বাংলাসাহিত্যে যুগের হিসেবে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আধুনিক যুগ শুরু। শ্রীরামপুরে মিশন স্থাপন ও মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং কোলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন কালকেই আমরা সাধারণভাবে বাংলাগদ্যের প্রারম্ভযুগ বলে অভিহিত করে থাকি। কিন্তু বাংলাভাষা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই যে বাংলা গদ্যের উদ্ভব ঘটেছিল, এই সহজ সত্যকে কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না এবং সাহিত্যে গদ্যের ব্যবহার যথেষ্ট বিলম্বিত হলেও চিঠিপত্রে, দলিল দস্তাবেজে, ধর্ম ব্যাখ্যা আদি প্রয়োজনে যে গদ্যের লিখিত রূপও প্রচলিত ছিল, তার যথেষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ একালেও এসে পৌঁছুতে পেরেছে। সবকালেই বাংলার কথোপকথনের ভাষা ছিল গদ্যাশ্রয়ী, তৎসত্ত্বেও যে গদ্যসৃষ্টিতে কেউ কখনো উৎসাহবোধ করেননি, তার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর ‘সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়ে’ (দ্বিতীয় খণ্ড) বলেন, “জীবনযাত্রায় জটিলতার অভাব, ভাবাবেগের প্রবলতা, যুক্তিবুদ্ধির অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি মুদ্রণযন্ত্রের অভাবের জন্যই সাধারণ মানুষ মনের ভাব প্রকাশের ব্যাপারে কাব্য ভাষাকেই অপেক্ষাকৃত উপযোগী বলে বিবেচনা করতেন। তাই বাংলা ভাষার উদ্ভব যুগেই তাঁরা গদ্যের পরিবর্তে কাব্যের সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন।”

এগুলোই গদ্য সাহিত্যের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশের প্রধান কারণ হলেও আর কিছু কিছু কারণের কথা অপর কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন। যেমন মনীষী গোপাল হালদার তাঁর ‘বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, “অনেক ভাষার থেকে বাংলায় যে গদ্য বিলম্বে জন্মায় তার একটা কারণ বাঙলা পয়ারের সহজ নমনীয়তা ও প্রকাশ ক্ষমতা। ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ই তার প্রমাণ।”

প্রাচীন বাংলা গদ্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত পত্র, ফর্দ, দলিল, চুক্তিপত্র, কথোপকথন ইত্যাদি আকারে রচিত হতো। প্রাথমিক গদ্যের অধিকাংশ নিদর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এগুলো দাড়ি, কমা, পূর্ণচ্ছেদ, প্যারা প্রভৃতি ছাড়াই একসাথে রচিত হতো। সুতরাং পণ্ডিত ব্যক্তি ছাড়া এর ভাব বুঝাও কষ্টসাধ্য ছিল। উচ্চমহলে কিংবা রাজাদের মধ্যে পত্রালাপে কাটা কাটা গদ্য ব্যবহৃত হতো। অনেক সময় একটি বা দুটি দীর্ঘ বাক্যেই একটি পূর্ণ পত্র লেখা সমাপ্ত হতো। কোনো কোনো নাটকেও প্রাথমিক গদ্য ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। দাড়ি, কমা যথাযথভাবে ব্যবহৃত না হওয়ায় সে সময়ের গদ্য বুঝা সাধারণের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল।

লিখিতভাবে বাংলা গদ্যের এযাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীনতম নিদর্শনরূপে গৃহীত হয় কোচবিহার রাজ নারায়ণ কর্তৃক ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অহোমরাজ চুকামমা স্বর্গদেবকে লিখিত একখানা চিঠি। এর ভাষা- “তখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে।”

বাংলা গদ্যভাষার চর্চা যে বহু আগেই শুরু হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে গদ্যভঙ্গির সুগঠিত’ রূপ থেকেই। জনৈক চণ্ডীদাস রচিত ‘চৈতন্যরূপ প্রাপ্তি’ নামক গ্রন্থে, বৈষ্ণবাচার্য নরোত্তম রচিত ‘দেহ কড়চা’ নামক গ্রন্থে এবং অপর কোনো কোনো বৈষ্ণবতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থে এক জাতীয় ভাঙা গদ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। বৈষ্ণবদাস নামক কবি উল্লেখ করেছেন যে চণ্ডীদাস নাকি ‘গদ্য পদ্যময়’ গীত রচনা করেছিলেন। রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণে’ একটুখানি গদ্য রচনার নিদর্শন পাওয়া যায়, “হে কালিন্দি জল বার ভাই বার আদিত্ত। হথ পতি লব সেবকর অর্ঘ্য পুষ্প পানি। সেবক হব সুখি।” এ সমস্ত গ্রন্থের কাল দুঃসাধ্য বলেই এ সকল গদ্য রচনার বয়স নির্ণয়ও সুকঠিন। এ সমস্ত ধর্মসম্পর্কিত রচনায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার দুর্লভ হলেও সপ্তদশ শতকের শেষভাগে কিংবা অষ্টাদশ শতকের রচনায়, বিশেষত দলিল দস্তাবেজের ভাষায় আরবি ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত একটি দলিলের ভাষা-“লিখিতং শ্রীকৃষ্ণদাস ও নরসিংহদাস আগে আমরা দুই লুকে কড়ার করিলাম জে কিছু বার সুনারগায় গর খরি করি সকরাত ২ দুই রূপাইয়া করিআ আরত দালালি লইব আর কুন দীয়া নাই খুরাক সমেত এই নিয়মে পত্র দিলাম।”

এ থেকে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, তৎকালে ছেদচিহ্নের ব্যবহার ছিল না এবং অন্তত লেখ্য ভাষা ছিল সাধুরীতি আশ্রিত। এ ছাড়া আরবি ফারসির বাহুল্য তো ছিলই। ইউরোপীয় জাতিদের মধ্যে ইংরেজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, জার্মান ইত্যাদি অনেকেই ব্যবসায় বাণিজ্যে উদ্দেশ্যে বাংলায় এলেও শেষপর্যন্ত ইংরেজ এবং অংশত ফরাসিরা শাসন ব্যপদেশে এদেশে দীর্ঘকাল বসবাস করে সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু ষোড়শ, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে পর্তুগিজদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য। বিদেশীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই যে সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন, তা স্বীকৃত সত্য।

১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা বাংলাভাষায় কোনো গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন বলে জানা গেলেও সেই গ্রন্থের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, তবে ১৭৩৪ খিষ্টাব্দে মনোএল দ্য অসুম্পসাও নামক জনৈক পর্তুগিজ পাদ্রি ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ (Crepar Xaxtrer Orth Bhed) নামে যে গ্রন্থটি রচনা করে ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে রোমান অক্ষরে তা মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন, এটিই বাংলাভাষায় রচিত প্রথম গদ্যগ্রন্থরূপে স্বীকৃত হয়ে থাকে।

‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ গ্রন্থের ভাষার নমুনা: “ফ্লান্দিয়া দেশে এক সিপাই বড় তেজোবস্ত আছিল; লড়াই করিতে করিতে বড় নাম তাহার হইল; এবং রাজায় তাহারে অনেক ধন দিলেন। ধন পাইয়া তাহার পিতামাতার ঘরে গেল। তাহার দেশে রাত্রে পৌছিল; তাহার এক বইন আছিল; তাহারে পন্থে লাগাল পাইল; ভাইয়ে বইনেরে চিনিল তাহারে বইনে না চিনিল।”

ভূষণার বাঙালি রাজপুত্র দস্যু দ্বারা অপহৃত ও খ্রিষ্টানধর্মে দীক্ষিত হয়ে দোমআন্তনিও নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ নামে এক গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। এটিও সম্ভবত লিম্বন শহরে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছিল। “আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত পর্তুগীজ পাদ্রীদের বাঙলা গদ্য রচনা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই ‘বাঙলা গদ্যের প্রকাশ্য ব্যবহারের সূত্রপাত’ হ’য়েছিল বলেই অনেকে মনে করেন। তাদের রচিত গদ্যে’ পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার ছাপ থাকলেও তার গঠনরীতি ছিল সর্ববঙ্গীয় সাধুভাষার আধারে স্থাপিত এবং পূর্বাবধি প্রচলিত ধারারই অনুবর্তন।”

ইংরেজদের চেই! পর্তুগিজদের বাংলা গদ্যভাষা চর্চার পশ্চাদবর্তী কারণটি ছিল ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত। পক্ষান্তরে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকেই যে ইংরেজগণ বাংলা গদ্যভাষা চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন, তার মূলে ছিল প্রশাসনিক প্রয়োজন। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করার পরই বাংলাভাষা চর্চার উপযোগিতা উপলব্ধি করেন।

১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে হ্যালহেড ‘The Grammar of the Bengali Language’ রচনা করেন। এটি ইংরেজিতে রচিত এবং বাংলা গদ্যে রচিত পূর্ণবাক্য না থাকলেও বাংলা অক্ষরের প্রথম ব্যবহার এতেই লক্ষিত হয়। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জোনাথন ডানকান, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে এন, বি. এডমনস্টোন এবং ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে হেনরি পিটস ফরস্টার কোন কোন আইনগ্রন্থের ও আইনের বাংলা অনুবাদ গদ্যে রচনা করেছিলেন। এঁদের কারও কারও ফারসিঘেঁষা হলেও বিশেষভাবে ফরস্টারের বাংলা অনুবাদ ছিল সংস্কৃতঘেঁষা। সম্ভবত বাংলাভাষার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার কথা অনুমান করেই বাংলাভাষার প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তাঁরা সংস্কৃতের অনুবর্তী হয়েছিলেন।

রুশ প্রচেষ্টা: এই প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতকের অন্তিম পর্বে বাংলাভাষায় অনূদিত দু’খানি নাটকের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দ হেরাসিম লেবেডফ নামক জনৈক রুশ নাট্যামোদী কোলকাতায় নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করে দু’খানি বাংলা নাটক অভিনয় করেছিলেন। একখানি ‘The Disguise’ নাটকের বঙ্গানুবাদ ‘কাল্পনিক সংবদল’ এবং অপরখানি ‘Love is the Best Doctor’ এর অনুবাদ। অনুবাদ তিনি স্বয়ং করেছিলেন অথবা তাঁর ভাষাশিক্ষক গোলকনাথ দাসকে দিয়ে করিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। দুই গ্রন্থই অপ্রাপ্য বিধায় এদের ভাষা বিষয়ে কিছু জানার উপায় নেই। এরপর ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হলেই বস্তুত বাংলা গদ্য সাহিত্যের এবং তৎসহ বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তন ঘটে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মহৎ কোনো কিছু যেমন একদিনে গড়ে ওঠেনি, তেমনি বাংলা সাহিত্যে গদ্যের সার্থক পদচারণা একদিনে তৈরি হয়নি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা গদ্যচর্চার সফল প্রচেষ্টা শুরু হলেও তারও দু’তিন শত বছর পূর্বে বাংলা গদ্যচর্চার কিছু নমুনা পাওয়া যায়। অর্থাৎ চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় লেখনী প্রভৃতির মধ্যদিয়ে গদ্যচর্চার যাত্রা শুরু হয়ে তা পরিণতি লাভ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।