অথবা, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
অথবা, প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্য আলোচনাপূর্বক এর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : সমগ্র প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চর্যাপদ’ একটি বিস্তৃত বিশাল গৌরবের অধ্যায়। ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের পুথিশালা থেকে কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে সেগুলোকে ‘হাজার বছরের পুরানো বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন। তিনি চর্যার যাবতীয় রচনাকে ‘বাংলা’ ভাষায় রচিত বলে অভিহিত করেছেন। প্রাচীন বাংলা ভাষা বিষয়ে আলোচনার মূলগ্রন্থ চর্যাপদ। বাংলা ভাষায় চর্চার চেয়ে প্রাচীনতম আর কোনো গ্রন্থের সন্ধান আজও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের নিদর্শন রূপে চর্যাপদই একমাত্র প্রধান অবলম্বন।
চর্যাপদের কবিগণ: বৌদ্ধগানগুলো সাধারণভাবে ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি’ নামে পরিচিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গ্রন্থটির প্রকৃত নাম অনুমান করেছিলেন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়; ড. সুকুমার সেন মনে করেন এর নাম হওয়া উচিত ‘চর্যাচশ্চবিনিশ্চয়’। গ্রন্থের মধ্যে মুনিদত্তের টীকায় এটিকে ‘আশ্চর্য-চর্যাচয়’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ‘চর্যাগীতি’ গ্রন্থটি পাওয়া যায় খণ্ডিত আকারে। এতে ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ এবং একটি আংশিক পদ পাওয়া যায়। তাই চর্যাপদের পদ সংখ্যা সাড়ে ছেচল্লিশটি। এর কবির সংখ্যা ২৩ জন। চর্যাগীতির কবিরা ছিলেন সহজিয়াপন্থি বৌদ্ধ। সাধারণত এদের ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে অভিহিত করা হয়। চর্যাগীতিকার মধ্যে যে সকল পদকর্তা বা সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কাহ্নপা। এর পদের সংখ্যা ১৩টি। ভুসুকপ ছিলেন চিত্রধর্মী কবি, এর রচিত পদের সংখ্যা ৯টি। সরহপা ও কুকুরী পা প্রত্যেকে ৪টি করে পদ রচনা করেন। কাহ্নপা এবং সরহ পা অবহটঠ ভাষায় কয়েকটি দোহাও রচনা করেছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন নাথগুরু মীননাথ ‘লুইপা’ নামে দুটি পদ রচনা করেন। শান্তপা এবং সবরীপারও দুটি করে পদ পাওয়া যায়। অন্যান্য সকল পদকর্তাদের ১টি করে পদ পাওয়া যায়।
চর্যাপদের বিষয়: চর্যাগীতিতে যে চর্যাগুলো সংকলিত হয়েছে, তা মূলত আধ্যাত্মিকতা নির্ভর। গীতিকার পদকর্তাগণ তাঁদের সাধন ভজন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন বলে এগুলোকে সংকেতে তথা ইঙ্গিতবহ রূপকের সাহায্যে পদগুলোকে প্রকাশ করেছেন। সাধারণভাবে পদগুলোতে যে অর্থ পাওয়া যায়, তাতে সমাজ সংসারের বিচিত্র পরিচয় পাওয়া গেলেও তা গীতিকারের উদ্দিষ্ট নয়। এর অন্তর্নিহিত যে অর্থ যা গুরুমুখ থেকেই শুধু পাওয়া যেতে পারে, সাধন ভজন সম্পর্কিত সেই সমস্ত তত্ত্ব এবং তথ্যই পদগুলোর প্রকৃত বিষয়বস্তু।
চর্যাপদের ভাষা: মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের যাবতীয় রচনার ভাষাকেই ‘বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন। এর ভাষা সম্পর্কে অনেক মতপার্থক্য বর্তমান থাকলেও মনীষী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতান্ত্রিক যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছেন যে চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা। অবশ্য ওই সময় উড়িষ্যা ভাষা এবং অসমীয়া ভাষা বাংলা। ভাষার সাথে অভিন্নভাবে যুক্ত থাকায় এদের দাবিও উপেক্ষা করা। যায় না। চর্যাপদের ভাষাকে বলা হয় ‘সান্ধ্যভাষা’ বা ‘আলো- আঁধারি ভাষা’। আসলে এই নাম দুটি ভাষার পরিচয় নয়; বিষয়বস্তুর পরিচয় বহন করে। বজ্রযানপন্থি বৌদ্ধগণ একসময় সহজিয়াপস্থি হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সাধন পদ্ধতিকে গুহ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। তখন তারা এমনভাবে ভাষা সংকেতে প্রকাশ করে যে, অপর সাধারণের পক্ষে এর মর্মগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এদের শেষ কথা হলো ‘গুরু পুচ্ছিআ জান’ অর্থাৎ গুরুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। আর এই কারণেই চর্যাপদের ভাষাকে ‘সান্ধ্যভাষা’ বলে।
চর্যাপদের মূল দর্শন: সহজিয়াপন্থিরা তাঁদের সাধনতত্ত্বকে বিভিন্ন রূপকের সাহায্যে প্রকাশ করেছেন। হয়তো হিন্দুদের বিষয়ে তাদের প্রতিকূল মনোভাবের জন্যই তারা এই গোপনীয়তাকে অবলম্বন করেছিল। চর্যার টীকাকার মুনিদত্ত চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে একে শূন্যবাদ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন- “শূন্যতাই একমাত্র সত্য- শূন্যতার মধ্যেই সুখ-দুঃখের লোপ ঘটে এবং এতেই মহাসুখের অস্তিত্ব নিহিত। এটাই অদ্বয় ও সহজ অবস্থা। একমাত্র গুরুর উপদেশেই মহাসুখময় নির্বাণ লাভ করা যেতে পারে। এর জন্য যোগ সাধনাদির প্রয়োজন নেই। মোটামুটি এটাই চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্ব।”
চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য: প্রকৃত কাব্যসাহিত্যে রসের আবেদনকেই মূল বিষয় বলে গ্রহণ করা হলেও চর্যাপদের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, বক্রোক্তি ধ্বনিকেও একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। চর্যাপদের বিশ্লেষণে এদের উপস্থিতি অবশ্যই মেনে নিতে হয়। তত্ত্বদর্শনে প্রতিটি চর্যাকারদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল একথা মেনে নিলেও তারা যে তত্ত্বকথাকে নানাপ্রকার রূপক প্রতীকের সহায়তায় বিভিন্ন চিত্রকল্পের মাধ্যমে অনির্বাচনীয় করে তুলেছিলেন, এ কথাও স্বীকার করার উপায় নেই। চর্যার সাহিত্য মূল্যায়নের একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে চর্যার পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্যে কবিদের যে নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়, চর্যাপদগুলো ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। চর্যাপদে কবিদের ব্যক্তিসম্পর্ক সুনিবিড় এবং এ কারণেই এর পদগুলো কেবল কবিতা নয়, একেবারে গীতিকবিতার পর্যায়ে স্থান লাভ করার যোগ্য। চর্যাপদগুলোতে বাঙালির স্বভাবধর্মেরই পরিচয় পাওয়া যায়। চর্যাপদের বা রহস্যময় রূপকটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সমালোচক বলেছেন- “অনুভূতির অনির্বাচ্যতা ব্যঞ্জনাময় প্রকাশগীতিকে আশ্রয় করে অপূর্ব রহস্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।”
চর্যাপদের সমাজচিত্র: ঐতিহাসিক বিচারে চর্যাপদগুলোর রচনাকাল প্রাচীন যুগের শেষ পর্যায়ে। সময়টা যে বাঙালির জীবনে আশাব্যঞ্জক ছিল না তা স্বীকার করতেই হয়। পদকর্তাগণ ধর্মীয় সাধনতত্ত্বগুলোকেই চর্যাপদে ব্যবহৃত করতে চাইলেও এর জন্য তাঁরা যেসব রূপক প্রতীকের সহায়তা নিয়েছেন, তাতে সমসাময়িক সমাজজীবনের বহু খণ্ডচিত্রই সুস্পষ্ট আকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। চর্যার পদকর্তাগণ ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থি সাধক, কাজেই সমাজের অভিজাতবর্গ কিংবা উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের সাথে তাদের সম্পর্ক মধুর থাকার কথা নয়, ফলে চর্যায় সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে উচ্চবিত্ত অংশ অনুপস্থিত। চর্যাপদের মধ্যে যে সমাজচিত্র ও বাস্তব জীবনযাত্রার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাতে একদিকে সমাজের এই ভেদবিভেদ এবং বৈষম্যের চিত্র, অন্যদিকে দুঃখপূর্ণ দরিদ্র জীবনযাত্রার পূর্ণাঙ্গ বা খণ্ডবিচ্ছিন্ন উপাদান লক্ষ করা যায়।
চর্যাপদের শ্রেণিভেদ : চর্যার যুগে সমাজে শ্রেণিবিভাগ স্পষ্ট আকার ধারণ করেছিল। সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকেরা ছিল অবজ্ঞাত এবং আর্থিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। এদের বাসস্থান ছিল নগরের বাইরে। এদের চলতে হতো উচ্চবর্ণের স্পর্শ বাঁচিয়ে। কিন্তু উচ্চবর্ণের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তা নয়, বরং উচ্চবর্ণের মনস্তুষ্টির জন্য ডোম্বীদের আতিশয্য কিছুটা সংশয়ই তৈরি করে। এসব অন্ত্যজ অস্পৃশ্য শ্রমিকদের বৃত্তি অর্থকরী কিংবা প্রশংসীয় ছিল না। এদের কেউ ছিল তাত-বোনা তাঁতী, চাঙ্গড়ী প্রস্তুতকারী ডোম্বী, নৌকাবাহক জেলে বা নেয়ে। এছাড়া ছিল শুড়ি যারা মদ তৈরি করতো, ছিল নট-সম্ভবত এরা লেটোর দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে নেচে গান করে বেড়াত।
চর্যাপদে ধর্মীয় বিবর্তন: বৌদ্ধ ধর্মীয় পালরাজাগণের সমুন্নতি ও পতন এবং ব্রাহ্মণ ধর্মালম্বী সেনরাজদের উত্থান ও পতনকালের পটভূমিকায় চর্যাপদগুলো রচিত হওয়াতে এগুলোর মধ্যে সমকালীন ধর্ম বিবর্তনের পরিচয় চিহ্ন বর্তমান। গীতিকার পদকর্তাগণ ছিলেন সহজিয়াপন্থি বৌদ্ধ। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব সহজিয়া এবং বাউল সাধকদের মধ্যে এই ধারার রেশ বর্তমান ছিল। একালে ধর্মীয় জীবনেও যে অবক্ষয় চিহ্ন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তারও পরিচয় পাওয়া যায় পদগুলোতে। হিন্দু সমাজে দেখা দিয়েছিল নানা অনাচার ও ব্যভিচার। বর্ণভেদপ্রথা শুধু কঠোরভাবে অনুসৃতই হতো না, উচ্চবর্ণের লোকেরা সেই সুযোগ গ্রহণ করে নিম্নতর শ্রেণির উপর যথেষ্ট অত্যাচারও চালাতেন। বৌদ্ধরাও অবক্ষয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল বলেই এই যুগের অবসানেই তারা সমাজজীবন থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, চর্যাপদের তত্ত্বকথায় যা থাকুক না কেন, সেখানে চিত্র ফুটেছে সাধারণ মানুষের জীবনের। চর্যাপদের পটভূমি যে নদীমাতৃক বাংলাদেশের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মগধ, উড়িষ্যা, বাংলা ও কামরূপ- এসব অঞ্চলের বিস্তৃত পটভূমিকায় চর্যার জীবনচিত্র অঙ্কিত হলেও বাঙালির জীবনচিত্র হিসেবে বিশেষ দাবি অযৌক্তিক নয়।
Leave a comment