কল্পনার গভীর যোগ বর্তমান। বৈদিক পরবর্তীকালে শিবসাধনার অংশ হিসেবে লিঙ্গপূজা কেবল জনপ্রিয়তা পায়নি; কালক্রমে শিবমূর্তির পরিবর্তে কেবল লিঙ্গ প্রতীক পূজাই বেশি প্রচলিত হয়েছে। ইলোরার কৈলাস মন্দির, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির-সহ নানা শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে পূজার কেন্দ্রে লিঙ্গ স্থাপনা করা হয়েছে। স্বভাবতই হরপ্পা-সংস্কৃতিতে লিঙ্গ উপাসনার নিদর্শন থেকে ঐ সময়ে শৈবসাধনার অস্তিত্ব কল্পনা করা অযৌক্তিক নয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে লিঙ্গ ও যোনি পূজার সাথে শিবের সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের একটি মুদ্রার এক পিঠে যোগারূঢ় শিব ও অন্য পিঠে লিঙ্গমূর্তি অঙ্কিত আছে। ফলে শিব-সাধনা ও লিঙ্গপূজার অভিন্নতা কল্পনা করা অসঙ্গত নয়। অধ্যাপক ভট্টাচার্য মনে করেন, শৈবধর্মে তান্ত্রিক প্রভাববৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গপূজার সাথে যোনিপূজাও জনপ্রিয় হয়েছে।
ঋগ্বেদে শিবের উল্লেখ নেই। যজুর্বেদে দেবতা হিসেবে রুদ্রের উল্লেখ আছে। তবে ঋগ্বেদের মত যজুর্বেদের ‘রুদ্র’ কেবল ভীতির দেবতা নয়, তিনি একই সাথে ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা। আবার অথর্ববেদে রুদ্রের নামের সাথে পশুপতি, মহাদেব ইত্যাদি নাম আছে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে রুদ্রের নাম বা উপাধি হিসেবে ‘মহাদেব’, ‘শিব’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার আছে। মহাভারত ও রামায়ণের নানা স্থানে ‘শিব’-এর উল্লেখ আছে। রামায়ণে শিবকে মহাদেব, রুদ্র, শংকর, পশুপতি ইত্যাদি বহু নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই মহাকাব্যে শিবের বিবাহ থেকে সৃষ্টিরক্ষার নানা কাহিনী বিধৃত আছে। সম্ভবত মহাভারতের যুগ থেকে (খ্রিঃপূঃ ৪র্থ শতক—খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতক) পাশুপত ধর্মের জনপ্রিয়তা এসেছে। এই পর্বে শৈব-পাশুপত ধর্ম একটা সুনির্দিষ্ট ও সংহত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। শিরভাগবত বা পাশুপত ধর্মের আদি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ‘পাশুপাত-সূত্র’ গ্রন্থ থেকে। গুপ্তযুগে কৌণ্ডিণ্য এই গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করেন। এই ভাষ্যকে অবলম্বন করে মাধবাচার্য এই ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন।
পাশুপত ধর্মের পাঁচটি মূল বিষয় হলো—কার্য, কারণ, যোগ, বিধি ও দুঃখান্ত। কার্য ও কারণ তত্ত্ব দ্বারা জীবকুলের দুঃখ ও তার কারণের উল্লেখ করা হয়েছে। পাশুপত ধর্মের দেবতা শিবের কাজ হল মানুষের মুক্তিদান। তাই দুঃখান্ত এই ধর্মের চরম লক্ষ্য। দুঃখ তিনপ্রকার— আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক। আদিভৌতিক দুঃখের পাঁচটি রূপ হল—গর্ভে বাস, জন্মলাভ, অজ্ঞানতা, জরা ও মৃত্যু। আধিদৈবিক দুঃখ পাঁচপ্রকার, যথা—ইহলোকভীতি, পরলোকভীতি, অহিত-সংপ্রয়োগ, হিত-বিপ্রয়োগ ও ইচ্ছা-ব্যাঘাত। আধ্যাত্মিক দুঃখ মানসিক, প্রবৃত্তিগত এবং শারীরিক। এই দুঃখের হাত থেকে মুক্তির জন্য ‘যোগ’ ও ‘বিধি’ অনুশীলন আবশ্যিক। যোগ দ্বারা অজ্ঞানতা দূর হয় এবং আধ্যাত্মিক কর্মশক্তির অধিকারী হওয়া যায়। বিধি হল আচার-অনুষ্ঠান। প্রধান বিধি হল ‘চর্যা’। চর্যা দু’প্রকার— ব্রত ও দ্বার। ভস্ম মেখে হাস্য-গীত, নৃত্য ইত্যাদি ব্রতর অন্তর্গত। দ্বার ছয় প্রকার। যেমন—জেগে ঘুমানোর ভান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কম্পন সৃষ্টি, প্রলাপ ভাষণ ইত্যাদি।
পাণিনি, পতঞ্জলি ও মেগাস্থিনিসের রচনাবলীতে মগধ, মৌর্য ও শুঙ্গ রাজাদের আমলে উত্তর-ভারতে শৈবধর্ম প্রসারের কথা জানা যায়। পাণিনির ব্যাকরণে শিব-উপাসকদের কথা আছে। পতঞ্জলি লিখেছেন, শিবলিঙ্গ স্থাপন ও ‘শিব-ভাগবতদের কথা। মেগাস্থিনিস যে ‘ভারতীয় ডায়োনিসিয়াম’-এর উল্লেখ করেছেন স্পষ্টতই তিনি শিব ছাড়া আর কেউ নন। মহাভারতের সূত্র থেকে জানা যায় তৎকালীন ভারতের সাধারণ মানুষ হয় শৈব অথবা বৈষুব ছিলেন এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এদের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। সে যুগে শৈব্যদের মধ্যে গৃহী ও সন্ন্যাসী এই দুই প্রকারভেদ ছিল কিন্তু জাতিভেদ ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীতে ইন্দো-গ্রীক শাসকদের মুদ্রা থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। কুষাণ আমলের মুদ্রায় শিবের মুদ্রিত প্রতিমূর্তি পাওয়া যায়। কোন কোন মুদ্রার একদিকে শিবের বাহন ষাঁড়ের মূর্তিও খোদিত আছে। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণীতেও গান্ধার রাজধানী পুষ্করাবতীতে শিবপূজা প্রচলনের উল্লেখ আছে। উত্তর ভারতের মত দক্ষিণ ভারতেও শৈবধর্ম বিস্তারলাভ করেছিল। সঙ্গম সাহিত্যে শিবকে শ্রেষ্ঠ দেবতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাচীন কবিতা সংকলন ‘অহনানূরু’তে শিব এবং উমার বর্ণনা আছে। খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকের দুটি প্রাচীন গ্রন্থ ‘শিলপ্পদিকারম্’ ও ‘মনিমেঘলাই’-এর তামিল অঞ্চলে শিবপূজার উল্লেখ আছে।
গুপ্তযুগের অধিকাংশ সম্রাট বৈষুব হলেও সব ধর্মের প্রতি তাদের সহনশীল মনোভাবের ফলে শৈবধর্মের বিশেষ অগ্রগতি হয়। প্রথম কুমারগুপ্ত নিজপুত্রের নাম শিবের অযোনিসম্ভূত পুত্র স্কন্দের নামে রেখেছিলেন। মহাকবি কালিদাস শৈব ছিলেন। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যেও শিবের গীত রচিত হয়েছে। গুপ্তরাজারা ছাড়াও হুনরাজা মিহিরকুল শিবভক্ত ছিলেন। বাংলার রাজা শশাঙ্ক, কনৌজের পুষ্যভূতিবংশীয় রাজারা, দক্ষিণ ভারতের বকাটকগণ, কদম্বগণ এবং পশ্চিমের গঙ্গাবংশীয় শাসকগণের শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখে ঐ যুগে শৈবধর্মের প্রসার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এযুগে অসংখ্য শিবমন্দির ও শিবমূর্তি নির্মিত হয়। শিবলিঙ্গের পূজা শৈবধর্মে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মহাভারতে সর্বপ্রথম শিবলিঙ্গের স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া গেলেও গুপ্তযুগের শিবলিঙ্গগুলি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবতা-বর্জিত ও প্রথাগত ছিল। এ যুগে দু’প্রকার লিঙ্গমূর্তি দেখা যায়—লিঙ্গোদ্ভব মূর্তি ও মুখলিঙ্গ মূর্তি। ইলোরার দশাবতার গুহায় একটি লিঙ্গোদ্ভব মূর্তি পাওয়া গেছে। ইলোরার গুহামন্দিরের কয়েকটি রিলিফে বিচিত্র শিবমূর্তি দেখা যায়। এই মূর্তিগুলি থেকে অনুমিত হয়, গুপ্তযুগের মূর্তিগুলিতে নরত্ব আরোপিত হয়েছিল। শিবের হরিহর মূর্তি গুপ্তযুগে বিরল। একমাত্র নিদর্শনটি পাওয়া যায় বাদামির গুহামন্দিরের প্যানেলে।
দক্ষিণ ভারত : নায়নার সাধকগণ
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে দক্ষিণ ভারতে শৈবধর্মের প্রসার ঘটে। বৈষুব আলবার সাধকদের অনুরূপ একদল ভক্তিবাদী সাধক দক্ষিণ ভারতে শৈবধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁরা ‘শৈব-নায়নার’ নামে খ্যাত। শৈব-নায়নার সাধকবৃন্দ তামিল ভাষায় ভক্তিগীতি রচনা করে শৈবধর্মকে আধ্যাত্ম-অনুভূতি কেন্দ্রিক ধর্মতত্ত্ব হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। ঐতিহ্য অনুসারে নায়নার সাধকের সংখ্যা তেষট্টি জন। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ছিলেন তিরুমুলর। ষষ্ঠ শতকে আবির্ভূত এই নায়নার সাধক তিন হাজারের বেশি শ্লোক রচনা করেছেন। তাঁর ‘তিরুমন্দিরম্’গ্রন্থে ‘পতি-পশু-নাথ’ নামে শৈব সিদ্ধান্ত মতবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘আগম সিদ্ধান্ত’ (শৈব-গ্রন্থ) বেদের মতই ঈশ্বরের বাণী।’ তাঁর পরবর্তী সাধকদের অন্যতম ছিলেন অপ্পর (৬০০-৮১ খ্রিঃ), সম্বন্দর (৬৪৪-৬০ খ্রিঃ), মাণিক্যবাচকর (৬৬০-‘৯২ খ্রিঃ), সুন্দরর (৭১০-৩৫ খ্রিঃ) প্রমুখ। অপ্পর বিরচিত ৩১৩ টি পদের পরিচয় পাওয়া গেছে। সম্বন্দর মাত্র ষোল বছর জীবনকালে শতাধিক পদ রচনা করে খ্যাতি পান। তাঁর প্রায় ৩৮৪টি পদ পাওয়া গেছে। মাণিক্যবাচকর পাণ্ড্যরাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। পরে মন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি ত্যাগ করে সাধকের জীবন বেছে নেন। তিনি শৈব সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। সুন্দরর রচিত ভক্তিগীতিগুলি খুবই জনপ্রিয়। মন্দিরের প্রার্থনাসংগীত হিসেবে তাঁর পদাবলী আজও জনপ্রিয়। তামিল শৈব সাহিত্য পেরিয়া পুরাম-এ ৬৩ জন শৈব সাধকের জীবনী ও কীর্তি কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। এঁদের মধ্যে ব্রাক্ষ্মণ থেকে ব্যাধ জাতীয় নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন। শৈব-নায়নার সাধকপদে তাঁতী, কুমোর, ধোপা, জেলে, তেলি ইত্যাদি নিম্নশ্রেণীর মানুষের অধিষ্ঠান ভারতের প্রচলিত জাতি-বর্ণভিত্তিক সমাজ ও ধর্মব্যবস্থার রূপান্তরের পূর্বাভাস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
শৈব সিদ্ধান্ত :
শৈব-নায়নার সাধকদের ভক্তিবাদকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতে ‘শৈব-সিদ্ধান্ত’ নামক ধর্মতত্ত্ব গড়ে ওঠে। নায়নারদের বক্তব্যকে ভিত্তি করে শিবাচার্য মোকণ্ডদেব, অরুনন্দি, মরয়জ্ঞানসম্বন্ধ ও উমাপতি তামিল শৈবধর্মের তত্ত্ব প্রচার করেন। শৈব সিদ্ধান্তের দর্শন অনুযায়ী পতি অর্থাৎ ঈশ্বর; পশু বা জীবকুল এবং পাশ অর্থাৎ সংসার বন্ধন এই তিনটি উপাদান জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাসের কেন্দ্রে অবস্থিত। ঈশ্বর যেমন বাস্তব, তাঁর সৃষ্টিও তেমনি বাস্তব। ঈশ্বরের (শিব) নির্দেশেই সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ সম্পন্ন হয়। এঁরা বিশ্বাস করেন যে কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকা স্বরূপ উপাদানের সাহায্যে ঘটাদি প্রস্তুত করেন, তেমনি সৃষ্টিকর্তা শিব জগৎসৃষ্টির উপাদান হিসেবে ‘মায়া’কে বেছে নিয়েছেন। এই মায়া দু’প্রকার—শুদ্ধমায়া ও অশুদ্ধমায়া। ইহজাগতিক কর্মের সাথে যুক্ত হলে মায়া অশুদ্ধতায় পর্যবসিত হয়। তবে ঈশ্বর সরাসরি মায়ার উপর ক্রিয়া করেন না। তিনি চিৎ শক্তির মাধ্যমে অচিৎ বা জড় মায়ার উপর ক্রিয়া করেন। শৈব সিদ্ধান্তে বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস দেখা যায়।
আচারগত দিক থেকে শৈব সিদ্ধান্ত তথা তামিল শৈবধর্ম একান্তই ভক্তিবাদী। চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞানমার্গ অনুশীলন দ্বারা ভক্ত শিবত্ব বা মুক্তি অর্জন করতে পারে বলে মনে করা হয়। চর্যা বা ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ ক্রিয়া বা ঈশ্বরের মধ্যে পিতৃত্বের আস্বাদ লাভ যোগ অর্থাৎ ভক্ত ও ভগবানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য দ্বারা সখ্যতার উপলব্ধি এবং শেষ মার্গ জ্ঞান অর্জন দ্বারা সত্যপোলব্ধির মাধ্যমে মানুষ মোক্ষ বা মুক্তির দ্বারে উপনীত হতে পারেন।
বীর শৈব বা লিঙ্গায়ত সম্প্রদায় :
কর্ণাটক অঞ্চলে বীরশৈব বা লিঙ্গায়ত্ নামক একটি শৈব-সম্প্রদায় গড়ে উঠে। শৈবদের মধ্যে এঁরা নিজেদের বীর বলে মনে করতেন। তাই বীর-শৈব সম্প্রদায় নামে পরিচিত হন। আবার এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গলায় একখণ্ড সিল্কের বিশুদ্ধ বস্ত্রখণ্ডে শিবলিঙ্গ ধারণ করতেন। তাই ‘লিঙ্গায়ত্’ নামেও অভিহিত হন। এঁরা শঙ্করাচার্য ও রামানুজের দর্শনতত্ত্ব দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, রেবনসিদ্ধ, সরুলসিদ্ধ, একোরাম পণ্ডিতারাধ্য এবং বিশ্বারাধ্য এই পাঁচজন শৈবাচার্য বীরশৈব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এই দর্শনকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেন বসব নামক কন্নড় দেশীয় জনৈক ব্রাহ্মণ। প্রথম জীবনে বসব ছিলেন কল্যাণের চালুক্যরাজ বিজুল (১১৫৭-‘৬৭ খ্রিঃ)-এর প্রধানমন্ত্রী। জৈনধর্মের প্রতি অনুগত বিজুল-এর সাথে বসবের মতভেদ ঘটে। তাঁর প্ররোচনায় বিজুল নিহত হন। অতঃপর বসব তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বীর শৈব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন। ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘শিবানুভব-মণ্ডল’ গঠন করে এই সংস্থার নেতৃত্বে বিচ্ছিন্ন বীর শৈবদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেন। পরবর্তীকালে বসবের ভ্রাতুষ্পুত্র চেন্ন-বসব বীর শৈবদের নেতৃত্ব দেন।
বীর শৈবধর্মে বেদের গুরুত্ব স্বীকৃত নয়। অবশ্য বেদকে তাঁর অস্বীকারও করেন না। সত্যবাদিতা, নৈতিকতা ও পবিত্রতার উপর তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই মতাদর্শের দু’টি বৈশিষ্ট্য হলো—ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধিতা এবং সমাজসংস্কারের উপর গুরুত্ব আরোপ। লিগ্গায়ত সম্প্রদায়ের সদস্যরা উপবীত ধারণের বিরোধী ছিলেন। এঁরা শিবলিঙ্গ ছাড়া অন্য কোন দেবতাকে স্বীকার করেন না। গায়ত্রীমন্ত্রের পরিবর্তে শিবমন্ত্র জপ করাই এঁদের বিধান। সমাজসংস্কারের কর্মসূচী হিসেবে বীর শৈবরা জাতি ভেদাভেদ অস্বীকার করেন এবং ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি বর্জনের ডাক দেন। নারীজাতির মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়ে লিঙ্গায়তদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। এঁরা বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে প্রচার চালান। মানুষকে অন্নদান, জলদান, পথ্য দান, বিদ্যাদান ইত্যাদি সেবামূলক কাজকে বীর শৈবরা ধর্মাচরণের অনুসঙ্গ বলে মনে করতেন। এই কারণে বলা হয় যে, বসব শুধুমাত্র রাজনীতিক বা ধর্মসংগঠক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসংস্কারক।
চড়ক, গাজন :
তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মানুষের মধ্যে শিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আদিম কাল থেকেই আধুনিক দেবতা শিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি সমরূপ ভিন্ন নামাঙ্কিত কিংবা খোদিত দেব-প্রতিমূর্তির মধ্যে কল্পিত হয়ে এসেছে। ফলে আধুনিক শৈবধর্মের মধ্যে নিম্নশ্রেণীর মানুষদের লৌকিক নানা ক্রিয়াকর্ম যুক্ত হয়েছে। গ্রীক দেশের ‘ছাগগীতি’র ঢঙে শিব-পার্বতীকে কেন্দ্র করে হাস্যরসাত্মক আচার অনুষ্ঠান ধর্মের অঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে। ভাগবতপুরাণ’ গ্রন্থে শিবকে শ্মশানচারী, ভূত-প্রেতের সহচর, ক্রিয়াহীন, দিগম্বর, জটাধারী, উন্মত্তবৎ, তমোগুণান্বিত, ভূতপতি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে নিন্দা করা হয়েছে। সম্ভবত নিম্নশ্রেণীর মানুষের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান শৈব ধর্মাচারের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে শৈব বিরোধীরা এইভাবে সংস্কৃতিহীন, ব্যক্তিত্বহীন ও ভাঁড় জাতীয় চরিত্র হিসেবে শিবের চিত্রায়ণ করেছেন। আধুনিক কালের চৈত্র-সংক্রান্তির চড়ক-গাজন অনুষ্ঠানে হর-পার্বতী কেন্দ্রিক নিম্নস্তরের চরিত্র-চিত্রণ ও আদি রসাত্মক সংগীত সহযোগে নৃত্য-গীত অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে শৈবধর্মের প্রতি ভাগবতীয় ও উচ্চশ্রেণীর মানুষের অনাস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
গণেশ দেব : গাণপত্য সম্প্রদায়
গণেশ ‘গণ’ বা Tribe-এর দেবতা। তাই তাঁর অন্য নাম গণপতি / ঋগ্বেদের সময় থেকেই এই দেবতার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আজও এই গণদেবতাকে আরাধনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং যে-কোন পূজানুষ্ঠানে অন্য দেবতার আগে গণেশের পূজা করা হয়। আধুনিক ব্যাখ্যানুযায়ী যেহেতু গণেশ সমগ্র গোষ্ঠীর প্রতীক, তাই তাঁর আহ্বান ও আরাধনা সর্বাগ্রে করার রীতি প্রচলিত আছে। কিংবদন্তী অনুসারে পশুমুণ্ড গণেশের মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজনে সর্বাগ্রে তাঁর আরাধনা করা হয়।
গণেশের হস্তীমুণ্ড সম্পর্কে একাধিক মত আছে। একটি মতে, আদিতে গণেশ ছিলেন রুদ্রদেব। তিনি অমঙ্গলের দেবতা। কোন কিছুর উপর তাঁর দৃষ্টি পড়লে তার ক্ষতি হওয়া ছিল নিশ্চিত। পরবর্তীকালে শনির দৃষ্টিতে গণেশের মুণ্ডু উড়ে যায়। তখন তাঁর ধড়ের উপর গজমুণ্ড বসিয়ে দেওয়া হয়। এই দুর্ঘটনার পর গণেশের রুদ্ররূপ তিরোহিত হয় এবং তিনি সিদ্ধিদাতা গণেশে রূপান্তরিত হন।
অন্যমতে, আদিক টোটেমবাদ অনুসারে গণেশ কোন একটি শক্তিশালী ট্রাইবের মুখ্য দেবতার প্রতীক ছিলেন। সেই ট্রাইবের টোটেম ছিল হস্তী। তাই গণেশ হস্তীমুণ্ড বিশিষ্ট দেবতা।
গাণপত্য সম্প্রদায় একাধিক শাখায় বিভক্ত। এদের ধর্মাচার ও ধর্ম-বিশ্বাসেও স্বাতন্ত্র্য আছে। কোন কোন সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে গজানন চরম সত্তা ও বিশ্বজগতের স্রষ্টা। তিনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরাদি দেবতাদের সাথে সম্পৃক্ত। আবার কোন কোন গাণপত্য সম্প্রদায় যেমন উচ্ছিষ্ট গাণপত্যগণ গণেশকে তন্ত্রাচার ভিত্তিক দেবতা বলে বিশ্বাস করেন, যেখানে পঞ্চ ‘ম’ কারের সাথে গণেশের যোগ স্থাপন করা হয়েছে।
চতুর্থ শতকের পরবর্তীকালে গণেশ প্রকৃতই গণদেবতায় পরিণত হয়েছেন। নবম শতকে প্রাপ্ত লেখমালা থেকে বোঝা যায় যে ব্যবসাবাণিজ্যের দেবতা হিসেবে তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এইভাবে রুদ্রদেব গণেশ সিদ্ধিদাতা গণেশে উত্তীর্ণ হয়েছেন। দুর্গার পুত্র এবং কার্তিকের ভ্রাতা হিসেবে তিনি ভক্তদের কাছে বিশেষ সমাদর পান।
দেবী দুর্গা :
দুর্গতিনাশিনী দেবী হিসেবেই দুর্গার সমধিক পরিচিত। বিভিন্ন ধর্মসূত্রে তাঁর রূপ কল্পনার মূল বৈশিষ্ট্যটি হলো জীব ও জগতের চরম বিপদের মুহূর্তে তাঁর রক্ষাকারীর ভূমিকা। দেবীপুরাণ গ্রন্থে দুর্গ রক্ষার সাথে তাঁর সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। তাই তাঁর নাম দুর্গা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশে বলা হয়েছে যে, দুর্গম ভবসাগরে তিনি নৌকাস্বরূপ, তাই দুর্গা। পদ্মপুরাণ অনুসারে মেনকার কন্যা মাতৃজঠরে থাকা কালেই ব্রষ্মা ও রাত্রিদেবীর ইচ্ছানুসারে তাঁকে কৃষ্ণাবর্ণা করে দেওয়া হয়। শিবের সাথে বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মতবিরোধের প্রেক্ষিতে ব্রহ্মাই তাঁকে শুভ্রবর্ণা করে দেন। তাঁর নাম হয় গৌরী। গবেষকদের মতে, কুশিক উপজাতির আরাধ্যা এই দেবী কৌশিক নামেও অভিহিত হন। দেবী দুর্গার সৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গে জনপ্রিয় ঘটনাটি হল তাঁর অসুর নিধনকারী ভূমিকা। দেবকুলে ত্রাস সৃষ্টিকারী মহিষাসুরকে বধ করার প্রয়োজনে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সহ বিভিন্ন দেবদেবীর ক্রোধজাত তেজোরাশি থেকে এই অপরূপা নারী দেবীর আবির্ভাব হয়। এই দেবী দুর্গা নামে বন্দিতা হন।
গবেষক রমাপ্রসাদ চন্দের মতে, দানবদলনী উগ্ররূপের পাশাপাশি দুর্গার একটি গৃহী রূপও আছে। এখানে তিনি শাকম্ভরী নামে পরিচিত। তিনি শস্যের দেবীরূপে বন্দিতা হন। তাঁর পূজা হয় নব পত্রিকায়। একটি কলাগাছের সাথে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বিল্ব, অশোক, মান ও ধান একত্রে বেঁধে শস্য-বধূ প্রতিষ্ঠা করে নব পত্রিকার প্রতীকে দুর্গার আরাধনা করা হয়।
দুর্গা শক্তির আধার। কিন্তু বাঙালীর শাক্ত উপাসনার কাজে দুর্গার স্থান প্রায় নেই। দুর্গা বাঙালীর জীবনে শারদীয়া দেবী এবং অনাবিল আনন্দ উৎসবের প্রতীক হিসেবেই প্রাধান্য পান। দুর্গা-পার্বতী, কালী-চণ্ডী একই দেবীর রূপভেদ হলেও, বাঙালীর ধর্ম চেতনায় দুর্গা-পার্বতী এবং কালী-চণ্ডী দুই স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবেই স্থান পেয়েছেন।
দেব-সেনাপতি কার্তিক :
কার্তিকও লৌকিক দেবতা, যিনি কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে স্থান করে নিয়েছেন। পণ্ডিতদের মতে, গ্রীস, মিশর প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতার উৎপাদনের দেবতা আদোনিস, অসিরিস প্রমুখের মতই ভারতে দেবতা কার্তিকও কৃষি-উৎপাদন ও প্রজননের দেবতা। প্রাচীনকালে কার্তিকের পূজা হত প্রতীকে। একটি মাটির পাত্রে বীজ বপন করে এবং সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত চারাগুলিই দেব-কার্তিকের প্রতীক রূপে পূজা পায়।
প্রাকৃতিক ও মানবীয় উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদন বা সৃষ্টির দেবতা রূপে কার্তিকের উপাসনা প্রচলিত আছে। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন পূজাপদ্ধতি মূলতঃ চান্দ্র তিথি অনুযায়ী স্থির করা হয়। কিন্তু কার্তিক পূজার ক্ষেত্রে মান্য করা হয় সৌর তিথি। একইভাবে কৃষিজ উৎপাদন বা জৈবিক প্রজননের ক্ষেত্রেও সৌরতিথি অনুসরণ করা হয়। জমিতে প্রথম হলকর্ষণ, বীজবপন ইত্যাদিতে যেমন সৌরতিথি গ্রহণ করা হয়, তেমনি গর্ভাধান, সাধভক্ষণ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও সৌরতিথি অনুসরণ করা হয়। প্রজনন ব্রতরূপে পালিত হয় অম্বুবাচী ব্রত (৭-১১ আষাঢ়)। একই সময়ে পৃথিবী দেবীও রজস্বলা থাকেন বলে মনে করা হয় এবং সে কারণে এই চারিদিন জমিতে হলকর্ষণ করা হয় না। তিথিগত সাযুজ্য কার্তিকের অস্তিত্বের সাথে উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্ক নির্দেশ করে। সাম্প্রতিক কালেও গৃহে গৃহে পুত্রার্থে কার্তিকের ব্রত পালন ও পূজাপাঠ অনুষ্ঠিত হয়।
সৌর সম্প্রদায় :
ঋগ্বেদে সৌর দেবতা অনেক। নানা নামে তাঁদের উল্লেখ আছে। সূর্য, সবিতা, পুষণ, মিত্র ইত্যাদি নামাঙ্কিত দেবতারা সৌরশক্তির অধিকারী ও নিয়ন্ত্রক হওয়ায় আদি বৈদিক পর্বে সৌর দেবতা হিসেবে সূর্যের বিশেষ মর্যাদা ছিল না। ভারতীয় সূর্য দেবতা হিসেবে মিত্র, মিহির ইত্যাদি নামকরণের উৎস ইরানীয় সূর্য দেবতা মিথ বলেই অনুমান করা হয়। পারসিকদের সূর্য-উপাসনা পদ্ধতির সাথে ভারতে সূর্য উপাসনার সাযুজ্য এই ধারণাকে জোরালো করে। ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে যে, কৃষ্ণপুত্র সাম্ব কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইরানীয় প্রথায় সূর্য-উপাসনার আয়োজন করেছিলেন। এজন্য তিনি মূলস্থানে (সম্ভবত মুলতানের বর্তমান ভগ্নপ্রায় সূর্য মন্দিরটি) একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন এবং ইরান থেকে সূর্য-উপাসক মগ ব্রাহ্মণদের এনে নিত্যপূজার ব্যবস্থা করেন। রামায়ণ ও মহাভারতে যথাক্রমে রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির কর্তৃক সূর্য-পূজার কথা জানা যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণেও সূর্য আরাধনার (১০৭-১১০ সর্গ) কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতের কুষাণ বংশীয় রাজারা সূর্যের উপাসক ছিলেন। কনিষ্কের মুদ্রায় ইরানীয় মিহিরের প্রতিকৃতি খোদিত ছিল। থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশীয় রাজারাও সৌর-উপাসক ছিলেন। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, হর্ষবর্ধন অন্যান্য দেবতাদের পাশাপাশি সূর্যেরও উপাসনা করতেন। উড়িষ্যার গঙ্গ বংশীয় রাজারাও সূর্য-উপাসক ছিলেন। সুপ্রাচীন ভারতের নানা মন্দিরে খোদিত সূর্যমূর্তি এবং সূর্য-মন্দিরের অস্তিত্ব সৌর-উপাসনার প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে। বোধগয়ার মন্দির, ভাজা গুহার গায়ে অঙ্কিত সূর্যমূর্তি, দ্বিতীয় বা তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে খোদিত মথুরার প্রস্তর মূর্তি, মুলতানের সূর্যমন্দির, কোনারকের সূর্যমন্দির (ত্রয়োদশ শতকে গঙ্গবংশীয় রাজা নরসিংহ বর্মনের উদ্যোগে নির্মিত), কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য নির্মিত মার্তণ্ড মন্দির ইত্যাদি এদেশে সূর্য-উপাসনার প্রতি সাধারণের আকর্ষণ নির্দেশ করে। বর্তমানে গায়ত্রী মন্ত্রোচ্চারণে সূর্য-উপাসনার রীতি এবং সীমিত ক্ষেত্রে স্নানান্তে সূর্যের স্তব পাঠ কিংবা নদী ও জলকেন্দ্রিক ধর্মাচারের সময় সূর্য দেবকে স্মরণের মধ্যেই মূলতঃ সূর্য-উপাসনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
মাতৃকাপূজা : শাক্তধর্ম
শাক্তধর্মের স্বাতন্ত্র্য হল যে, এখানে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী। নানা রূপে, নানা নামে সেই দেবীকে আহ্বান ও আরাধনা করা হয়। অন্যত্র দেবতাদের সহধর্মিণী রূপে দেবীদের কল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেবতারা শাক্ত দেবীদের অধীন। শাক্তপুরাণ অনুসারে স্বয়ং আদ্যাশক্তি তাঁর দেহ থেকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন এবং পরে নিজেকে বিভক্ত করে তাঁদের সহচরী হয়ে যান।
প্রাগৈতিহাসিক মানবজাতির ধর্মচেতনার মাতৃকা (Cult of Mother Goddess) দেবীর অস্তিত্ব ও আরাধনা বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিল। প্রাচীন প্রস্তর যুগের উত্তরকালে পশুশিকারী আক্ষেটিক মানবদল কর্তৃক মাটি, পাথর বা হাড়ের নির্মিত কিছু নারীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোকেই মাতৃকাদেবীর প্রাথমিক পরিকল্পনা রূপে চিহ্নিত করা যায়। জন ফার্গুসন ম্যাকমেনাল, এইচ. এল, মরগ্যান প্রমুখ নৃতত্ত্ববিদ মনে করেন যে, আদিম যুগে যৌনস্বেচ্ছাচারিতার ফলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। এই আদিম সমাজে সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে শুধুমাত্র নারীর অবদান স্বীকৃত ছিল। নতুন প্রাণের উৎসরূপিণী নারিজাতির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র সমাজের এক বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। এইভাবে মাতৃরূপিণী নারী ধর্মের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হন।
নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য আহরণকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। জি. থমসন মনে করেন, পশুচালিত লাঙ্গল আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত কৃষিরাজ উদ্ভাবনে নারীও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। নব্যপ্রস্তর যুগের সমাজে নারী সন্তানের জন্মদাত্রীর মর্যাদা পাবার পাশাপাশি শস্য-প্রসবিনী ধরিত্রী জননী রূপেও পূজা পেতে শুরু করেন। গ্রীস, রোম, ব্যাবিলন, এসিরিয়া, মিশর ইত্যাদি অধিকাংশ দেশেই এই ধারা জনপ্রিয় ছিল। লক্ষণীয় যে, এই পর্বেও সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা পুরোপুরি স্বীকৃত হয়নি। তাই দেবীরূপে কল্পিত ও পূজিতা নারী কুমারী বলেই চিহ্নিত হতেন। ক্রমে শস্যদায়িনী ও জন্মদাত্রী মাতৃদেবীর সাথে আনুসঙ্গিক অন্যান্য গুণাবলীরও সংযোজন ঘটে। বিশেষ গুণের অধিকারিণী নারী পৃথক পৃথক দেবীরূপে চিহ্নিত হন। এইভাবে ভিন্নরূপিণী মাতৃদেবীর কল্পনা দানা বাঁধে।
নব্যপ্রস্তর যুগ পর্যন্ত প্রচলিত ধর্মীয় মনোভাবের কোন সুস্পষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যগুলি থেকে প্রাচীন ও প্রস্তর যুগের মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস ও পূজা পদ্ধতির পরিচয় থেকে প্রাচীন ও প্রস্তর যুগের মানুষের ধর্মবিশ্বাস পূজাপদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। মহাভারতের ‘বিরাট পর্ব’, বাপতি’র ‘গৌড়বহ’ কাব্য, বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ ইত্যাদি গ্রন্থের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, আদি-অস্ট্রিক শিকারজীবী উপজাতি (নিষাদ, শবর ইত্যাদি) গুলি মাতৃ উপাসক ছিল। এদের বর্তমান উত্তরাধিকারী যেমন কেওনঝড়ের ‘ভুলিয়া’, ‘বেন্দকর’, ‘শবর’, হাজারীবাগের বীরহোড়, মধ্য ও পূর্ব-ভারতের মুণ্ডা, হো, পশ্চিম-ভারতের ‘ভীল’ ইত্যাদি উপজাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো দেবীপূজার প্রচলন আছে। প্রাচীন ভারতের ‘কিরাত’ নামক মোঙ্গল জাতিভুক্ত মানুষেরা এবং তাদের বংশধর খাসি, গারো উপজাতির ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে নারী বা মাতৃকাশক্তির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
ধাতুযুগের ভারতীয় সভ্যতার মূল কেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরোতে খননকার্যের ফলে অসংখ্য পোড়ামাটির মৃত্তিকা মূর্তি পাওয়া গেছে। পুরুষমূর্তির তুলনায় মাতৃকামূর্তির সংখ্যা অনেক বেশি। এই মূর্তিগুলির সাথে সমকালীন ইলাম, মেসোপটেমিয়া, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত নারীমূর্তির সাথে ভারতীয় মূর্তিগুলির সাদৃশ্য লক্ষণীয়। অনুমান করা যায় যে, শস্যদায়িনী ও জন্মদাত্রী দেবীরূপে এই পর্বে মাতৃকাদেবতার প্রাধান্য অব্যাহত ছিল। হরপ্পা-সংস্কৃতির সম্ভাব্য স্রষ্টা দ্রাবিড়-জাতির বর্তমান বংশধরদের মধ্যে যেমন, মধ্যপ্রদেশের গোন্দ, ছোটনাগপুরের ‘ওঁরাও’, মধ্য-ভারতের ‘খোন্দ’ উপজাতি এবং দক্ষিণ-ভারতীয় বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আজও মাতৃদেবী পূজার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
বৈদিক আর্যদের আমলে মানুষের বস্তুগত পরিবর্তনের সূত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উত্থান ঘটে। ফলে তাদের ধর্মের মূলকেন্দ্রে দেবীর পরিবর্তে দেবতাদের আগমন ঘটে। অবশ্য প্রাক্-আর্য যুগের মাতৃ-উপাসনার ধারাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া বৈদিক ঋষিদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। তাই ঋগ্বেদে পৃথিবীমাতা ‘অদিতি’কে ‘সর্বদেবময়ী সর্বেশ্বরী’ রূপে বন্দনা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাথে মাতৃ আরাধনার প্রাচীন রীতির সমন্বয়ে বহু দেবীর কল্পনা হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। মাতৃকাদেবী শক্তি, চণ্ডী, দুর্গা, উমা, চামুণ্ডা, পার্বতী, কালিকা ইত্যাদি নানা নামে পূজিতা হন।
শাক্তধর্ম-চেতনার সাথে ‘তন্ত্র’ বিশেষভাবে সম্পর্কান্বিত। শক্তির উপাসনা ও আনুসঙ্গিক আচার অনুষ্ঠান এক বিশেষ ধরনের সাধন পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা ‘তন্ত্র’ নামে পরিচিত। ‘তন্ত্র’কে ভাগবতীয় ধর্মের একটি শাখা বলে গণ্য করা হয়। ভক্তি, প্রেম ও আত্ম-নিবেদনের মাধ্যমেই তন্ত্রসাধনার মুক্তিলাভ ঘটে। অনুমান করা হয়, বেদ ও বেদান্তের মধ্যে তন্ত্রসাধনার বীজ লুকিয়ে আছে। বৌদ্ধদের তন্ত্রসাধনা ও মূর্তিপূজায় আকৃষ্ট হয়ে বহু হিন্দু বৌদ্ধধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠলে, পুরাণের ঋষিরাও নানা দেবদেবী ও পূজার মন্ত্র সৃষ্টি করেন। বেদে মূর্তির উল্লেখ নেই, কিন্তু তন্ত্রে আছে। অথর্ববেদে তন্ত্র পর্যায়ভুক্ত বহু মন্ত্রে দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদান্তের পুরুষ ও প্রকৃতির বর্ণনার অনুকরণ দেখা যায় তন্ত্রশাস্ত্রের শিব ও শক্তি’র কল্পনায়। বেদান্ত-পরবর্তী যুগে যোগসাধনায় যে অলৌকিক ক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটেছিল, তন্ত্রশাস্ত্রে তার প্রভাব স্পষ্ট।
তন্ত্রসাধনার কাজটি খুবই জটিল ও কঠিন। বেদাচার, শৈবাচার, দক্ষিণাচার ইত্যাদি তন্ত্রাচার পালন করে সাধককে বামাচারে প্রবেশ করতে হয়। এই বামাচারে তন্ত্রসাধক ‘পঞ্চমকার’ (মদ, মাংসা, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন) পালন করে সাধনায় সিদ্ধিলাভের অধিকারী হন। বেদান্তে ত্যাগের অনুশীলন দ্বারা মুক্তিলাভের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। (‘তক্তেন ভূঞিথা’)। কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, চরম ভোগের মধ্য দিয়েই ত্যাগের চেতনা জাগ্রত হতে পারে। (“ভোগেন লভতে যোগম্ ভোগেন মোক্ষ মাপুয়াৎ)। এই কারণে পঞ্চমকার সাধনাকে ভোগের ভিত্তি হিসেবে না দেখে —ভোগ-বাসনার’ অবসানের চরম পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শক্তি সাধনার বিকাশ :
হরপ্পা সংস্কৃতির যুগ থেকে শুরু হয়ে ঋগ্বেদের ‘রাত্রিসূক্ত’, ‘দেবীসূক্ত’ এবং শ্রীসূক্তর মধ্যে পরবর্তীকালের শাক্ত সাধনার বীজ লালিত হয়েছিল। রাত্রিসূক্তের রাত্রিদেবীকেই কেউ কেউ পরবর্তীকালের কৃষ্ণা-ভয়ঙ্করী কালীর প্রতীক বলে মনে করেন। মুণ্ডক উপনিষদে ‘কালী’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য কালী কোন স্ত্রী দেবতার নাম নয়। বৈদিক ধর্মাচরণের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কালী যেখানে যজ্ঞাগ্নির সপ্তজিহ্বার একটি জিহ্বা হিসেবে বর্ণিত। লালজিহ্বা, রক্তনয়না, দানবদলনী ভয়ঙ্করী কালীর উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় মহাভারতে। এখানে তিনি অসুরনাশিনী, কুমারী বিন্ধ্যপর্বতবাসিনী। ভক্তবৃন্দকে নানা প্রকার দুর্নীতি থেকে রক্ষা করেন বলে তিনি ‘দুর্গা’ নামেও খ্যাত। হরিবংশের ‘আর্যস্তবে’ সুন্দর বাসিনী, কালী, কাপালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, চণ্ডী, কাত্যায়নী ইত্যাদি বহুনামাঙ্কিতা দেবী অরণ্য ও পর্বতাচারী শবর, পুলিন্দ, বর্বর প্রভৃতি উপজাতির আরাধ্যা বলে বর্ণিত হয়েছেন। তিনি বিবসনা, ভক্তদের ত্রাতা। তাই তাঁর অন্য নাম ‘তারা’।
শাক্তধর্মের বিকাশ প্রসঙ্গে পুরাণগুলিতে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এমনতর প্রাচীনতম ব্যাখ্যাটি আছে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ‘চন্ডী’ অংশে। এখানে বলা হয়েছে যে মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতাগণ বিন্নু ও মহাদেবের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মুখ থেকে তেজোরাশি নিঃসারিত হয়। এর সঙ্গে অন্যান্য দেবগণের দেহ-নির্গত তেজ মিলিত হয়ে এক অপূর্ব নারীর সৃষ্টি হয়। কাত্যায়নী, দুর্গা, ভদ্রকালী, অম্বিকা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন স্তবের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ বর্ণনা করা হয়েছে। যুগে যুগে দুর্গা, ভীমা, শাকম্ভরী, রক্তদন্তিকা ইত্যাদি নানা নামে অবতীর্ণ হয়ে দানবদলন ও সৃষ্টিকে রক্ষা করেন। এখান থেকে জানা যায় যে দেবী পার্বতী হিমালয়ে কালিকা নামে সমাখ্যাতা ছিলেন এবং পার্বতী বা অম্বিকার ভ্রুকুটি ললাট ফটক থেকে করালবদনা কালী আবির্ভূত হয়েছেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে ইনি পার্বতীর কৃষ্ণবর্ণ কোষ থেকে উদ্ভূত বলে এঁর অন্য নাম কৌশিকী। কালিকাপুরাণেও এই মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অধ্যায় অনুসারে দেবতাদের অনুরোধে শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য পার্বতীর দেহ থেকে কৌশিকী দেবী নির্গত হলে পার্বতী নিজেই কৃষ্ণাবর্ণা হয়ে যান। তাই তাঁর অন্য পরিচয় হিমালয়বাসিনী কালিকা।
দশম শতকের পরবর্তীকালে পাঁচশ বছরের মধ্যে কালী মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক বহু তন্ত্রসাহিত্য রচিত হয়েছে। দেবীর কালী রূপের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রচিত এ-ধরনের গ্রন্থগুলির অন্যতম হল গুহ্যকালী উপনিষদ, দেবী ভাগবত, মহাকাল-সংহিতা, কালীতন্ত্র, তন্ত্রসার, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ ইত্যাদি। আগেই দেখেছি যে, হরপ্পা সভ্যতার কাল বা তার আগে থেকেই ভারতে শক্তি-সাধনার অস্তিত্ব ছিল। তবে তার রূপভেদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক শাক্তধর্মের বিকাশকাল হিসেবে পঞ্চদশ শতকের পরবর্তী কাল গুরুত্বপূর্ণ। এই শতকের গোড়ার দিকে বিশিষ্ট সাধক মাধবাচার্য ভারতে প্রচলিত ষোলটি দর্শনের সংকলক গ্রন্থ ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ রচনা করেন। কিন্তু এখানে শৈবদর্শনের উল্লেখ থাকলেও, শাক্তদর্শনের কোন উল্লেখ নেই। সম্ভবত সেই সময়েও শাক্তদর্শন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। হয়ত তখন শাক্ত সাধনা একটি রহস্যময় গুহ্যসাধনা হিসেবেই প্রচলিত ছিল। পঞ্চদশ শতকের গ্রন্থ ‘তন্ত্রসার’ ষোড়শ শতকের ‘সর্বোল্লাসতন্ত্র’, ‘তারারহস্য’ এবং মঙ্গল কাব্যসমূহ ও শাক্ত পদাবলীর রচনা ক্রমে শক্তি-আরাধনাকে একটি স্বাতন্ত্র্য দর্শনের রূপ দেয়। জনপ্রিয়তা পায় শাক্তদর্শন।
ভারতে শক্তিসাধনার যে ধারাটি বর্তমানে জনপ্রিয় হয়েছে তাকে ‘সমন্বয়জাত মিশ্রধারা’ বলে অনেকে মনে করেন। এখানে দ্রাবিড় সংস্কৃতি ও আর্য সংস্কৃতির প্রভাব যেমন আছে, তেমনি বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত ধর্মের প্রভাবও বিদ্যমান। বৈদেশিক সংস্কৃতির প্রভাবও উপেক্ষণীয় নয়। ‘শক্তিসাধনায় বশিষ্ঠ প্রবর্তিত ‘চীনাচার’ নামক জনপ্রিয় সাধন পদ্ধতির আদি কেন্দ্র ছিল সম্ভবত হিমালয় সন্নিহিত তিব্বত, নেপাল, ভুটান ও কামরূপ রাজ্য। ভারতে শক্তিরূপী মাতৃসাধনা অঞ্চলভিত্তিক তিনটি ধারায় প্রবহমান। বিন্ধ্য-পর্বতের দক্ষিণে এর নাম ‘অশ্বক্রান্তা’। বিন্ধ্যর উত্তরদিকে কাশ্মীর পর্যন্ত এটি ‘রথক্রান্তা’ নামে পরিচিত। আবার বিন্ধ্য পর্বত থেকে পূর্বমুখে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রচলিত ধারাটির নাম ‘বিন্নুক্রাত্তা’। শক্তিসাধনার সবচেয়ে অগ্রণী রাজ্য বঙ্গদেশে শাক্তসাধনা ‘কালীকুল’ নামে পরিচিত। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত আসমুদ্র হিমাচল ভারতভূমিতে শক্তিসাধনা প্রচলিত আছে। তবে ব্যাপকতা ও জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাদেশ অবশিষ্ট ভারতকে অবশ্যই ছাড়িয়ে গেছে। বাঙালীর নিত্যদিনের চিন্তা চেতনায় কালীর স্থান সর্বাগ্রে।
শাক্ত / তান্ত্রিক দেবীগণ :
শক্তিসাধনা বলতে সাধারণভাবে আদ্যাশক্তির সাধনাকে মনে করা হয়। আদ্যাশক্তির আদি উৎস মহামায়া দুর্গা। শিব-জায়া পার্বতী দেবকুলের প্রার্থনা রক্ষার্থে ‘কৌশিকী’ রূপে আবির্ভূতা হন। তবে বাংলাদেশের তন্ত্র সাধনার কেন্দ্রে আছেন কালিকা। ভারতের নানা স্থানে পূজিতা চণ্ডীও এখানে কালী নামে পূজিতা হন। তন্ত্রসাহিত্য, পুরাণ ও উপপুরাণগুলিতে দুর্গা, চণ্ডী, পার্বতী, কালী প্রভৃতিকে কোথাও কোথাও অভিন্ন দেখানো হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পার্বতী, দুর্গা ও চণ্ডীকে মূলাশক্তি রূপে চিহ্নিত করে রুপভেদে কালীর প্রকাশ বলে মনে করা হয়েছে। এইভাবে আদ্যাশক্তি-ভাবনার উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনে কালীই হয়ে উঠেছেন মহাদেবী বা সর্বমুলা আদ্যাশক্তি এবং শক্তিসাধনা প্রধানত আবর্তিত হয়েছে কালীকে কেন্দ্র করেই।
বর্ণমালার আদ্যাক্ষর দিয়ে মাতৃকাদেবীর নামকরণ করার ধারা লক্ষ্য করা যায়। বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণে একজন করে অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কল্পনা করা হয়েছে—
অ—বর্গে তু মহালক্ষ্মী ক—বর্গে কমলোদ্ভবা।
চ—বর্গে তু মহেশানী ট—বর্গে তু কুমাররিকা।
নারায়ণী ত—বর্গে তু বরাহী তু পবনিকা।
ঐন্দ্রী চৈব য—বৰ্গস্থা চামুণ্ডা তু শ—বর্ণিকা।
এতা সপ্তমহামাতর সপ্তলোক ব্যবস্থিতা। (স্বচ্ছন্দতন্ত্র)।
মাতৃকা দেবী ছাড়া তান্ত্রিক দেবীদের অন্যতমা হলেন দশজন মহাবিদ্যা স্বরূপিণী দেবীকা –
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতে দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্তিতা।
বলাবাহুল্য, দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবীই শক্তি সাধনার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব পান।
দেবী কালীকা দ্বৈত রূপে পূজিতা হন–দক্ষিণাকালীকা ও বামা কালীকা। দক্ষিণা কালীর জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। সকলেই দক্ষিণাকালীর পূজা করতে পারেন। তবে তন্ত্রভিত্তিক রহস্যপূজা’র অধিকারী একমাত্র দীক্ষিত তান্ত্রিকগণ। বামাকালীর পূজা কেবল সন্ন্যাসীরা করতে পারেন। উভয়ের ধ্যানমন্ত্রে কিছু স্বাতন্ত্র্য আছে। এছাড়াও শ্যামাকালী, শ্মশানকালী, রক্ষা কালী ইত্যাদি নানা নামে কালী পূজার প্রচলন শাক্তধর্মের অন্তর্ভুক্ত আছে।
শাক্ত ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে তিনটি ভাবসাধনার অস্তিত্ব আছে— পশুভাব, বীরভাব এবং দিব্যভাব। পঞ্চ‘ম’ কার অর্থাৎ মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন প্রতিটি ভাবসাধনার সাথেই সম্পৃক্ত। তবে তাদের প্রকৃতিগত ভেদ আছে।
যাঁরা পশুভাবের সাধক তাঁরা স্থূল পঞ্চম’কার সহযোগে সাধনার চেষ্টা করেন। বলাবাহুল্য এই দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাহীন শক্তিচর্চা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনেকে একে ব্যভিচারিতার নামান্তর বলেই নিন্দা করেন। বীরভাবের সাধকদের কাছে পঞ্চ’ম’ উপাচার হিসেবে প্রতীকি রূপে উপস্থিত থাকে। সাধকগণ আত্মসংযম, একাগ্রতা ও সংকল্পের শক্তি দ্বারা স্থূল পঞ্চ‘ম’-কারকে নির্বাকারভাবে গ্রহণ করে সাধন পথে এগিয়ে যান। সাধক কৃষ্ণানন্দ, বামদেব, রামপ্রসাদ প্রমুখ মহান তন্ত্রসাধকদের সবাই বীরভাবের অনুসারী। বীরভাবের সাধনা সম্পূর্ণ করেই উচ্চতম তন্ত্রসাধনার স্তর দিব্যভাবে প্রবেশ করা যায়। দিব্যভাবের সাধক অবতার স্বরুপ। শ্রীরামকৃষ্ণ দিব্যভাবের সাধক ছিলেন বলে মনে করা হয়।
তান্ত্রিকদেবীদের অনুচর হিসেবে পরবর্তীকালীন বহু তান্ত্রিক গ্রন্থে ডাকিনী, যোগিনী, শাকিনী প্রমুখের উল্লেখ আছে। সম্ভবত তিব্বতীয় ধারণার অনুবর্তী হয়ে এই সকল অনুচরের আবির্ভাব ঘটেছে।
শক্তি সাধনার মূল লক্ষ্য হল সাধকের অন্তর্নিহিত সৎ-শক্তির জাগরণ ঘটানো। এই জাগরণের মধ্য দিয়ে তার পশুসত্তা ও দানবসত্তার বিনাশ ঘটে এবং শিবসত্তার উপলব্ধি সম্পন্ন হয়। শৈব-সত্তার বিকাশের জন্য সাধককে কতকগুলি আচার পালন করতে হয়। আচারের সংখ্যা সাত। সাধকের মার্গ-পরিপ্রেক্ষিতে আচার নির্দিষ্ট হয়। আচারগুলির নাম বেদ, বৈষুব, শৈব, দক্ষিণ, বাম সিদ্ধান্ত ও কৌল। প্রথম তিনটি আচার ‘পশুভাব’ সাধকের জন্য। চতুর্থ ও পঞ্চম আচার ‘বীর ভাব’ সাধকের জন্য এবং শেষ দুটি ‘দিব্যভাব’ সাধকের জন্য নির্দিষ্ট। প্রথম আচারটি দেহ ও মনকে শুচিশুদ্ধ করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় আচার যথাক্রমে ভক্তি ও জ্ঞানের সঞ্চার করে। চতুর্থটি অর্থাৎ ‘দক্ষিণ’ আচারের মাধ্যমে প্রথম তিনটি সাধনলব্ধ জ্ঞানকে সমন্বিত করা হয়। পঞ্চমটি ‘ত্যাগ’ ও ষষ্ঠটি ত্যাগের উপলব্ধির জন্য পালনীয়। সপ্তম আচারটি মোক্ষের জন্য নির্দিষ্ট। তবে প্রথম পাঁচটি আচারের পালনে গুরুর পরামর্শ ও সাহচর্য প্রয়োজন। কিন্তু শেষ দুটি ক্ষেত্রে সাধক স্বাধীন। তন্ত্র সাধনা বস্তুত সাধারণ সাধন-ভজন নয়। একে বলা হয় ‘সাধন-সমর’। পশুভাব থেকে দেবভাবে (শিব) উত্তরণের জন্য আধ্যাত্মিক সংগ্রামের নামই তন্ত্রাচার।
বঙ্গদেশে কালীসাধনা :
বঙ্গদেশ তথা বাংলায় শক্তিসাধনার ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। এখানে দুর্গা, চণ্ডী বা দশমহাবিদ্যার প্রকাশ মূলত কালীর মধ্য দিয়েই দেখা যায়। কথায় আছে, “যেখানে বাঙালী সেখানেই মা কালী।” প্রাচীন শাস্ত্রেও উল্লেখ পাওয়া যায় যে বঙ্গদেশে দেবী আদ্যাশক্তি কালিকা নামেই পূজিতা হন (কালিকা বঙ্গদেশে চ)। সহস্রাধিক বছরেরও প্রাচীন কালীক্ষেত্র কালিঘাটের আলুলায়িত কেশরাশি, লোল জিহ্বা, বরাভয়দায়িনী দেবীর প্রতিষ্ঠা সত্যযুগে। দক্ষযজ্ঞ কালে সতীর ডান পায়ের কনিষ্ঠা অঙ্গুলির পতন এখানেই ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
ইতিহাসগতভাবে বাংলায় কালী সাধনার সময়কাল পঞ্চদশ শতক। কালীর প্রচলিত মূর্তি নবদ্বীপের শক্তিসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ধ্যানযোগে প্রত্যক্ষ করেছেন বলে কথিত আছে। তাঁর ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থ কালীর রূপ বর্ণনা ও পূজাপদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ আছে। পঞ্চদশ শতকের আর এক বিখ্যাত তন্ত্রসাধক ছিলেন সর্বানন্দ পরমহংস। ষোড়শ শতকে তন্ত্রসাধক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন ব্রহ্মানন্দ গিরি ও তাঁর শিষ্য পূর্ণানন্দ। অষ্টম শতকে বাংলাদেশে শক্তি সাধনাকে গৃহীর অন্দরমহলে নামিয়ে আনেন সাধক রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১ খ্রিঃ)। অসংখ্য সংগীত রচনা করে তিনি শক্তি সাধনাকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মধ্যে পৌঁছে দেন। স্বামী পূর্ণানন্দ লিখেছেন, ‘তাঁর (রামপ্রসাদ) শাক্ত গীতিতে সাধনা এবং দর্শনের এক অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর সাধনায় তিনি বীরভাবের সাথে দিব্যভাবের সমন্বয়সাধন করেছিলেন। তারাপীঠ মহাশ্মশানকে কেন্দ্র করে সাধক বামদেবের (১৮৩৮-১৯১১ খ্রিঃ) কর্মকাণ্ড প্রতিটি বাঙালীর জানা। তাঁর আসল নাম বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ডাক নাম বামদেব। তবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত সাধক বামাক্ষ্যাপা নামে। মা কালীকার সাধনাকে কেন্দ্র করে তাঁর অদৃষ্টপূর্ব ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ সাধারণ মানুষের কাছে এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে, তাঁকে এই নামে মানুষ শ্রদ্ধা জানায়।
বাংলায় শক্তি-উপাসনাকে এক নতুনতর মাত্রা দেন শ্রীরামকৃয় (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রিঃ)। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার নানা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। পুঁথিগত শিক্ষা তিনি পাননি। দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দিরের পূজারী হিসেবেই তাঁর জীবন কেটে যায়। কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা মধ্যাহ্নের সূর্যের মত যেমন তাপ বিকিরণ করে, তেমনি মধ্যরাত্রির পূর্ণিমার চাঁদের মতই মানুষের মনে স্নিগ্ধতার পরশ মাখিয়ে দেয়। ভৈরবী যোগেশ্বরীর কাছে তিনি তন্ত্র সাধনার দীক্ষা নেন। মাত্র তিন বছর সাধনার মাধ্যমেই তিনি ৬৪টি তন্ত্রের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তন্ত্রে সিদ্ধলাভের এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
রামকৃষ্ণ শক্তিসাধনার প্রথাগত পদ্ধতির প্রায়োগিক পরিবর্তন ঘটান। পঞ্চ ‘ম’-কার সাধনার ক্ষেত্রে লৌকিক প্রচ্ছন্ন ভোগবাদী প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করেন। সাধনার অনুসঙ্গ হিসেবে পঞ্জ ‘ম’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘কারণ’ (মদ) ও ‘সাধন সঙ্গিনী’ হিসেবে স্ত্রীলোক গ্রহণকে তিনি সাধনার বিকৃতি বলেই মনে করেন। আধ্যাত্ম চেতনায় মগ্ন হয়ে কঠোর সংযমের দ্বারা শক্তির শরণাপন্ন হওয়াতেই তিনি সিদ্ধিলাভের পথ খুঁজে পান। বস্তুত শক্তিসাধনার নামে কিছু অজ্ঞান মানুষের ধর্মীয় বিকৃতির মূর্ত প্রতিবাদ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ইতিপূর্বে শক্তিসাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তসাধনার সাথে ভক্তি ও ভালবাসার যে সমন্বয় ঘটিয়ে ছিলেন, তাকেই যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাসহ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন শ্রীরামকৃষ্ণ। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ লিখেছেন, “আপন অসাধারণ সাধনার দৃষ্টান্তে শ্রীরামকৃষ্ণ শক্তি সাধনার ধারাকে শুধু নতুন মাত্রা, গভীর দ্যোতনা ও প্রবল শক্তিদানই করেননি, শাস্ত্রোক্ত ঐ সাধনার সারবত্তাকেও পূর্ণভাবে প্রমাণ করেছেন এবং ঐ সাধনাকে তারমূল গৌরবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দর্শন-ভিত্তিক হিন্দুধর্মে বিভ্রান্তি যেমন প্রবল, বিরোধও তেমনি প্রকাশ্য। শৈব-শাক্ত-বৈষুববাদের বিরোধ, দ্বৈত-অদ্বৈত-বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মধ্যে বিরোধ হিন্দু ধর্মতত্ত্বকে সাধারণ মানুষের কাছে স্বরূপে অধরা করেই রেখে দিয়েছিল। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সম্প্রদায়ের একাদেশদর্শী ও পরমত-অসহিষু মানসিকতা কার্যত সমগ্র হিন্দুধর্মাবলম্বীদেরই স্বতন্ত্র কুষ্ঠীতে আবদ্ধ করে রেখেছিল। সেই অচলায়তন নীরবে ভেঙে দেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর বিচারে অদ্বৈত বেদান্তের ‘ব্রয়’ এবং তন্ত্রবাদের ‘শক্তি’ অভিন্ন। শ্রীরামকৃষ্ণ অতি সহজ উপমা দিয়ে ব্রষ্ম ও শক্তির অভিন্নতা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘স্থির জল হল ‘ব্রহ্ম’, আবার সেই জলে যখন ঢেউ খেলছে তখনই তা ‘শক্তি’। ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়, শক্তি সক্রিয়। আসলে উভয়ই এক; একই শক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।
Leave a comment